আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাত্তি বাঁশের কঞ্চি

soroishwarja@yahoo.com

[নিজের লেখা গল্প] আবাত্তি বাঁশের কঞ্চি নয় রে, বাত্তি বাঁশের কঞ্চি। লালচে, চিকন ও লকলকে। পিঠে লাগলে যার পিঠ সে-ই টের পায়। শপাং শপাং বাতাস কেটে লাউডুগি সাপের মতো পিঠ পেঁচিয়ে ধরে। পেঁচ খুললেও পিঠে ফেলে যায় কালশিটে।

চ্ইুয়ে বেরিয়ে আসা লাল রক্তের শিশির জমে সে-ই কালশিটে বরাবর। আবাত্তি বাঁশের কঞ্চির এত তেজ নাই। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় হয় ঠিকই, কিন্তু দড় কঞ্চি তো আর চামড়ায় বিষদাঁত ফুটাতে পারে না। মোটা কঞ্চি মোটা বুদ্ধির মানুষের মতোই। মাথা ফাটানো যাবে, মাগার হুল ফুটানো যাবে না।

বাত্তি কঞ্চি দিয়ে বড়শির ছিপ, লাউ-কুমড়ার মাচা, চুলার আগুনÑ এ রকম কতকিছ্ইু হয়। কাউকে পেটানোর জন্য বাত্তি কঞ্চির ব্যবহার তো অপব্যবহার। এটাকে হিসেবে আনা যায় না। মাক্কু মিয়ার বাপ-মা দুজনেই বাত্তি বাঁশ। বাপের চল্লিশে আর মায়ের তিরিশে জন্ম হওয়ায় মাক্কু নিজেও বাত্তি বাঁশের কঞ্চি।

মাক্কুর পোলাটাকে অবশ্য পাকাপাকি বাত্তি কঞ্চি বলা যাবে না। বিয়ের বছর না ঘুরতেই পোলাটা হয়ে গেছে। তখন মাক্কুর পঁচিশ আর তার বৌয়ের মাত্র বিশ। তবে পোলারও বাত্তি কঞ্চির প্রতি দারুণ টান। বাপের একেবারে নেওটা।

পোলাটার নাম সাদেক। এই নামটা রেখেছেন কোরবান চাচা। বড়শির ছিপ বানাতে বাত্তি বাঁশের একটা কঞ্চির জন্য সাদেক কয়েক দিন ধরে মাক্কুর মাথাটা খেয়ে ফেলছে। পোলায় ছিপ বানানোর কঞ্চি চায় আর পোলার মা শাড়ির আঁচল কামড়ে ধরে মুচকি মুচকি হাসে। আজ সকাল বেলায় দেখেÑ সাদেক ঠিকই একটা বড়শির ছিপ জোগাড় করে নিয়েছে।

ঘুম থেকে উঠে মাক্কু গিয়েছিল গোয়ালের দিকে আর তার বৌ গিয়েছিল কলসি নিয়ে পাশের বাড়ির দিকে। পোলা তখন ছিপ-বড়শি নিয়ে বিলের দিকে। বড়শি নিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে যেতে দেখেও মাক্কু তাকে কিছু বলে না। বৌ নিশ্চয়ই ছিপটা জোগাড় করে দিয়েছে। পোলা তো আর জানে না যে ছিপ বানানোর মতো বাত্তি বাশের লকলকে কঞ্চি কেটে আনা তার বাপের পে সম্ভব নয়, কিন্তু পোলার মা তা ঠিকই জানে।

সাদেক কয়েক দিন ধরে ঘ্যানঘেন করেও মাক্কুর কাছ থেকে ছিপ বানানোর একটা কঞ্চি পেল না। অথচ কেমন কপাল দেখ! সকালে ঘুম থেকে উঠে আজকেও তাকে এসে ঢুকতে হল লকলকে কঞ্চিতে ভরা একটা বাঁশঝাড়ে। তাকে অবশ্য বাঁশ কাটতে হচ্ছে না, কিন্তু তাতে কি! কামলাদের সঙ্গে বাঁশঝাড়ে দাঁড়িয়ে তো থাকতে হচ্ছে। ঠিকমতো দাঁড়িয়েই বা সে থাকতে পারছে কই! খালি আবোলতাবোল মনে পড়ছে আর পিঠটা শিরশির করছে। থেকে থেকেই মাক্কুর মনে হচ্ছেÑ এই বুঝি একটা বাঁশোয়া সাপ তার পিঠ বেয়ে নেমে গেল! এই বুঝি পিঠ বেয়ে নেমে গেল একটা লাউডুগি সাপ! মনে হতেই তার আত্মা ছাঁৎ করে উঠছে, হাত চলে যাচ্ছে পিঠে, গেঞ্জির নিচে সেই কাল্পনিক সাপের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার হাত।

