আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাচীন চিনের সম্রাট শি হুয়াং তি

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
চিনের সম্রাট শি হুয়াং তি ( ২২১ -২১০ খ্রিস্টপূর্ব) মাত্র ৫০ বছর বয়েসে মৃত্যুবরণ করলেও অমরত্ব লাভের বড় সাধ ছিল সম্রাটের । সে জন্যই জীবনভর সন্ধান করেছেন অবিনশ্বর জীবনলাবে বিভিন্ন অলৌকিক আরক। এ কারণেই রহস্যময় তাওবাদী শামানদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন সম্রাট।

তো তারা সম্রাটকে খেতে দিল সীসার তৈরি আরক। আর তাতেই মৃত্যুর ক্রমশ ঘনিয়ে এল সম্রাটের । মৃত্যুর অনেক আগেই সমাধিসৌধটি নির্মান ছিলেন সম্রাট। বড় বিচিত্র সে সমাধিসৌধ- মেঝেতে পারদের জলাশয়, ছাদে হিরে আর রুপোর নক্ষত্র, এখানে ওখানে অজস্র টেরাকোট সৈন্যর মূর্তি। সে জমকালো সমাধিসৌধের পরিকল্পনা প্রাচীন মিশরিয় ফারাওদেরও হার মানায় ... প্রথম ঐক্যবদ্ধ চিন সাম্রাজ্যটি সম্রাট শি হুয়াং তি-র সময়েই গড়ে উঠেছিল।

চিনের ইতিহাসে দারুন বিতর্কিত সম্রাট শি হুয়াং তি । একদিকে যেমন কল্যাণকর অর্থনৈতিক সংস্কার করেছিলেন অন্যদিকে বেপরোয়া রাজনৈতিক দমন-পীড়ন চালিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। চিনের প্রাচীরের প্রথম পরিকল্পনাকারী তিনিই। একদিকে যেমন সাম্রাজ্যজুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন- অন্যদিকে কনফুসিয়াসের সব বই পুড়িয়ে ফেলেছিলেন নিজের মতবাদকে অক্ষয় রুপ দেবার জন্য। স্বৈরাচারী শাসন সত্ত্বেও তাঁর অবদানকে স্বীকার করেন আধুনিক চিনা ঐতিহাসিকেরা।

প্রাচীন চিন চিনের ইতিহাসে ‘ওয়ারিং স্টেটস পিরিয়ড’ বা ‘যুদ্ধরত রাজ্যগুলির অধ্যায়’ বলে একটা কথা আছে। এই সময়কালে আধিপত্য লাভে আশায় সাতটি রাজ্য একেঅন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। রাজগুলি হল: চু, হান, কি, কিন, ওয়েই, ইয়ান ও ঝাও। আগে ঝাও রাজ্যটি শক্তিশালী ছিল। চিনেরা বিশ্বাস করে: ঝাও বংশ শাসন করত আগুনের শক্তিতে ।

সেই আগুনের রং ছিল লাল। যা হোক। ঝাও রাজ্যটি দূর্বল হয়ে পড়লে সাতটি রাজ্য একে অন্যকে গ্রাস করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঝাও রাজ্যের সময়কাল: ১০৪৫ থেকে ২৫৬ খ্রিস্টপূর্ব। কাজেই, ‘ওয়ারিং স্টেটস পিরিয়ড’ এর সময়কাল ২৫৬ খ্রিস্টপূর্বর পরে।

যুদ্ধরত সাতটি রাজ্যের অন্যতম হল কিন। কিন রাজ্যটির অবস্থান ছিল চিনের উত্তর-পশ্চিমে। কিন রাজ্যের রাজধানী সিয়ানইয়াং। বর্তমানের চিনের শেনসি প্রদেশের সিয়ান শহরের কয়েক কিলোমিটার উত্তরপশ্চিমে অবস্থিত ছিল কিন রাজ্যটির রাজধানী সিয়ানআঙ। এখনকার সিয়ান।

এই শহরের কয়েক কিলোমিটার উত্তরপশ্চিমে অবস্থিত ছিল কিন রাজ্যটির রাজধানী সিয়ানআঙ। সিয়ান। চিনে ভাষায় শি হুয়াং তি-র মানে: “প্রথম সার্বভৌম সম্রাট। ” তবে সম্রাট শি হুয়াং তি-র জন্মকালীন নাম ছিল ঝাও ঝেং; মায়ের নাম ঝাও জি। তিনি ছিলেন ঝাও রাজ্যের এক নর্তকী।

