আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উত্তরাঞ্চলের কৃষিতে দৈত্যের কালো থাবা, অর্থনীতিবিদরা বলছেন ক্যাপিটালিস্ট প্যানিট্রেশন

ভালোবাসি মানুষকে

সেচ ও রবি মৌসুম শুরু হতে এখনও অনেক দেরি, কিন্তু ভূট্টা চাষের জন্য আগাম লিজ হয়ে গেছে উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৮৫ হাজার হেক্টর ধানি ও প্রচলিত চাষাবাদের জমি। দেশি-বিদেশি এনজিও ও ব্যাক্তি বিনিয়োগকারিরা ব্যাপকভাবে পুঁজি লগ্নি করায় ইতিমধ্যে শুধু মাত্র বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলেই ২২ হাজার হেক্টর জমি আধিয়ারি কিংবা বাৎসরিক লিজ হয়ে গেছে। বীজ, সার, সেচ ও নগদ টাকা সহায়তা দেয়ায় লোভনীয় হাতছানিতে আমাদের কৃষকরা এসব বিনিযোগকারিদের হাতে অনায়াসে তুলে দিচ্ছে ধান সহ প্রচলিত চাষাবাদের সোনার জমি। আপাতদৃষ্টিতে চরাঞ্চলে কৃষির বাণিজ্যকরণ ও কৃষকরা সাময়িক লাভবান হলেও কৃষিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশবাদীরা জানাচ্ছে, চিরায়ত ও প্রচলিত পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষকরা যেভাবে জমির উপরিভাগ রক্ষা করে চরাঞ্চলে আবাসন তৈরি করতো, এখন অপ্রচলিত ও ব্যাপক চাষাবাদের কারনে মাটির উপরিভাগ বা ‘টপ সয়েল’ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কমে আসবে ধান চাষের জমি।

বিঘ্নিত হবে বসতি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া। চরে যে ফসলের বৈচিত্র ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য তাও নষ্ট হবে। কৃষক জমির মালিক থাকবে ঠিকই, পারবে না ফসল ফলাতে। কৃষি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ µgvš^‡q চলে যাবে ga¨¯^Z¡‡fvMx ফাটকা ব্যবসায়ীদের হাতে। ব্যবসায়ী এইসব খামারিদের সাথে ফসল ফলানোর অসম প্রতিযোগীতায় আসল কৃষক টিকে থাকতে পারবে না।

µgvš^‡q তারা হারাবে চাষাবাদের তহবীল আর তাদের জমি। এক পর্যায়ে জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পরিণত হবে ক্ষেতমজুর কিংবা সর্বহারায়। যেমন করে সাঁওতালরা হারিয়েছিলো বন ও জঙ্গলের অধিকার। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের চরবাগুয়া গ্রামের হায়দার আলী। পেশায় কৃষক।

তার চরের জমিতে ধান, বুট, খেসারি, কাউন, চিনা, ধনিয়া, মৌরি, মিষ্টি আলু, বাদাম, লাউ, কুমড়া, বেগুন, কলা সহ নানা জাতের দেশি ফসল বুনতো সে। তা দিয়ে মঙ্গা ও আপদকালিন সময় মোকাবেলা করতো। এ চাষাবাদের জন্য তাকে সারের জন্য ধরনা দিতে হতো। কখনো বা চড়া দামে কিনে লোকসানও গুনতে হয়েছে। এখন সে এই ঝামেলা থেকে মুক্ত।

আগামি আউশ মৌসুমে তার জমিতে আর ধান বা কোনো ফসলেরই চাষাবাদ করবেন না তিনি। সেই মৌসুমে তার হাতে থাকবে কড়কড়ে টাকা। তার জমি লিজ নিয়েছে নাটোরের এক ভূট্টা ব্যবসায়ি। তারাই এখন চাষাবাদ করবে। হায়দার আলী জমি লিজ দিতে পেরে খুবই খুশী ছিলো।

কিন্তু আগামিতে এই জমি তার আর নাও থাকতে পারে কৃষি আন্দোলনের কর্মীরা তাকে বোঝানোর পর এখন সে তার ভূল বুঝতে পারছে। লালমনিরহাট জেলার চিত্রটা আরো প্রকট। কাঁধে লাঙ্গল জোয়াল, হাতে ধরা হালের বলদের দড়ি- গ্রামবাংলার এ চিরায়ত দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। হাজার হাজার একর জমি ভূট্টা চাষের জন্য লিজ হয়ে গেছে। মৌসুম এলেই জমিতে চলে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার।

সেচ যন্ত্রের ঘট ঘট আওয়াজে প্রকম্পিত হয় কৃষকের খুলি। জমি আছে ঠিকই, বদলে গেছে চাষি। সে নিজে চাষ করে না। জমির ভাড়া গোনে। খালি পড়ে থাকে কৃষকের ধানের গোলা।