এসব কতণ আর অন্যদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা যায়? ধরা সে পড়েই গেল। তারা মিয়ার পুংটা পোলা চান্দুর চোখ কোনোকিছুই সহজে এড়ায় না। Ñ‘কী রে মাক্কু ভাই, শইল্যে কি চুত্রাপাতার ঘষা লাগছে না কি?’ Ñ‘না রে, চুত্রাপাতার ঘষা শইল্যে লাগে নাই, লাগছে মনে। ’ চান্দুর চোখে ধরা পড়ার আগে নিজের ছটফটানির ব্যাপারটা আড়াল করতে কোমরের কোচা থেকে একটা বিড়ি আর ম্যাচ বের করে ফস করে আগুন ধরিয়ে নেয় মাক্কু। বেশ কায়দা করে কষে একটা টান দিয়ে কথা ঘুরিয়ে নেয় সে।

Ñ‘চান্দু রে, ভাবতাছি, এই যে বাশ, এই অত অত বাশ নতুন ওঠা কোনো ভবনের ছাদে ঠেকনা দিতে যাইব। ইট, রড আর সিমেন্টের গাথ্নি শক্ত না অওয়া পর্যন্ত এই বাশগুলান মিল্যামিশ্যা আস্তা একটা ছাদ মাথায় লয়া দাড়ায়া থাকব। ছাদের ঢালাই মজবুত অয়া গেলে বাশের আর দরকার নাই। মজবুত ছাদ দেইখা তখন বাশের কথা কেউ আর মনেই করব না। চান্দুর দেখাদেখি মজিদও বাঁশ কাটা থামিয়ে কুড়ালটা হাতে নিয়েই কাছে এসে দাঁড়ায়।

কুড়ালের ধারালো প্রান্ত দিয়ে ঘামে ভেজা পেটটা চুলকাতে চুলকাতে বলে: ‘মাক্কু ভাই, তোমার তিরিংবিড়িং দেইখা মনে পড়ল, তুমি এক সময় যাত্রা দলে আছিলা। তা একটু ঘাটু নাইচ দেহাইবা নাকি। Ñ‘আর তোর নাইচ, মনে ফুর্তি নাই। ’ তার কথায় চান্দুও আপত্তি করে বলে: ‘এই যে কইলা একটা কথা, তোমার মনে ফুর্তি নাই। জঙ্গলে আইলে দেখি খালি তিড়িবিড়ি কইরা নাচো।

হেরপরেও কও, মনে ফুর্তি নাই। ’ Ñ‘আরে ধুর! আমি কি রঙ্গে নাচি নাকি। জঙ্গলে ঢুকলেই খালি আমার শইল খাউজায়। ’ Ñ‘মাক্কু ভাই, তোমার লগে লগে তোমার শইলও বড়লোক অয়া যাইতাছে। ’ Ñ‘চাইন্দা, তুই খালি সোজা কথারে তেরা করছ্।

তোর এই তেরা স্বভাবটা আর গেল না। ’ চান্দুর প নিয়ে মজিদ বলে: ‘তেরা করত না! তোমারে কইলাম, একটা নাইচ দেখাও। তুমি তো দেহাইলা না। ’ Ñ‘তোর মন চাইলে তুই নাচতে থাক। অত কেচাল করিছ্ না।

হালার পুত, আমার তো মনে কয়, আমি না, তুইই ঘাটু আছিলে। খালি নাইচের আর গানের কুড়কুড়ানি। পাছার মধ্যে তেল বেশি জইমা গেছে, না?’ Ñ‘হ, বেশি জইমা গেছে, একটু খসায় লই। এই রইল কুড়াল। বাদ দিলাম বাশ কাটা।

আগে একটু নাইচা লই। ’ মোটা শরীর আর মোটা পাছা দুলিয়ে সত্যিই নাচ শুরু করে মজিদ। কালকে যে গানটা গেয়েছিল মাক্কুÑ গাঙ্গের পারে ছেরা কাইশ্যার ফুল/ যাইত্যা মারলে ছেড়া আমার কুল/ ছাইর‌্যা দেরে ছেরা ঝাইর‌্যা বান্ধি চুল। গানটা গাইতে গাইতে তালে তালে হাত-পা ও চোখ-মুখ নাচায় মজিদ। এ সময় মাক্কুর নাম ধরে কাউকে ডাকতে শুনে গান থামিয়ে কান পাতে সবাই।

হ্যাঁ, স্পষ্টতই মাক্কুকে কেউ ডাকছে। জঙ্গলের পাশের রাস্তার দিক থেকে ডাকটা আসছে। সেদিকে একটু এগিয়ে এসে ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় মাক্কু। মাসুম ভাই মোটর সাইকেলের ওপর থেকে রাস্তার ওপর একটা পা রেখে তাকেই ডাকছে। দৌড়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে, কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছার আগেই মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে দেয় মাসুম।

