আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’



গুপ্তচরবৃত্তি পৃথিবীর নতুন কোনো বিষয় নয়। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থায় যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, পত্র-পত্রিকা প্রকাশের দ্বার অবারিত থাকে সেখানে বৈরী শক্তির তৎপরতাও চলে গণতান্ত্রিক উদারতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে। তাই রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখার জন্য প্রয়োজন হয় শক্তিশালী গুপ্তচর সংগঠনের। আবার অনেক রাষ্ট্র সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য পরিচালনা করে গুপ্তচরবৃত্তি। ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একটি পারমানবিক শক্তিধর দেশ।

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশও এটি। রিসার্স অ্যান্ড এনালাইসিস উইং বা ‘র’ হচ্ছে দেশটির বৈদেশিক গুপ্তচর সংস্থার নাম। ১৯৬৮ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাী সংস্থাটি গঠন করেন। মাত্র তিন বছরের মাথায় বড় ধরণের সফলতাও পায় সংস্থাটি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে র ব্যাপক ভূমিকা পালন করে সফল হয়।

চার বছরের মাথায় আর এক সফলতার মুখ দেখে সিকিম দখলের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠার পটভূমি র-এর প্রথম সেক্রেটারি ছিলেন রমেশ্বর নাথ কাও। যিনি আত্মীয়-স্বজন ও বুবাবদের কাছে রামজি এবং জুনিয়র কলিগদের কাছে স্যার বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন র-এর প্রতিষ্ঠাতা। কাওকে ইন্দিরা গাী ও তার পিতা জওহরলাল নেহেরু ভালোভাবে চিনতেন।

পেশাগত সততার ব্যাপারে অবহিত ছিলেন বলে তাকে এ সম্মানজনক পদের জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল। এর পেছনে আরো কারণ ছিল। তিনি আইবি’র বৈদেশিক গোয়েন্দা শাখার প্রধান ছিলেন এবং ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব সিকিউরিটির (ডিজিএস) প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। আর এই ডিজিএস সৃষ্টি করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের সহায়তায় সংঘটিত ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পর। ওই যুদ্ধে ভারতীয় গোয়েন্দাদের মধ্যে দক্ষতার যে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল সেটা পূরণ করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছিল রিসার্স অ্যান্ড এনালাইসিস উইং।

সংক্ষেপে আর অ্যান্ড এ ডব্লিউ বা ‘র’। র কোনো তথ্য প্রকাশ করে না র তার গোয়েন্দা তথ্য প্রকাশ করে না। অনেকের সন্দেহ ভারতের ক্ষমতাসীন দলের অনের নীতি নির্ধারকও র-এর প্রকৃত তৎপরতা সম্পর্কে জানেন না। ভারতীয় জনগণতো নয়ই। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এর বার্ষিক বাজেট গোপন রাখা হয়েছে।

এমনকি সংসদেও সংস্থাটির আয়-ব্যয় নিয়ে কোনো আলোচনা করা যায় না। অব্যশ্য সংস্থাটি সম্পর্কে জানার ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে ভারতের জনগণের মধ্যে। উদ্দেশ্য প্রতিবেশী দেশে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা র পার্শবর্তী সব দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনাবলী ও অবস্থান যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত এবং ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতিতে যার প্রভাব অবশ্যম্ভাবী সেদিকে লক্ষ্য রাখে। সংস্থাটি পাশের দেশগুলোতে ভারতের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এসব অঞ্চলে প্রকাশ্য বা পরোক্ষ কোনোরূপ ভারত বিরোধী সম্ভাবনা সৃষ্টির সুযোগ দিতে চায় না। এজন্য সংস্থাটি পণ্ডিত নেহেরুর ‘অখণ্ড ভারত মাতা’র কল্পনাবিলাসকে বাস্তবে রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে।