তিনি কী করে কিন রাজ্যে এলেন তা আমি বলতে পারছি না। যা হোক। ঝাও জি-র স্বামীকে ঝাও রাজ্যে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। স্বামীর দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে ঝাও জি ঝুআঙজিয়াঙ নামে একজনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং সন্তানসম্ভাবা হয়ে পড়েন। ২৫৯ খ্রিস্টপূর্ব।

কিন রাজ্যের রাজধানী সিয়ানআঙ এ ঝাও ঝেং জন্ম গ্রহন করেন। ঝাও ঝেং- এর মা ঝাও জি কিন রাজ্যের ধনী ব্যবসায়ী লু বুওয়েই-এর রক্ষিতা ছিলেন। এ জন্যে অনেকে মনে করেন ঝাও ঝেং এর প্রকৃত বাবা লু বুওয়েই । তবে এ অনুমান আধুনিক চিনা ঐতিহাসিকরা সত্য মনে করেন না। সে যা হোক।

সম্ভবত ঝাও জি ঝুআঙজিয়াঙ কে ভালোবেসে ফেলেছিলেন এবং কোনও এক বিচিত্র কারণে ঝুআঙজিয়াঙ লু বুওয়েই- এর বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন । ঝাও জি ঝুআঙজিয়াঙ কে কিন রাজ্যের ক্ষমতায় বসাতে লু বুওয়েইর কে অনুরোধ করেন। লু বুওয়েই এ প্রস্তাবে সম্মত হন। ইতিহাসের যে-কোনও সময়েই ধনীরাই ক্ষমতাশালী। ঝুআঙজিয়াঙ কিন রাজ্যের প্রকৃত উত্তরাধিকারী না-হলেও ধনী ব্যবসায়ী লু বুওয়েই ঝুআঙজিয়াঙ কে কিন রাজ্যের সিংহাসনে বসান।

অনুমান করা যায়, এজন্য তিনি প্রচুর অর্থ খরচ করেছিলেন। যাক। ২৪৬ খ্রিস্টপূর্ব। তিন বছর রাজত্ব করে ঝুআঙজিয়াঙ মারা গেলেন। ঝাও ঝেং এর বয়স সে সময় তেরো।

এবার ঝাও ঝেংকে সিংহাসনে বসানো হল । কিন ততদিনের বেশ শক্তিশালী রাজ্য হয়ে উঠেছে। নিয়মিত যুদ্ধ করছে অপর ছটি রাজ্যের সঙ্গে। নাবালক সম্রাটের উপদেষ্টা ছিলেন লু বুওয়েই। যাই হোক।

যথাসময়ে পূর্ন সম্রাট হলেন ঝাও ঝেং । সম্রাট হয়েই মায়ের এক প্রেমিক কে হত্যার নির্দেশ দিলেন। মায়ের সেই প্রেমিকটি উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করছিল। এরপর মাকে এবং লু বুওয়েই কে নির্বাসনে পাঠান ঝাও ঝেং। এইভাবেই তাঁর অস্বাভাবিক জীবনের শুরু।

ঝাও ঝেং-এর মন্ত্রী ছিলেন লি সি। তিনি ছিলেন প্রাজ্ঞ একজন মানুষ। তারই যোগ্য ব্যবস্থাপনায় কিন রাজ্যে শক্তিশালী আমলাতন্ত্র গড়ে তোলেন। চিনে তখন চারটে দার্শনিক মতবাদ ছিল। ১. কনফুসিয়াসের দর্শন, ২.তাওবাদী দর্শন।

৩ মহীবাদ ও ৪. বৈধবাদ। রাষ্টীয় আদর্শ হিসেবে লি সি ও ঝাও ঝেং বৈধবাদ বা লিগালিজম গ্রহন করেন । বৈধবাদ বা লিগালিজম কি? এক কথায় বৈধবাদ বা লিগালিজমের অর্থ: রাষ্ট্রীয় আইনের কঠোর প্রয়োগ। প্রাচীন চিনে লিগালিজম বা বৈধবাদের প্রবক্তা ছিলেন দার্শনিক হানফেনজি। তিনি “নিরুঙ্কুশ সরকার” নামে একটি বই লিখেছিলেন।