যন্ত্রটার শব্দের ভেতর থেকে মাসুম গলা উঁচিয়ে বলে: ‘মাক্কু ভাই, চান্দু আর মজিদরে কাজ বোঝায়া দিয়া একটু বাড়িতে যাও। বাবা তোমারে ডাকতাছে। ’ চাচার ডাক পেয়ে বড় বাঁচা বেঁচে যায় মাক্কু। বাঁশঝাড়ের এই অস্বস্তি থেকে বের হওয়ার এমন সুযোগে সে বেশ খুশিই হয়। বের হতে গিয়ে চুত্রাপাতার ঝোপের কথা তার মনেই থাকে না।

বাড়িতে এসে দেখে চাচা একাই বেরিয়ে গেছেন। চাচি আছেন তার অপোয়। তাকে সামনে পেয়ে চাচি এক দমেই সব বলতে থাকেন: ‘মাক্কু, বাজান, শিগগির যা। তোর চাচা ঘাটের দিকে গেছে। মাসুম কইছিল ঠেলাগাড়ি দিয়া যাইতে।

তোর চাচার তো আবার ফুটানি। ঠেলাগাড়িতে হাসপাতালে গেলে নাকি তার ইজ্জত থাকে না। মরার সময়ও ইজ্জতের জ্ঞান টনটনা। যেমুন বাপ, হেমুন পুত। দুইজনই সমান ঘাউড়া।

মাসুম ফালায়া থয়া গেছে গা। তোর চাচাও লেংড়ায়া লেংড়ায়া যাইতাছে। গাঙটা পার কইরা রিকসায় বসায়া লইয়া যা। আইজকা তো আবার সেলাই খুলনের কথা। তাড়াতাড়ি যা বাপ!’ এই একটা কাজই কোরবান চাচা পারলেন না।

লোকমান হাকিম যেমন জানতেন কোন গাছের কী গুণ, কোরবান চাচাও তেমন জানেন কোন মানুষের সাথে কী ব্যবহার। বাপের কালের বেত নয়, কুত্তা বিলাই খেদানোর লাঠি নয়, বলদ পেটানোর হালের শলাও নয়Ñ মাক্কুকে শায়েস্তা করতে বাত্তি বাশের কয়েকটা কঞ্চিকে কাজে লাগিয়ে ছিলেন তিনি। যে রোগের দওয়াই। কিন্তু কোনো ওষুধেই নিজের পোলার একরোখামির অসুখ সারাতে পারলেন না তিনি। লোহা দিয়ে লোহা পেটালে আগুনের ফুলকি ছোটে।

বাত্তি বাপ-মায়ের বাত্তি পোলাকে বাত্তি কঞ্চি দিয়ে পেটালেই তো লাল রক্তের আগুনের ফুলকি বের হবে। চাচা তা-ই করেছিলেন। তবে সবার সামনে নেংটা করে দাঁড় করিয়ে পিঠে ও পাছায় আচ্ছামতো পেটাতে থাকলে যে বাত্তি কঞ্চিও ভেঙে খানখান হয়ে যাবে তা বোধ হয় চাচা জানতেন না। সেদিন কেমন ভালো মানুষের মতো মুখ করে মাক্কুকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে তামাক সাজাতে বললেন। সে-ও লাফাতে লাফাতে রান্নাঘরের দিকে গেল।

চুলার আগুনে টিকিয়াটা ধরিয়ে নিয়ে এ-হাত ও-হাত করতে করতে আর ফুঁ দিতে দিতে নাচতে নাচতে নিয়ে এল। জ্বলন্ত টিকিয়া হাতে নেওয়ার বাহাদুরিতে সে তখনও টগবগ করছে। হুক্কার কল্কিতে টিকিয়াটা বসিয়ে দিয়েছে। ফরসি হুক্কার নলটা গামছায় মুছে চাচার দিকে বাড়িয়ে ধরেছে প্রতিদিনের মতোই। চাচা হুক্কার নলে কয়েকটা দম দিয়ে একমুখ ধোঁয়া উগলে বললেন: ‘যা, এইবার বাত্তি দেইখা কয়েকটা কঞ্চি লয়া।

চিকন আর লকলইকা দেইখা আনিছ্। ’ চাচার বলতেই যা দেরি, মাক্কুর আনতে তত দেরি নাই। কঞ্চিগুলো হাতে নিয়ে নাড়িয়ে-চাড়িয়ে পরখ করেন চাচা। তারপর ফরসির নলটা বসার জলচৌকিটার ওপর রেখে উঠে দাঁড়ান। মাক্কুকে বলেন: ‘লুঙ্গি আর গেঞ্জিটা খুইলা ফালা তো বাপজান।