র ভারত মহাসাগরসহ সমগ্র উপমহাদেশে ভারতীয় সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে কাজ করছে। তথ্যের জন্য দূতাবাসের ছদ্মাবরণ ব্যবহার করে বিদেশে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য সংস্থাটি ভারতীয় দূতাবাসের ছদ্মাবরণ ও কুটনৈতিক সুবিধাকে কাজে লাগায়। যাকে দিয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হয় তিনি সরকারি কর্মকর্তা কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তা হলেও তাকে ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা বলা হয়। এসব কর্মকর্তা হতে পারেন রাষ্ট্রদূত, এ্যাটাশে (সামরিক, নৌ, বিমান), সিভিল এভিয়েশন, বাণিজ্যিক, পেট্রোলিয়াম অথবা কৃষিসহ যেকোনো ক্ষেত্রে কর্মরত। এমনকি দূতাবাসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারিই ইন্টেলিজেন্সের সাথে জড়িত থাকতে পারেন।

কেন্দ্রে তথ্য পাঠানোর জন্য সংস্থাটি ভারতীয় দূতাবাসের এন্টেনার সহায়তা নেয়। সংস্থাটি টার্গেটকে ব্লাকমেইল করে সংস্থাটি বিভিন্ন আকর্ষণীয় মহিলাকে ইন্টেলিজেন্সে নিয়োগ করে দেশে বা বিদেশের টার্গেটকে তাদের মাধ্যমে ব্লাকমেইল করে। এছাড়া একজন ছাত্র, পর্যটক, সাংবাদিক, বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারি, ব্যবসায়ী অথবা একজন শিল্পীকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দানের পর পার্শবর্তী দেশে বিশেষ সময়ে বা স্থায়ীভাবে পাঠায় এই র। সীমান্তে বিএসএফ’র সাথে মিলিতভাবে গুপ্তচরবৃত্তি পরিচালনা করে। টার্গেট দেশের প্রতিভাবান তরুণ-তরুণীদের মাঝে সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, কারিগরী প্রশিক্ষণ প্রদানের আড়ালে ভারতীয় চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটানোয় তৎপর সংস্থাটি।

এছাড়াও ভিডিও ফিল্ম, সাময়িকী, পর্ণো পত্র-পত্রিকা, স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল, রেডিও’র মাধ্যমে সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করা সংস্থাটির নিয়মিত কাজের অংশ। সীমান্তবাসীদের দেয় বিশেষ প্রশিক্ষণ সংস্থাটি ‘বিশেষ কার্যক্রম বিভাগের’ অপারেটিভদের মাধ্যমে ভারতের সীমান্তবাসীদের ছোটখাট যুদ্ধাস্ত্র ও যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়। যাতে কোনো দেশ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে নিজেদের রক্ষা করতে সমর্থ হয় এবং অপারেটরদের সাথে সীমান্ত অতিক্রম করে শত্রম্নর পশ্চাতে সক্রিয় থাকতে পারে। এছাড়া বিচ্ছিন্নতাবাদী ও নাশকতামূলক কাজে টার্গেট দেশের এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেয়া ও প্রয়োজনে নিজ অপারেটিভদের কাজে লাগানো র -এর অন্যতম কাজ। এজন্য অল ইন্ডিয়া রেডিও, দূরদর্শন ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা পরিচালনা করা হয়।

টার্গেট দেশে সরবরাহ করে ভুল তথ্য সংস্থাটির কৌশলের একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হলো রেডিও, টিভি, পত্র-পত্রিকা, গুজব সৃষ্টি, সহযোগী রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ, আন্দোলনের মাধ্যমে ভুল তথ্য উপস্থাপন করা। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে টার্গেট দেশের মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করা, জনমতকে হতবুদ্ধি, বিশৃঙ্খল ও প্রজ্বলিত করা। এক্ষেত্রে টার্গেট দেশে ভুল তথ্য অনুপ্রবেশ করানো হয় যাতে সে দেশের স্বার্থহানি ঘটে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে শত্রম্ন দেশের মানুষকে নিজ দেশের ইচ্ছানুযায়ী কোনো বিশেষ কিছুতে বিশ্বাস করানো। এজন্য টার্গেট দেশে ভুল গোয়েন্দা রিপোর্ট সংবাদ মাধ্যম, কুটনৈতিক চ্যানেল, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও অন্য পেশাজীবীদের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ করানো হয়।

