আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লুঙ্গি, লাইফ স্টাইল, ফ্যাশন ও ব্যক্তিত্বের জাহিরি দশা

সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com

(কবিসভা গ্রুপে একদা লুঙ্গি নিয়া প্রচুর তর্ক হইছিল। আলোচনার কেন্দ্রে ছিল অরূপ রাহীর লুঙ্গি। এখন ঢাকা ক্লাবের ঘটনায় ফরহাদ মজহারের লুঙ্গি আলোচনার কেন্দ্রে আসছে। কবিসভার আলোচনায় আমি ফরহাদ মজহারের লুঙ্গির কথা উল্লেখ করছিলাম।

লুঙ্গি বিষয়ে সেই আলোচনাটা পড়লে মজা হবে। এই ভাবনায় আলোচনার লিঙ্ক এইখানে দিলাম। Click This Link কবিসভায় আমার পোস্টের লিঙ্ক : Click This Link লেখাটা ২০০৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরে পোস্ট হইছিল। ) অরূপ রাহীর লুঙ্গি কাহিনি হাতে পেয়ে যার পর নাই খুশি হইছিলাম। ‘অবশেষে’ রাহী নিজের লুঙ্গিকে আলোচ্য বিষয় করছেন, এইটা আমার স্ফূর্তির বিষয়।

হযরতকে চিনি মেলা দিন, বন্ধু বলেও মানি, কিন্তু তিনি যা পরেন তাকে এতদিন তার ব্যক্তিগত ব্যাপার বলিয়া মনে করছি। ফলে, দূর থেকে তার পরিধেয়কে পাঠ করছি বটে কিন্তু কথা তুলি নাই। সভ্যতা ও ভব্যতার সীমা টানিয়া নিজেকে সংবরণ করছি। এক্ষণে তার পোস্ট থেকে অনুমান হইলো, তিনি এই বিষয়ক আলোচনাকে অনুমতি দিতেছেন। সুযোগ নিলাম।

সুযোগ প্রথম দিনেই নিতে চাইছিলাম সময়ের সাথে পারিয়া উঠি নাই। ফলে অদ্য কিবোর্ডে হস্তসঞ্চালন করতেছি। ইতিমধ্যে কিছু বাগবিস্তার সম্ভব হয়েছে। আলোচনা এই পর্যন্ত গিয়াছে যে, লুঙ্গিকা নিচে ক্যায়া হ্যায়, লুঙ্গিকা নিচে? হিন্দি সিনেমায় বহুল প্রচারিত একটি গান চোলি কা পিছে ক্যায়া হ্যায় চোলি কা পিছে? এই গান ভারতবর্ষে গৃহীত হয়েছে, সম্ভবত গানের প্রশ্নটাও। ফলে সুমন রহমানের প্রশ্নও গৃহীত হইবে, অসম্ভব কী? পরন্তু খোঁচাখুঁচি তো আছেই।

কবিসভার সব আলোচনার একটা ভাব আছে। একটা পদ্ধতি ও পরিণতিও আছে। সেই অনুসারে আলোচনা ব্যক্তিগত প্যাকে আসিয়া গোবরের গন্ধ ছড়ায়। এইখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নাই। ভবিষ্যতেও ঘটবে বলে মনে হয় না।

তর্ক থেকে ভার্চুয়াল খুনাখুনি পর্যন্ত গিয়া হয়তো আলোচনার অন্তিম পরিণতি। সন্দেহ, রাহী এই আলোচনার পর হয়তো তার বিদ্যমান লুঙ্গি আর খুঁজে পাবেন না। মানস চৌধুরীকে আগাম দুই জোড়া লুঙ্গি কিনিবার অফার দিয়া রাখতে হয়। এক জোড়া রাহীর জন্য, অন্য জোড়া সুমন রহমানের জন্য। রাহীর সাহস আছে বটে, তিনি স্বেচ্ছায় আলোচনা ডাকিয়াছেন।

লুঙ্গি পরা কি সাহসের কাজ? অবশ্য লুঙ্গি পরিয়াও তিনি যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়াছেন। আমার দৃষ্টিতে, লুঙ্গি পরা সাহসের কাজ নয়। কিন্তু রাহী যে সময় লুঙ্গি ধরিয়াছিলেন সে সময় সাহসের কাজ ছিল। সাহস এই কারণে যে, তাহার আগেও বাংলার ভাবুকতার জগতে লুঙ্গি ছিল। আর তা ছিল এই জগতের কান্ডারি ফরহাদ মজহারের পরণে।