সে বইয়ে হানফেনজি লিখেছেন,People are submissive to power, and few of them can be influenced by doctrines of righteousness. (পরে হানফেনজি সম্বন্ধে আরও বিস্তারিত লিখব ...। ) কিন সাম্রাজ্য। চিন শব্দটি এই কিন শব্দ থেকেই এসেছে। যা হোক। প্রবল জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিন রাজ্য থেকে সম্রাট ঝাও ঝেং বিদেশিদের নির্বাসিত করেন।

এরপর প্রতিপক্ষ ছটি রাজ্যের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি খর্ব করার উদ্যোগ নেন। এ ক্ষেত্রে গুপ্তচর, উৎকোচ ও কিন সেনাদের নিষ্ঠুর আচরণ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছিল। ...২২১ খ্রিস্টপূর্বে কি রাজ্যটি কিন রাজ্যে যুক্ত হয়। এর আগেই অপর পাঁচটি রাজ্যবে বশীভূত করেছিলেন সম্রাট ঝাও ঝেং। এর পরপরই কিন রাজ্যের অধীনে সমগ্র চিন একত্রিত হল।

সম্রাট ঝাও ঝেং নিজেকে “শি হুয়াং তি” ঘোষনা করলেন। সম্রাট শি হুয়াং তি সম্রাট এবার অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে মনোযোগী হলেন। পরিমাপের একক নির্ধারণ করে দিলেন। আগে চু, হান, কি, কিন, ওয়েই, ইয়ান ও ঝাও-এই সাতটি রাজ্যে পরিমাপের একক ভিন্ন ভিন্ন ছিল। যোগাযোগ সুবিধার জন্য ঘোড়ার গাড়ির চাকার দন্ড প্রশস্ত করার নির্দেশ দিলেন।

সমগ্র সাম্রাজ্যে রাস্তা ও খাল নির্মান করার উদ্যোগ নিলেন; কেননা, প্রদেশগুলি একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত হলে-ব্যবসাবানিজ্যর প্রসার ঘটে- দারিদ্র দূর হয়। সাম্রাজ্যে অভিন্ন মুদ্রা প্রচলন করেন-এই অভিন্ন মুদ্রার নাম বান লিয়াং মুদ্রা। আগে সাতটি রাজ্যে বিভিন্ন মানের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। এখন অভিন্ন মুদ্রা চালু হওয়ায় অর্থনৈতিক জীবনে গতিশীলতা আসে। মুদ্রা ছাড়াও সমগ্র সাম্রাজ্যে অভিন্ন লেখনি চালু করা হল।

ছড়িয়ে পড়ল এক ভাষা-যা চিনের অখন্ডতা রক্ষা সাহায্য করেছিল। আজ যে চিনকে আমরা পাই -তারই ভিত্তিমূল স্থাপন করেছিলেন সম্রাট শি হুয়াং তি। সম্রাট শি হুয়াং তি সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রেখে প্রতিরক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর দিলেন সম্রাট। একবার নাকি সম্রাট শি হুয়াং তি বলেছিলেন: ‘আমি দক্ষিণের বাঘের চেয়ে উত্তরের মুরগিকে বেশি ভয় পাই। ’ সম্রাটের এ রকম বলার কারণও আছে।

প্রায়ই উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বর্বর অশ্বারোহীরা চিন সাম্রাজ্য আক্রমন করত। সম্রাট রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমে প্রাচীর বা দেওয়াল দেওয়ার কথা ভাবলেন । চিনের প্রাচীরের একাংশ এখানে বলে রাখা দরকার। চিনের প্রাচীর কিছুটা আগে থেকেই ছিল। তবে সম্রাট শি হুয়াং তিই সত্যিকার অর্থে প্রথম চিনের প্রাচীর নির্মাণের উদ্যেগ গ্রহন করেন।

এবং এই নির্মাণ কাজ সম্রাট শি হুয়াং তি-র মৃত্যুর শত শত বছর পরেও চলেছিল। যা হোক। । সম্রাট রাজ্যের প্রতিটি সক্ষম পুরুষদের উত্তরে পাঠিয়েছিলেন। দেওয়াল উঠল ঠিকই-তবে অজস্র প্রাণের বিনিময়ে।

কথাটা খোলাসা হওয়া দরকার। আমরা বলি চিনের প্রাচীর বা গ্রেট ওয়াল। চিনেরা বলে দীর্ঘ দেওয়াল। চিনের প্রাচীর নিয়ে ওদের কত গর্ব, গর্ব পৃথিবীর মানুষের। তার কারণ আছে।