’ মাক্কুকে যেন জাদু করা হয়েছে। সে দৌড় দিতে পারল না, কোনো কথাও বলতে পারল না। চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের শরীর থেকে লুঙ্গি ও গেঞ্জিটা খুলে ফেলল। বারো কি তেরো বছর আগের সেই রোদে ভাজা দুপুর আজও একই রকম। এখনো চৈত্রের গাঙে সেই একই রকম জোড়া বাঁশের সাঁকো।

তবে এখন আর সাঁকো ভেঙে যাওয়ার দিনগুলোতে মাসুম ভাইকে কাঁধে তুলে নদী পার করে স্কুলে দিয়ে আসতে হয় না। মাক্কুর এখন বৌ-বাচ্চা, গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি আছে। বাড়ির ভিটের লাগোয়া জমিতে আছে শাক-সব্জির চাষ। এসবই হয়েছে চাচার দয়ায়। কোরবান চাচাও এখন আর হুক্কা টানেন না, টানেন বেনসন সিগারেট।

চাচার দেওয়া সিগারেটের পাছা ও লুকিয়ে-চুরিয়ে দুয়েকটা আস্ত সিগারেট টানার সুযোগও আছে তার। যে কারণে দামি সিগারেটের স্বাদ তার জানা। চাচা আগে রিক্সায় চড়তেন, এখন চড়েন মোটর সাইকেলে। মোটর সাইকেলে চড়তে কেমন লাগেÑ মাক্কু এখন তা-ও জানে। চাচা কিংবা মাসুম ভাইয়ের সঙ্গে মোটর সাইকেলের পিছে তাকে প্রায়ই উঠতে হয়।

এতকিছুর পর তো আর নদী পার হওয়ার জন্য ফটো মাঝির পুত খেমোর পিঠে চাচাকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। ফটোর বাচ্চা খেমো শালা কেমন বেহায়া দেখো! ঘোড়ার মতো দাঁত কেলিয়ে বেহায়াটা চাচাকে পিঠে তুলে নিতে আসে। খেমো রে খেমো, গায়ে তোর তাগরাই না হয় একটু বেশি, তাই বলে বাড়ির লোক পোষা ঘোড়া হাজির থাকতে তুই এসে পিঠ পেতে দিবি। মাক্কুর ইজ্জতের ওপর হামলা! কত বড় সাহস! খেমোর প্রতি মাক্কুর রাগটা একদম দপ করে নিভে যায় একজনকে এগিয়ে আসতে দেখে। সেটা ঝুমা।

কোরবান চাচার একমাত্র মেয়ে। ঝুমার হাতে চাচার ক্র্যাচ আর হাতব্যাগটা ধরিয়ে দিতে দিতে সে জিজ্ঞেস করে: ‘তুমি কহন আইছ ঝুমা আপা?’ Ñ‘আমি আইছি মাত্রই। আইয়াই হুনি, তোমরা রওনা হইয়া গেছ। পোলাটারে খালি আম্মার কোলে রাইখাই দিলাম দৌড়। ’ হাঁপাতে হাঁপাতেও কত সহজে ঝুমা মাক্কুর সাথে কথা বলে, কিন্তু মাক্কু আজও ঝুমার সামনে সহজ হতে পারে না।

ঝুমা ও মাসুম তার চেয়ে বয়সে ছোট হলেও সে তাদের আপা ও ভাই বলে ডাকে। Ñ‘নিতে পারবা তো মাক্কু ভাই? দেইখো, মাধ্যি গাঙ্গে ফালায়া দিয়া শেষে একটা কেলেঙ্কারি ঘটাইয়ো না। খেমো, তুইও লগে লগে যা। ’ কেলেঙ্কারি মাক্কু একবারই ঘটিয়েছে, দ্বিতীয়বার আর ঘটাবে না। বহু বছর আগের সেই কেলেঙ্কারির কথাটা ঝুমাকে দেখলেই তার মনে পড়ে যায়।

মনে পড়ে যাওয়া সেই ঘটনা থেকে মন সরিয়ে নিতেই মাক্কু দ্রুত লুঙ্গির কাছা কষে নেয়। কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে চাচার লুঙ্গির কাছাটাও কষে দিয়ে সামনে এসে উবু হয়ে পিঠ পাতে। চাচা এক হাতে তার গলা পেঁচিয়ে ধরে পিঠের ওপর শরীরের ভার ছেড়ে দেন। খেমোও নিজের কাছাটা কষিয়ে নিয়ে হাত লাগায়। শেষপর্যন্ত খেমোর কপালে জুটে চাচার ভাঙা পা আর এক জোড়া ক্র্যাচ।