দর্শন চর্চার ইতিহাসে দ্বিতীয় লুঙ্গি রাহীর। ফলে স্বভাবতই নানা অনুযোগ অভিযোগ তাকে সহিতে হইয়াছে, সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে, কল্পনা করি। কিন্তু দুঃখ, রাহী এই অগ্রজ লুঙ্গির কথা তাহার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন নাই। সুমন রহমান করেছেন। ভাবুকতার জগতে দ্বিতীয় দফা লুঙ্গি পরিবার গুরুত্ব নাই।

কিন্তু ফ্যাশন হিসাবে লুঙ্গি বারবার পরা যাইতে পারে। (সিদ্ধান্ত নহে, প্রস্তাব) বিষয় হইলো, বাংলার ভাবুকতার জগতে কি ফরহাদ মজহারের লুঙ্গিই প্রথম লুঙ্গি? হ্যাঁ, যদি ভাবুকতার ব্যাখ্যার ইতিহাসে ফরহাদ মজহারের গুরুত্ব স্বীকারে আমরা তৎপর হই তবে ইহাই প্রথম লুঙ্গি। আর যদি তার আগে অর্থাৎ রাজনীতি ও দর্শনের একাকারের সময়ে যাই তবে ফরহাদ মজহারের লুঙ্গিও দ্বিতীয় লুঙ্গি। প্রথম লুঙ্গি প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের। কথিত আছে, তিনিও ভদ্রসমাজে লুঙ্গি পরিবার অভ্যাস করেছিলেন।

আর যদি আরও বৃহত্তর পরিসরের দিকে তাকাই তবে মওলানা ভাসানীর লুঙ্গি কারও চোখ এড়াইবার কথা নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিক ও বিদ্যান সমাজে এই হইলো লুঙ্গির ইতিহাস। মওলানা ভাসানী হইতে অরূপ রাহী। প্রশ্ন উঠে, এক সামর্থহীন ট্রাউজার পরুয়া হকার আর সামর্থ্যবান গাউন পরুয়া ধনী বাদে কোন বাঙালি মুসলমানের ঘরে লুঙ্গি নাই? আর কেহ স্বেচ্ছায় ট্রাউজারের অভ্যাস করিতে পারেন। ঘরে ঘরে এত লুঙ্গি, দিনের বেশির ভাগ সময় এই পরিয়াই কাটাইতে হয়।

অবস্থা এমন যে, একজনের লুঙ্গির সঙ্গে অন্যজনের লুঙ্গির ভেদ করাই যেখানে মুশকিল সেখানে এই বিদ্যানদের লুঙ্গিকে চিনিবো কেমনে? বিদ্যানেরা বোঝেন, পোশাক মূল্য উৎপাদন করে। পলিটিকাল, সোশাল বা অর্থনৈতিক কারণের উদ্রেক ঘটায়। ড. ইউনুসের গ্রামীণ চেকের আলাদা মূল্য আছে। বিবি রাসেলের গামছারও আলাদা মূল্য। কাদের সিদ্দিকীর গামছারও আলাদা মূল্য।

এইগুলার সঙ্গে ব্যবসা, পসার এমন কি ভোটেরও সম্পর্ক। এখন বিদ্যানের লক্ষ্য বোঝা কষ্ট। কোন ভেক ধরে তিনি কী মূল্য তৈয়ার করতে চান আর তাতে কী ফায়দা হয় তা ‘তিনি’ ছাড়া অন্য কেউ জানেন বলে মনে হয় না। কেহ উন্নয়নের জন্য গামছা পরে, আর কেউ ভোটের জন্য গামছা পরে। কেউ কৃষকদের সঙ্গে কারবারের জন্য লুঙ্গি পরে আবার কেউ কৃষকের ভাব সৃষ্টি করার জন্য লুঙ্গি পরে।

কেউ কৃষক নেতা বলেই লুঙ্গি পরে। কেউ আবার বলে ইহাই আমাদের জাতীয় পোশাক। এ বলে আমাকে দেখ, ও বলে আমাকে দেখ। ব্যাখ্যাটাও তিনিই দেন। আর ব্যাখ্যাকে সন্দেহ নিয়া পর্যবেক্ষণ করা ভাল।

কারণ, ব্যাখ্যা প্রচুর। উদ্দেশ্য অনুসারে ব্যাখ্যা নির্বাচনও সহজ। ফলে, রাহীর লুঙ্গি পরার কারণকে আমি সন্দেহ করি। লুঙ্গি ও জাতীয়তাবাদ একদিন সহসা মনে হইলো, বাংলাদেশে যদি জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের প্রসার ভারতের মতো হইতো তবে নিশ্চয় লুঙ্গি বিতর্কের অবসান ঘটিতো। একজন ভারতীয় যত সহজে ধুতি পরিয়া ভদ্র সমাজে গতায়াত করিতে পারেন তাহার কিছুই এখানে সম্ভব নহে।