চিনের প্রাচীরই পৃথিবীর একমাত্র মানবনির্মিত কাঠামো যা কিনা চাঁদ থেকে দেখা যায়! কিন্তু, চিনের প্রাচীরটি গড়তে যে সব শ্রমিকরা অমানুষিক পরিশ্রম করে প্রাণ দিয়েছে তাদের কথা কি আমরা কখনও ভাবি? বোধ হয় না। সেদিন একজন তাজমহল ঘুরে এসে বলল সুন্দর। কই রক্তপাতের কথা তো একবারও বলল না! যা হোক। চিনের প্রাচীরের শ্রমিকদের দুঃখকষ্টের কথা নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলে চিনের এক কবি । কবির নাম চেন লিন।

হান রাজবংশের শেষ আমলে চেন লি বেঁচে ছিলেন । মৃত্যু ২১৭ খ্রিস্টাব্দ । কবিতায় তিনি চৈনিক সম্রাট শি হুয়াঙ তি-র সময়কালে দীর্ঘ প্রাচীরের শ্রমিকদের দুঃসহ জীবনের কথা লিখেছেন। কবিতার নাম: “দীর্ঘ দেওয়ালের গুহার কাছে আমি আমার ঘোড়াকে পানি খাওয়াই। ” অভিজাত বংশে জন্ম হলেও সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ অনুভব করার শক্তি চেন লিনের হৃদয়ে ছিল।

কবি বলেই হয়তো ...। দীর্ঘ দেওয়ালের গুহার কাছে আমি আমার ঘোড়াকে পানি খাওয়াই, ঠান্ডা পানি ঘোড়াটির হাড়গোর কাঁপিয়ে দেয়; দীর্ঘ প্রাচীরের কাছে গিয়ে আমি প্রহরীকে বলি: “আমরা তাইয়ূয়ানের লোক- তোমরা কি আমাদের এখানে চিরকাল আটকে রাখবে?” “ সম্রাটের কাজ ঠিকঠাক চালাতে হবে-কথা কম বল আর হাতুড়ি চালিয়ে যাও। ” এই দীর্ঘ দেওয়ালে ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে আমার যুদ্ধক্ষেত্রেই মরে যাওয়া উচিত ছিল! তিন হাজার লি দীর্ঘ আঁকাবাকা এই অভিশপ্ত দীর্ঘ প্রাচীর! এখানে সীমান্তের কাছে, পুরুষেরা পরিশ্রমে নুয়ে আছে। অথচ বাড়িতে তাদের বউরা ... বিধবারা ... আমি আমার বউয়ের কাছে চিঠি লিখেছি: “আমার জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে বরং আবার বিয়ে করো- নতুন শ্বাশুড়ির যত্ন নিও মাঝে মাঝে আমার কথাও ভেবো। ” বউ লিখল-“ কি সব যা তা লিখেছ? তুমি যখন কষ্টে রয়েছে তখন আমি কী করে অন্য লোকে ঘরে যাই?” (সে) তোমার যদি ছেলে হয় তো কখনোই এখানে এনো না! মেয়ে হলে- ওকে ভালো করে খাইয়ো-পড়িও।

তুমি কখনোই দেখতে পাবে না কী ভাবে এখানে মৃতদের হাড়গোড়ের পাহাড় জমে উঠছে! (নারী) আমি চুল বেঁধে তোমার কাছেই যাব; আমার বুকের ভিতরে যে কী রকম করছে। আমি জানি সীমান্তের দুঃসহ যন্ত্রনার কথা। আমি ...আমি যে আর সইতে পারছি না ... সম্রাট শি হুয়াং তি-র ধর্মবিশ্বাস কি ছিল? সম্রাট ‘স্কুল অভ ফাইভ এলিমেন্টস’ বা ‘পাঁচটি উপাদান সম্প্রদায়’-এ বিশ্বাস করতেন। এ পাঁচটি উপাদান হল: মাটি, কাঠ, ধাতু, আগুন ও পানি। এর আগে ঝাও বংশ শাসন করত আগুনের শক্তিতে ।

সেই আগুনের রং ছিল লাল। সম্রাট শি হুয়াং তি পরের রংটি বেছে নিলেন। পরের রংটি হল কালো। সম্রাটের পোষাক, রাজ্যের পতাকা, সম্রাটের রাজদরবার সবখানেই কালো রঙের প্রলেপ পড়ল। সম্রাট শি হুয়াং তি কে নিয়ে চিনে অনেক চলচ্চিত্র হয়েছে।