ক্র্যাচ দুইটা এক বাহুর বগলের চিপায় নিয়ে অন্য হাতে চাচার ছড়ানো ভাঙা পায়ের ভার রেখে খেমো সামনে সামনে হাঁটে। সবকিছু ঠিকঠাক দেখে নিয়ে পানির দিকে পা বাড়ায় মাক্কু ও খেমো। স্বস্তি নিয়ে সাঁকোর দিকে পা বাড়ায় ঝুমা। বাবাকে নিয়ে মাক্কুদের গাঙ পার হওয়া দেখতে দেখতে সে-ও সাঁকো পার হয়। চাচা প্লাস্টারে পেঁচানো ভাঙা হাতটা মাক্কুর একটা কাঁধে ফেলে সামনে ছড়িয়ে রাখেন।

ভাঙা পা-টাও মাক্কুর কোমরের পাশ দিয়ে সামনে ছড়ানো। একটা হাত ও একটা পা প্লাস্টারে জড়ানো থাকলেও অন্য হাত ও পা একেবারে উদাম। চাচার খুব লজ্জা লজ্জা লাগে। খোলা হাত-পা, মেলে রাখা হাত-পায়ের কারণে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। মনের এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতেই চাচা সিকান্দার বাদশার কথা মনে করেন।

সাত মুলুকের বাদশাহ সিকান্দারকেও খালি হাতেই কবরে যেতে হয়েছে, তা বোঝাতেই বাদশা মরার আগে অছিয়ত করে গিয়েছিলেন, মরার পর তার হাত কাফনের বাইরে রাখতে। ঝাঝা দুপুরের রোদে গাঙের পার পর্যন্ত হেঁটে আসায় মাক্কুর পিঠে উঠার পরও দরদরিয়ে ঘামতে থাকেন কোরবান চাচা। অন্যের পিঠে সওয়ার হয়ে বেকায়দা অবস্থায় গাঙ পার হওয়ার মধ্যে পড়ে যাওয়ার ভয় তো আছেই; তার ওপর গত কয়েক দিন ধরে একটানা শুয়ে-বসে থাকতে থাকতেও শরীরটা কেমন ভেতরে ভেতরে পানসে হয়ে গেছে। এসব কারণে শরীরে যে ঘামের মাত্রাই শুধু বেড়েছে তা কিন্তু নয়, লিঙ্গ আর বিচিগুলোতেও সেই টানটান ব্যাপারটা নাই। মাক্কুর পিঠের দাঁড়ার শেষ মাথায় লিঙ্গটা কাত হয়ে পড়ে দুইজনের শরীরের চাপে আটকে থাকলেও ঝুলে পড়া বিচিগুলো মাক্কুর পাছার ওপর বেমক্কা ঘষা খাচ্ছে।

মাক্কুর পিঠের ওপর শরীর বিছিয়ে রেখেও এ কারণেই চাচা তেমন একটা স্বস্তি পাচ্ছেন না। পানির ওপরে চলে আসায় এখন আর হুট করে নেমে যাওয়ারও উপায় নাই। পিঠের ওপর শরীরের ভার রেখে মনে মনে উসখুস করতে করতেই মনে পড়ে যায় হিজড়া দলের সেই গানটা। মনে পড়ার অন্য একটা কারণও আছে। কোরবান চাচার পনেরোÑষোলো গাছের একটা লিচু বাগান আছে।

লিচু পেকে টুকটুকে লাল হওয়ার আগেই থোকাগুলো জালে জড়িয়ে রাখতে হয়। এতে পাখপাখালি ও বাদুড়ের উৎপাত থেকেও রেহাই মেলে, আবার বোঁটা থেকে খসে যাওয়া লিচু মাটিতে পড়ে নষ্ট হওয়ার ভয়ও থাকে না। ঝুলে পড়া বিচিগুলোকেও কোরবান চাচার বোঁটা খসা লিচুর মতোই মনে হয়। কিন্তু এ কি! হিজড়া দলের সুন্দরীটা যে গান গাইতে গাইতে তাঁর চোখের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে! ‘কে দিল পিরিতের বেড়া লিচুর বাগানে?/ লিচুর বাগান নয় গো, কমলার বাগানে। /’ একদিন তাঁর লিচুতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে যে সুন্দরী হিজরাটা এই গান গেয়েছিল সে যেন দূরের ধুধু করা গাঙের বাঁক থেকে উঠে এসে তাঁর চোখে ঢুকে গেছে।

এখন তিনি তাকে একেবারে নিজের চোখের ভেতর দেখতে পাচ্ছেন। মাক্কুর পাছার ওপর বোঁটা খসা লিচুর ঘষায় তার চোখ, মুখ, হাসি, কান্না, অঙ্গভঙ্গিÑ সব এমন ঝকঝকে হয়ে উঠল কী করে? হিজড়াটার সেই নানান রংঢংয়ের পথ ধরে আরও যা যা মনে পড়ে তাতে কোরবান চাচার বেশ শরম শরম লাগে। সেসব তিনি আর ভুলেও মনে করতে চান না। তারপরও একে একে মনে পড়তে থাকে: প্রথমে যাত্রা দলে শিশুশিল্পী ও পরে নায়িকার চরিত্র করত মাক্কু। মেয়েলি সুরেলা গলা আর মুখের গড়ন সুন্দর হওয়ায় বুকে নারকেলের মালা বেঁধে নায়িকা সাজলে মাক্কুকে বেশ দেখাত।