এভাবেই এ অঞ্চলের কৃষি ও চাষ ব্যাবস্থা চলে গেছে ফাটকা ব্যবসায়ীদের হাতে। পাটগ্রাম উপজেলার কৃষক নুরুদ্দীন মিঞা জানান, সে পাঁচবছর আগে জমি লিজ দিয়েছিলো ঢাকা থেকে আসা জয়নাল নামের এক ব্যাবসায়ীর কাছে। তিন বছর ভালো লাভ করেছিলেন ভূট্টা চাষ করে জয়নাল। কিন্তু তৃতীয় বছরে যখন লোকসান গুনলেন তখন লিজ বাতিল করে চলে গেলেন। তার পরের বছর নুরু মিঞা নিজে ধান বুনলেন ধান ভালো হলো না।

তাকেও রোকসান গুনতে হলো। তিনি কৃষি বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, যে জমিতে ভূট্টা চাষ হয় সে জমিতে ধান কিংবা প্রচলিত ফসল ভালো হয় না। এছাড়া ভূট্টা চাষে অধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় জন্য জমির উবরতা কমে যায়। এরপর তিনি তার ৬৩ শতাংশ জমি ঢাকার ভূট্টা ব্যবসায়ী ওয়াসিউল ইসলামের কাছে বিক্রি করে দেন। জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে এখন তিনি হাটে হাটে কাঁচামালের চটি দোকান করেন।

আর তার মতো অনেকেই লোভে পড়ে ভূট্টা চাষের জন্য জমি লিজ দিয়ে সর্বশান্ত হয়েছেন বলে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান। সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের তালপট্টির চর, মধ্যচর, কুঠিপাড়া, রাজপুর ইউনিয়নের চিনাতলী, ভূতনাথ ও আরজি চিনাতলী চরেও একই চিত্র দেখা গেলো। তালপট্টির চরের জামাল উদ্দিন জানান তিনি সহ এ গ্রামের অনেকেই গত আলু ও ভূট্টা মৌসুমে শতাধিক একর জমি লিজ দিয়েছিলেন। বাম্পার ফলন হলেও তাদের ভাগ্যে লিজের টাকা ছাড়া অন্য কিছুই জোটেনি। উল্লেখ্য, এসব এলাকায় মৌসুমে প্রতি একর জমি ৪শ’ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা পর্যন্ত লিজ দেয়া হয়ে থাকে।

এভাবেই উত্তরের কৃষিতে ফাটকা পুঁজির প্রসার ঘটছে। চাষীরা চাষাবাদ থেকে ক্রমেই উচ্ছেদ হচ্ছে। কৃষি ও তার বাজার ব্যাবস্থার নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ী ও কথিত খামারিদের হাতে। এদিকে, জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ সম্পর্কে ঢাকার ব্যবসায়ি জুনায়েদ সিদ্দিকী জানান, তিনি তার এক বন্ধুর কাছ থেকে এই পদ্ধতিতে চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। ওই বন্ধু পঞ্চগড় জেলায় বিস্তির্ণ এলাকা লিজ নিয়ে ভূট্টা ও বাউকুল চাষ শুরু করেছেন।

এ ব্যবসায় লাভ ভালো হয়, পাশাপাশি ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা ঋণ পাওয়া যায়। এ কারণে তিনি এবার রালমনিরহাট জেলার বুড়িমারিতে ৩০ একর জমি লিজ নিয়েছেন আগামি মৌসুমে ভূট্টা চাষ করার জন্য। অন্যদিকে, দেশের বিশিষ্ঠ পরিবেশবাদী, দেশী বীজ সংরক্ষণকারিপ্রতিষ্ঠান, নয়াকৃষি আন্দোলন ও উন্নয়ন বিকল্প নীতি নির্ধারনী গবেষণা কেন্দ্র ( উবিনীগ ) এর পরিচালক ফরহাদ মজহার এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রকৃতির হাতে যার সৃষ্ঠি মানুষের হাতে তার মৃত্যু। নদীর উৎস মূখে অপরিকল্পিত বাধ দিয়ে যেমন প্রকৃতিকে বাধাগ্রস্থ করা হয়েছে, মৃত্যু ঘটানো নদীর। ঠিক তেমনি চরে অপরিকল্পিত ও অপ্রচলিত চাষ করে চরের আবাসন ক্ষতিগ্রস্থ করা হচ্ছে।

যেনো ঈশ্বরের উপড় খবরদারি। চরের মাটির উপরিভাগ বা ‘টপ সয়েল’ নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। ভূট্টা চাষের নামে করা হচ্ছে বিষের চাষ। ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক কীটনাশক। নষ্ট করা হচ্ছে জমির ¯^vfvweK উবরতা ও পরাগায়ন।