অন্যদিকে সংস্থাটি বিভিন্ন নাশকতামূলক বা অন্তর্ঘাতমূলক কাজ সময়ানুযায়ী টার্গেট দেশে নিজ অপারেটিভ ও এজেন্টদের (টার্গেট দেশের নাগরিক) মাধ্যমে করা হয়। এক্ষেত্রে বিশেষ অপারেশন বিভাগ বিশেষ অপারেশনে প্রচুর নোংরা কাজে জড়িত হয়ে পড়ে। অবশ্য কাজগুলো একজনের কাছে নোংরা কৌশল আবার অন্যজনের কাছে আইনসিদ্ধ ও বৈধ হতে পারে। উল্লেখযোগ্য অপারেশন চীনের বিরুদ্ধে সিআইএ’র সাথে হিমালয়ে ইএলআইএনটি অপারেশন (১৯৬৪)। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৯৭১)।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা। অপারেশন স্মাইলিং বুদ্ধ (১৯৭৪)। সিকিম একত্রীকরণ। পাকিস্তানের প্রধান পারমানবিক কেন্দ্রের ব্লুপ্রিন্ট সংগ্রহ। কানিশকা বোম্বিং কেস (১৯৮৫)।

অপারেশন ক্যাকটাস (১৯৮৮)। শ্রীলঙ্কার তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এলটিটিইকে প্রশিক্ষণ প্রদান। কাশ্মীরে অপারেশন চানাকিয়া। পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বিভিন্ন সহিংসতায় মদদ দান। কারগিল যুদ্ধ (১৯৯৯)।

আফগানিস্তানে মিলিটারি হাসপাতাল পরিচালনা। মায়ানমারে অপারেশন লিচ। ওসামা বিন লাদেনসহ তালেবানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে অংশগ্রহণ। শেষ কথা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাথে রয়েছে র-এর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। সামরিক সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের চুক্তিও হয়েছে।

পারমানবিক বোমার শক্তিধর দেশ ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রেখেই পার্শবর্তী দেশগুলোতে গোয়েন্দা তৎপরতা পরিচালনা করছে। স্বপ্ন দেখছে ইউনাইটেড ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠার। এগিয়েছেও অনেক দূর। সিকিম এখন ভারতের অঙ্গরাজ্য। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনীতি এখন টালমাটাল।

শ্রীলঙ্কায় তামিল টাইগারদের তৎপরতা এখনো অব্যাহত আছে। তবে আশার দিক নেপালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে র সেখানে বড় ধরণের হোচট খেয়েছে। বাংলাদেশে সামরিকবাহিনী না রাখার চেষ্টায় সংস্থাটি সফল হয়নি। র-এর বড় মাথা ব্যাথা নিজ দেশের কাশ্মীর ও পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের স্বাধীনতা আন্দোলন। অর্থনৈতিকভাবে চীনের সাথে মোকাবেলা।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চাচ্ছে এ অঞ্চলে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করার। চীনের সাথে ভারতের বিরোধ হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে সেজন্য কিছুটা সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। ভয় আছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সিআইএর সহায়তায় জঙ্গী তৎপরতা বৃদ্ধিরও। এসব কিছু শেষ পর্যন্ত ইউনাইটেড ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে না ভারত ভেঙে আরো দু’একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম নিবে তা এখন দেখার বিষয়। অবশ্য র তার তৎপরতায় নিয়মিতই কৌশল পরিবর্তন করছে।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.