দলে যখন মেয়ে এল তখন মাক্কুকে ফরমায়েশ খাটার কাজে লাগিয়ে দিলেন চাচা। মাঝে মাঝেই মাক্কু তাঁর শরীর টিপেটুপে দিত। সবাই শরীর টেপার ব্যাপারটুকুই জানত, কোরবান চাচা জানতেন বিশেষ অঙ্গের আরামের জন্যই তাঁর এই শরীর টেপার আয়োজন। যে মাক্কু তার শরীরের সকল অঙ্গপতঙ্গের খবর জানে তার পিঠে চড়ে এত অস্বস্তি, এত শরম ও সংকোচ কেন? মনের শরমে মরমে মরার লোক নন কোরবান চাচা। নিজের মনটাকে তাই মনে মনে কষে গালি দেন তিনি।

মুখে বলেন: ‘দেখ তো মাক্কু, মনটা কেমন পুংটা! খালি হাবিজাবি মনে পড়তাছে। তোর খুব কষ্ট অইতাছে, তাই না রে?’ Ñ‘কী কইতাছেন চাচা? কষ্ট তো অইতাছে আফনের। আফনে একটু জুইত কইরা বইন তো। কেমুন জানি উসখুস করতাছুইন। ’ তাদের কথার মধ্যে কথা বলার সুযোগ খুঁজে পেয়ে খেমোও বলে: ‘হ চাচা, মাক্কু ভাইয়ের আর কষ্ট কীয়ের? আফনের চাইতে কত ওজনের বস্তা হে টানবার পারে।

আফনের ওজন আর কত অইব। মোটা মানুষ তো এমনেই কম ওজন। ’ Ñ‘আরে খেমো, কথা শুরু করলে আর থামবার চাছ্ না। চাচারে একটু ধইরা ঠিকঠাক বহায়া দে তো। ’ Ñ‘থাউক থাউক, সব ঠিক আছে।

আর একটু গেলেই তো শেষ। অত ঠিকঠাকের কী আছে! যা যা!’ চাচা একটু ধমকের সুরেই বলেন কথাটা। তাঁর মাথার মধ্যে যা যা ঘুরপাক খাচ্ছে মাক্কুর কি সেসবের কিছুই মনে পড়ছে না? মনে পড়লে মাক্কু এমন ভোলানাথ সেজে আছে কীভাবে? মাক্কুর মতো ভোলা মেরে থাকার সহজ গুণটি তাঁর নাই কেন? এটাই তাঁকে রাগিয়ে তোলে। রাগটা নিজের ওপর হলেও ধমক ঝাড়েন মাক্কু আর খেমোর ওপর। চাচাকে এভাবে কোনোদিন পিঠে নিতে হয় নাই মাক্কুর।

তিনি তার পিঠে চড়েছেন অনেকবার। পিঠের ওপর দাপাদাপি করতে করতে নেতিয়ে পড়েছেন। চাচার নেতিয়ে পড়া শরীর তার পিঠের ওপর বস্তার মতো মনে হত। পিঠ থেকে অনেক কষ্টে ঝাঁকি মেরে ফেলে দিতে হত। চাচাকে এভাবে পিঠে বয়ে নিয়ে গাঙ পার হওয়ার কথা সে কোনোদিন ভাবে নাই।

শুকনা গাঙের ওপর পাতা জোড়া বাঁশের সাঁকো দিয়ে অসুস্থ একটা মানুষকে পিঠে বয়ে নিয়ে যাওয়ার ঝক্কি আছে। এমনিতেই মানুষটার হাত-পা ভাঙা। একবার কোনোভাবে পড়ে গেলে তো মহাসর্বনাশ। তার চেয়ে ঊরু সমান পানি ভেঙে পিঠে বয়ে নিয়ে গাঙ পার হওয়াটাই বরং নিশ্চিন্তির। চাচাকে নিয়ে এভাবে গাঙ পার হওয়ার কথা যেমন মাথায় আসে নাই, তেমনি আগে না ভাবা অনেক বিষয়ই এখন তার মাথার মধ্যে বলকানো ভাতের মতো উথলে উঠতে থাকে।

দাঁতে দাঁত চেপে খুব সাবধানে গাঙ পার হতে থাকে মাক্কু। সব ভাবনাকে সে কথা হয়ে বেরিয়ে আসতে দেয় না। গলা বেয়ে একেবারে জিভের আগায় কথা চলে এলেও না। এজন্যই বোধ হয় ঘনঘন ঢোক গিলে সে। ঢোক গিলে গিলে পেটের কথাটি পেটেই চালান করে দেয়।