সেই সাথে যে প্রচলিত খাদ্য উৎপাদন করে চরের মানুষজন তাদের আপদকালিন সময় বা মঙ্গা মোকাবেলা করে আসছে এ অবস্থায় তা আর করতে পারবে না। হারিয়ে যাবে দেশী এসব ফসলের বীজ। কৃষিতে ফাটকা পঁজির বিকাশ ঘটায় কৃষকরা হারাবে তাদের চাষের অধিকার। ব্যবসায়ি খামারিদের হাতে চলে কৃষির নিয়ন্ত্রণ ও বাজার ব্যবস্থা। আপাতঃদৃষ্টিতে কৃষিতে কৃষক বিহীন পুঁজির এই বিকাশ দৃশ্যমাণ হলেও এর বিরুপ প্রভাবে কৃষকরা ক্রমশঃ ভিটেমাটি হারিয়ে পরিণত হবে ছিন্নমূল মানুষ বা সর্বহারায়।

যা কোনো ক্রমেই মানা যায় না। দেশের বিশিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান জানান, ‘পৃথিবীর অনেক দেশের কৃষিতে এ অবস্থার সৃষ্ঠি হয়েছে। আমাদের দেশে হচ্ছে দেরিতে। এ ঘটনাকে তিনি ‘ক্যাপিটালিষ্ট প্যানিট্রেশন’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন এ পরিস্থিতিতে দেশের কৃষি এবং কৃষকদের মাঝে অনেক ভাঙ্গাগড়ার খেলা হবে।

বিভাজন সৃষ্ঠি হবে। এই ভাঙ্গা গড়ার খেলায় কৃষকদের একটি বিশাল অংশ নিঃস্ব হবে। এটাই পুঁজিবাদের ধর্ম। এ থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায়, কৃষকদের সমবায় ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলে চাষাবাদ শুরু করা। কিন্তু আমাদের কৃষকরা এমনিতেই অর্থের অভাবে সঠিকভাবে চাষাবাদ করতে পারেনা।

তাদের কোমর ভাঙ্গা। তাই ফাটকা পুঁজির কাছে তাদের পরাস্ত হতেই হবে। এমূহুর্তে এটাই নিয়তি’ বলে তিনি মন্তব্য করেন। অর.ডি.আর.এস নামের একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত বিশিষ্ঠ কৃষিবিদ ও গবেষক মৃন্ময় গুহ নিয়োগী জানান, ভুট্টা চাষ আমাদের দেশের জমি ও বর্তমাণ খাদ্য ঘাটতির এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিকর। ক্ষতিকর এ জন্যই ভূট্টা সাধারণত পতিত কিংবা এক ফসলি জমিতে চাষযোগ্য একটি সার খেকো ফসল।

দোফসলি জমিতে চাষ করলে মাটির উর্বরত কমে যাবে পরবর্তিতে ধান কিংবা অন্য ফসল চাষ করতে গেলে ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দেবে। তখন প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে ফসলের ¯^vfvweK বেড়ে ওঠা ধরে রাখতে হবে। এছাড়াও এ চাষে অধিক কীট নাশক ব্যবহারের কারনে ওই সময় যখন ভূট্টা গাছে ফুল আসবে তখন ওই ফুলে প্রজাপতি, মথ, ফড়িং জাতিয় কীট মধু বা খাদ্য আহরণের জন্য এলে কীটনাশকের কারণে তা মারা যাবে। একারনে ওই এরাকায় লাউ, কুমড়া, সহ নানান জাতের শাক সব্জির পরাগয়ন বিলম্বে ঘটবে। কেননা এই ধরনের কীট এক ফুল থেকে অন্য ফুলে বসতে না পারলে পরাগায়ন সম্ভব হবে না।

তিনি জমি লিজ প্রথার বিরোধিতা করে বলেন, কৃষকরা যাতে তাদের জমিতে চাষাবাদ করতে পারে এজন্য তাদেরকে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে। কৃষকরা যাতে জমি লিজ না দেয় সে ব্যপারে তাদের নিরুৎসাহিত করতে হবে। এটাই এখন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাজ হওয়া উচিত। কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর ও বিভিন্ন এনজিও’র সূত্রগুলো জানাচ্ছে, উত্তরের ১৬ জেলার চরাঞ্চলে এক ও দো ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ২ লাখ হেক্টর। বিশাল এই জমির ৮০ থেকে ৮৫ভাগ বিভিন্ন ধরণের দেশী জাতের ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে।

কিন্তু গত ৫/৬ বছর থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ি এসব জমি লিজ নিয়ে ভূট্টা চাষ করে আসছে। এ চাষাবাদে সহযোগীতা করে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইনরক ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি কোম্পানি, দেশী এনজিও ব্রাক সহ ছোটো বড় বিভিন্ন বেসরকারি বীজ উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান। সুত্র মতে, আগামি সেচ মৌসুমে ( রবি মৌসুম ) ভূট্টাসহ বিভিন্ন চাষের জন্য আগাম লিজ হয়ে গেছে প্রায় ৮৫ হাজার হেক্টর জমি। এর মধ্যে বৃহত্তর রংপুরের নীলফামারি, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলায় আগাম লিজ হয়ে গেছে ২২ হাজার হেক্টর জমি। ##


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.