সে সব ছবিতেও আপনারা কালো রঙের আধিক্য দেখতে পাবেন। উল্লেখ্য, ছবিগুলি ঢাকায় সুলভ। এর আগেই আমি একবার উল্লেখ করেছি যে সম্রাট শি হুয়াং তি মৃত্যু নিয়ে ভীষন আচ্ছন্ন ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২১৫। সেনাপতি মেং তিয়ানকে রাজধানী সিয়ানআঙ-এর অদূরে লি পাহাড়ের ওপরে সমাধি সৌধ নির্মানের আদেশ দেন সম্রাট ।

সমাধিসৌধের অভ্যন্তরে সমসাময়িক চিনা ঐতিহাসিকদের মতে সমাধিসৌধটি নির্মান করতে সেনাপতি মেং তিয়ান নাকি ৩, ০০০০০ শ্রমিক নিয়োগ করেছিলেন। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে অবশ্য শ্রমিকের সংখ্যা অত না। তারা মনে করেন সমাধিসৌধটি নির্মান করতে বড়জোড় ১৬০০০ শ্রমিক লেগেছিল আর নির্মাণকাজ ২ বছরে শেষ হয়েছিল। যা হোক, সমাধিসৌধের ভিতরে পারদের জলাশয়, রুপোর নক্ষত্ররাজি ও অসংখ্য টেরাকোটা সৈন্যমূর্তি স্থাপনের পরিকল্পনা নাকি সম্রাটেরই! সমাধিসৌধের অভ্যন্তরে টেরাকোটা সৈন্যমূর্তি যা হোক। নানা পদক্ষেপের ফলে কিন সামাজ্যের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল হয়ে এলে রাজ্যভ্রমনে বেরুলেন সম্রাট।

অবশ্য মনে করা হয় যে অমরত্ব লাভের উদ্দেশেই অমৃতসুধার সন্ধানেই সম্রাট রাজ্যভ্রমনে বেরিয়েছিলেন। বরাবরই দীর্ঘজীবন লাভের ইচ্ছে ছিল সম্রাটের। এ ভ্রমনের সময়ই তাওবাদী শামানরা তাঁকে ঘিরে রেখেছিল। তারা সম্রাটকে নানাবিধ আরক ও ভেষজ খেতে দিচ্ছিল। সম্রাটকে সত্যি সত্যিই মৃত্যুভয় জেঁকে বসেছিল।

দীর্ঘজীবন লাভের অমৃতসুধা তার চাইই চাই। এ কারণেই রহস্যাবৃত জিফু দ্বীপে তিনবার গিয়েছিলেন সম্রাট। জিফু দ্বীপটি সম্ভবত প্রাচীন চিনের কোনও রহস্যময় পীঠস্থান হবে। রহস্যময় পেঙলাই পাহাড়ের কথাও শুনেছিলেন সম্রাট। পেঙলাই পাহাড়টি নাকি কুয়াশাবৃত সমুদ্রে একটি দ্বীপে অবস্থিত।

আর সে দ্বীপে নাকি বাস করেন ১০০০ বছরের বুড়ো যাদুকর এনকুই শেঙ। সে যাদুকর নাকি অবিনশ্বর হওয়ার উপায় জানেন। সেই এনকুই শেঙ যাদুকরের খোঁজে জাহাজ ভর্তি করে তরুণ-তরুণি পাঠালেন সম্রাট । না, তারা আর ফিরে নি। পেঙলাই পাহাড়, ১০০০ বছরের বুড়ো যাদুকর এনকুই শেঙ -আসলে এসব হল রুপকথা; তাই শূন্যহাতে ফিরে এলে প্রাণ থাকবে? কথিত আছে, তরুণতরুণি ভর্তি জাহাজটি পৌঁছেছিল জাপানের কোনও দ্বীপে ।

ওখানেই তারা উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। যা হোক। সম্রাটের জীবনের শেষ দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২১১। চিনের বিখ্যাত এক নদীর নাম হলুদ নদী ।

সেই হলুদ নদীর পাড়ে ডংজুন গ্রাম। সেই ডংজুন গ্রামের হলুদ নদীর পাড়ে আকাশ থেকে একটি ধূমকেতু এসে পড়েছিল। সেই ধূমকেতুর ওপর কে বা কারা যেন লিখল - “সম্রাট শি হুয়াং তি মারা যাবে। আর তার রাজ্য খন্ডিত হবে। ” কথাটা সম্রাটের কানে গেল।