এক হাতে গলা পেঁচিয়ে রাখায় কোরবান চাচা মাক্কুর ঢোক গেলার বিষয়টি টের পান। মোটর সাইকেল অ্যাক্সিডেন্টে হাত-পা ভাঙার পর থেকে চাচার ভোগান্তি ও কষ্ট দেখে মাক্কুর মনটা পলিমাটির মতো নরম হয়ে আছে। আর কী তাজ্জব! অনেক দিন ধরে চাচার সংসারের প্রতিদিনের আবর্জনার স্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা মাক্কুর কষ্টের একটা বীজ আজ এই এতদিন পর গাঙের পানির আর্দ্রতা ও চৈত্রের রোদের তাপ পেয়ে পট করে ফেটে গিয়ে আচমকা একটা অঙ্কুরের মতো ছিটকে বেরিয়ে আসে। Ñ‘চাচা একটা কথা জিগাই? ওই দিন কঞ্চিটা ভাইঙ্গা গেছিল কেয়া?’ চাচা প্রথমে তার এই কথার আগামাথা কিছুই ধরতে পারেন না। কোনো ব্যাপার বুঝে উঠতে না পারলে চাচার আবার ধমকে উঠার অভ্যাস।

Ñ‘কী কছ্? কীয়ের কঞ্চির কথা কছ্? সাঁকো কি আমি কঞ্চি দিয়া বানাইছি নাকি?’ কঞ্চি দিয়ে যে সাঁকো হয় নাই সেটা তো চোখের সামনেই দেখা যায়। মাক্কু তা জিজ্ঞেস করে নাই। চাচার সাথে বহুদিনের সম্পর্কের কারণে তারও কিছু জিনিস রপ্ত হয়ে গেছে। চাচা দাবাড় মারলেই এখন সে আর আগের মতো ভয় পায় না। সে-ও জানে কোনটা কোন ধরনের ধামকি।

তাই কোনো রকমের দুনোমনা না করে মাক্কু বিষয়টা আরও একটু খোলাসা করে। Ñ‘চাচা, কইঞ্চা যাতে না ভাঙ্গে হের লাগাই তো বাত্তি কইঞ্চা লইছিলাইন আমারে পিডাইতে। হেই কইঞ্চাও গেল ভাইঙ্গা!’ মাক্কুর কথা শেষ হতে না হতেই বহু বছর সেই দুপুরটা আজকের দুপুরকে আড়াল করে চাচার চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। টুকুরু (লুকোচুরি) খেলতে গিয়ে চাচার মেয়ে ঝুমার সাথে খড়ের গাদায় জড়াজড়ি অবস্থায় ধরা পড়েছিল মাক্কু। বেশ কিছুদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল না।

ঝুমার মায়ের ধারণা, টুকুরু খেললে বৃষ্টি হয়। ঝুমার দাদির ধারণাও তা-ই। চাচার ভাইয়ের মেয়ে টুনি দেখেছিল। টুনিই সবার কাছে রাষ্ট্র করে দেয়। কাজকাম ফেলে রেখে টুকুরু খেলার দায়ে সেদিন মাক্কুকে নাকাল হতে হয়েছিল।

খবর পেয়ে মাক্কুর মা এসেছিলেন। ঝুমার মায়ের কাছ থেকে নারকেল তেল নিয়ে ছেলের দগদগে পিঠে মাখছিলেন আর কাঁদছিলেন বোবার মতো। একটা পিঁড়িতে বসে মায়ের সামনে পিঠ পেতে রেখেছিল মাক্কু। চাচাকে আসতে দেখেই তার মায়ের চেহারা ও কথাবার্তা হঠাৎ পাল্টে যায়। আঁচলে কান্নাভেজা চোখমুখ দ্রুত মুছে নিয়ে চাচা কিছু বলার আগেই মা বলতে থাকেন: ‘মারছুইন, ভালা করছুইন।

অন্যায় করলে মারবাইন। পোলা আমার অইলেও মানুষ তো করতাছুইন আফনেই। মারতে মারতে মাইরা ফালাইলেও আমি টু শব্দ করতাম না। ’ মাকে সেদিন বড় নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল। সেদিন মাকে তার আপন মা মনে হয়নি।

মনে হয়েছিল, লোকজনের বলাবলিই ঠিক। তার মা বোধ হয় তাকে কুড়িয়েই পেয়েছিলেন। কোনো মা-ই ছেলেবেলা থেকে নিজের পেটের সন্তানকে যাত্রা দলে পাঠায় না। কোরবান চাচা এত পেটানোর পরও যে মা আরও পেটাতে বলেন, সেই মা কেমন করে তার আসল মা হয়! সেদিন মায়ের আচরণে খুব অবাক হয়েছিল মাক্কু, কিন্তু আজ সেই অসহায় মায়ের কথা ভেবে তার খুব কষ্ট হয়। সেদিন মায়ের কথার পরে চাচার আর কোনো কথাই বললেন না।