কারণ, ভারতে পোশাকের জাতীয়তাবাদী প্রকল্প এমনভাবে চর্চা হইয়াছে যে, গুরুতর কারণ না থাকিলে যে কেহ যে কোথাও ধুতি ব্যবহার করতে পারেন, আর ইহার পেছনের কারণ যাহাই হোক জাতীয়তাবাদের শক্তিশালী যুক্তি সর্বদা বজায় থাকিবে। লুঙ্গি জাতীয় পোশাক হইতে পারে কি না এই তর্ক এখন অবান্তর। শুনিয়াছি লুঙ্গি বর্মী শব্দ। লুঙ্গি জিনিশটাও বর্মী হইলে কিন্তু বাঙালি মুসলমান পুরুষের পোশাকী জাতীয়তার আত্মহত্যা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। লুঙ্গির আরেকটা নাম আছে তবন বা তহবন।

কামনা করি এই শব্দটা বিদেশি না হউক। রাহী জাতীয়তাবাদী কোনো কারণে প্যান্ট শার্ট ত্যাগ করবেন এইটা ভাবা কঠিন। ঔপনিবেশিক শাসকরা বাঙালি পুরুষকে তার আগের পোশাক ছাড়িয়ে শার্টপ্যান্ট ধরিয়ে ছেড়েছে। এখন এইটা তার নিয়তি। রেলগাড়ির মতো এইটাও শহরে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে।

এখন রেলগাড়ি উচ্ছেদ করার মতোই শার্ট প্যান্ট ত্যাগ করার ঘটনা। তবে পুরুষ বাহিরে লুঙ্গি ত্যাগ করিলেও অন্তরে (অন্দরে) রাখিয়াছে। গত তিনশ বছর ধরে এই রীতি চলিতেছে। ফলে লুঙ্গি এখন ভদ্র সমাজে যতটা চাষার পোশাক তার চেয়ে বেশি রাত্রিকালীন। লুঙ্গি পরিলে লোকে হাসে, পরিহাস, কূটাভাস করে।

ইহার অন্যতম কারণ বোধহয় সেক্সি। ইহা রাত্রীকালীন পোশাক। বাকি যে সমাজতাত্ত্বিক, দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা তাহা রাহী জীবন দিয়া বলিয়াছেন। তার বিচারে ভরসা রাখি। অবশ্য নারীদের কথা আলাদা।

তাহারা উপনিবেশের প্রবল পরাক্রম থেকে পোশাক রক্ষা করেছেন। ইহার জন্য বুদ্ধিজীবীতার দরকার হয় নাই। দরকার যা হইয়াছে তাহাকে বলে রক্ষণশীলতা বা সংরক্ষণশীলতা। জাহিরি ও বাতেনি নিজেকে জাহির করিবার নিয়ম চারদিকেই আছে। জাতীয়তাবাদের আছে, পতাকায়।

কবিদের কেহ চুল দিয়া, কেহ পোশাক দিয়া নিজেকে শনাক্ত করাইতে চান। এই বাহ্যিক পরিচয়ে লোকে আমারে দেখুক, বা না দেখুক। এই এক্তিয়ার ব্যক্তির। ফলে, আমি যে অর্থনৈতিক কাঠামোর অংশ তার রীতি অনুসারে নিজেকে জাহির করিতে পারি। অথবা তার উল্টো করে।

তাতে কাঠামোর কিছু হয় না। দলে দলে লোকে পোশাকী বিপ্লবে লেগেও পড়ে না। কিন্তু লাভের লাভ হলো, লোকে আমাকে আলাদা করিয়া চিনতে পারে। আমার ব্র্যান্ডিং হয়। ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তা বাড়ে।

অবশ্য শহিদুল আলমের মতো পর্যবেক্ষকের হাতে পড়িলে ব্র্যান্ডের অবস্থা কাহিল হইতে পারে। ইনি নিজে ব্র্যান্ড তৈয়ার করিতে প্রস্তুত কিন্তু অন্য ব্র্যান্ড চিনিতে পর্যন্ত ব্যর্থ হইয়াছেন। বা চিনিতে এনকার (অস্বীকার) করিয়াছেন। এই স্থূল পর্যবেক্ষণ লইয়া আলাপে লাভ কী? অবশ্য এইটুকু বুঝি, শহিদুল ভুল না করিলে আমাদের এই আলোচনার সুযোগ ঘটিত কি না সন্দেহ। অতএব, শহিদুল জিন্দাবাদ।

মাহবুব মোর্শেদ ঢাকা ছবি : grzegorzkomar এর ফ্লিকার থেকে অনুমতি ছাড়া নেওয়া।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.