তিনি ডংজুন গ্রামে সৈন্যসহ রাজকীয় সচিবকে পাঠালেন। কিন্তু, কেউই অপরাধ স্বীকার করল না। সৈন্যরা ডংজুন গ্রামের সবাইকে হত্যা করল। ধূমকেতুটি গুঁড়িয়ে ফেলা হল। আমি আগেই বলেছি অমর হওয়ার জন্য নানা আরক খাচ্ছিলেন সম্রাট।

তার মধ্যে সীসার তৈরি আরকও খাচ্ছিলেন। লাভ হয়নি। খ্রিস্টপূর্ব ২১০ । ১০ সেপ্টেম্বর । সম্রাটের বয়স তখন ৫০।

চিনের পূর্বাঞ্চল ভ্রমন করছিলেন সম্রাট। জায়গাটি ছিল রাজধানী সিয়ানআঙ থেকে ২ মাসের পথ। সম্রাট মারা গেলেন। ব্যাপক গণঅভূত্থ্যানের আশঙ্কায় সম্রাটের মৃত্যুর খবর চেপে রাখা হল । মন্ত্রী লি সি সহ কয়েকজন মাত্র সম্রাটের মৃত্যুর খবর জানল।

যা হোক। সম্রাটের ঘোড়াগাড়ি রাজধানীর দিকে চলেছে। সামনে পিছনে ঘোড়াগাড়ি ভরতি পচা মাছ। কেন? যাতে দুগর্ন্ধে জনগন যাতে সম্রাটের ঘোড়াগাড়ি কাছে না আসতে পারে। আমি আগেই বলেছি, মন্ত্রী লি সি একজন প্রাজ্ঞ মানুষ।

গ্রীষ্মকাল বলেই সম্রাটের শরীরে পচন ধরল। গন্ধ ঠিকই ছড়ালো। দ্রুত চলছে ঘোড়াগাড়ি। গন্তব্য? রাজধানী সিয়ানআঙ-এর ৩০ কিলোমিটার দূরে লি পাহাড়ের ওপর সেই সমাধিসৌধে। তারপর? তারপর সম্রাট দীর্ঘকাল সেখানে শুয়ে থাকলেন।

চারিপাশে পারদের জলাশয়। ছাদে রুপোর তৈরি নক্ষত্র ... ১৯৭৪ সালে আবিস্কৃত হয়েছিল সে সমাধিসৌধটি। শিয়ানের স্থানীয় চাষীরা একটি কুয়া খোঁড়ার সময় আবিস্কার করেছিল সে সমাধি। সমাধিসৌধের অভ্যন্তরে সমাধিসৌধের অভ্যন্তরে টেরাকোটা সৈন্যমূর্তি সম্রাটের মৃত্যুর চার বছরের পর কিন রাজ্যটির পতন হয়। আমরা ডংজুন গ্রামের সেই ধূমকেতুর ওপর লেখা ভবিষ্যৎবাণীটি স্মরণ করতে পারি ... সম্রাট শি হুয়াং তি মারা যাবে।

আর তার রাজ্য খন্ডিত হবে। চিনা কবি চেন লিন এর কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ: Song: I Watered My Horse at the Long Wall Caves By Chen Lin I watered my horse at the Long Wall caves, water so cold it hurt his bones; I went and spoke to the Long Wall boss: “We're soldiers from Taiyuan— will you keep us here forever?” “Public works go according to schedule— swing your hammer, pitch your voice in with the rest!” A man'd be better off to die in battle than eat his heart out building the Long Wall! The Long Wall—how it winds and winds, winds and winds three thousand li; here on the border, so many strong boys; in the houses back home, so many widows and wives. I sent a letter to my wife: “Better remarry than wait any longer— serve your new mother-in-law with care and sometimes remember the husband you once had.” In answer her letter came to the border: “What nonsense do you write me now? Now when you're in the thick of danger, how could I rest by another man's side?” (He) If you bear a son, don't bring him up! But a daughter - feed her good dried meat. Only you can't see, here by the Long Wall, the bones of the dead men heaped about! (She) I bound up my hair and went to serve you; constant constant was the care of my heart. Too well I know your borderland troubles; and I—can I go on like this much longer? উৎসর্গ: শয়তান।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।