বিষব্যথা কমার ওষুধের জন্য কয়েকটা টাকা মায়ের হাতে দিয়ে সড়ে পড়েছিলেন তিনি। মাক্কুর এক প্রশ্নের ধাক্কায় চাচা যতণ থমকে থাকেন ততণে মাক্কু অনেক অনেক দূর পর্যন্ত ভেবে নেয়। থমকানো অবস্থা কাটিয়ে উঠার পর কথা ঘুরিয়ে দেওয়া ছাড়া চাচা আর কী-ই বা করতে পারেন! কিন্তু কথা ঘুরিয়ে দিতে গিয়ে চাচা আবার এমন কথা বলে বসেন যা একই সঙ্গে মাক্কুর পুরনো কষ্টের দিকেও ইঙ্গিত করে: ‘কী রে তোর খুব কষ্ট অইতাছে?’ বলেই আবার নিজের কথায় নিজেই চমকে যান তিনি। চাচার কথায় রেগে যাওয়ার ভান করে মাক্কু বলে: ‘হুম, কষ্ট অইতাছে! কেমুন হাজার মাইল লাম্বা একটা গাঙ আফনেরে লয়া পার অইতাছি যে কষ্ট অইতাছে। আর বিশ-পচিশ কদম গেলেই তো শেষ।

এইডা আবার কোনো কষ্ট হইল! আফনে আমার লাইগা কতকিছু করছুইন, কত কষ্ট করছুইন, হেইতার কি কিনু হিসাব-কিতাব আছে! পিঠের চামড়া দিয়া জুতা বানাইয়া দিলেও আফনের ঋণ শোধ অইব না। ’ মাক্কুর এই লম্বা-চওড়া কথায় চাচা মনে মনে বেশ একটা আরাম পান। চাচাকে আরাম দিতে পেরে মনে মনে আরাম পায় মাক্কুও। চাচাকে চুপ করে থাকতে দেখেই তার পস্তানি শুরু হয়েছিল। যে কথা এতদিন না বলে চলেছে, তা চাচার এই নাজুক অবস্থায় বলার এমন কী দরকার ছিল? শালা, কখন যে কোন কথা মুখ ফস্কে বেরিয়ে যায়! কোরবান চাচা এবার মাক্কুর পিঠের ওপর অনায়াসে শরীর ঢেলে দিতে পারেন।

বেশ ফুরফুরে মন নিয়ে ভাবতে পারেন: শোধ করতে পারবি না বলেই তো তোর জন্য এতকিছু করেছি রে! যাতে সারা জীবন ঋণে বান্ধা রাখা যায়। দুয়েক জন মানুষকে ঋণে বান্ধা রাখতে হয়, যাতে আপদে-বিপদে ডাক দিলে উড়ে এসে জান ধরে দেয়। ব্যাপারটাকে আরও হালকা করতে চাচা এবার তার সহজাত ধূর্ততায় বলেন: ‘ও রে বাপ! আগে আমার ঠেং ভালা হউক, পরে জুতা। জুতা পায়ে দিয়া কি বিছানায় শুইয়া থাকন যায়? ঠেং ভালা না অইলে তোর পিঠের চামড়ার জুতা দিয়া আমার কী লাভ, ক?’ গাঙের পানিতে ডুবে ডুবে খাবার কুড়িয়ে নেওয়া হাঁসের মতোই স্মৃতির মধ্যে হাবুডুবু খাওয়া মনটাকে ফিরিয়ে আনতে আরও আলাপ চালিয়ে যেতে চান চাচা। এরই মধ্যে কখন যে আরও একটা পুংটামি খেয়াল এসে তাঁর মনে বসে ওঁত পেতে আছেÑ তা আগেভাগে একটুও নজরে পড়ে নাই।

অনেক অনেক বছর পর পাছার ওপর এই বোঁটা খসা লিচুর ঘষায় মাক্কুর কেমন লাগছে তা জানার অদ্ভুত এক খেয়াল, তিনি না চাইলেও, তলে তলে খুব বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কঞ্চি দিয়ে ফালাফালা করে পেটানোর পর আর কোনোদিনই মাক্কু চাচার কোলে চড়ে নাই আর চাচাও মাক্কুর পিঠে চড়েন নাই। মাক্কুকে ওইভাবে পেটানোর অবশ্য অন্য একটা কারণও ছিল। মাক্কুর সাথে তাঁর যে সম্পর্ক সেটার জন্য নিজের কাছে ও লোকজনের কাছে দিনদিন ছোট হয়ে যাচ্ছিলেন। নিজেকে সামাল দেওয়ার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছিল।

হারামজাদা মাক্কুটাও যেন কেমন! ইশারা করলেই আদুরে বেড়ালের মতো কোলে উঠে আসত। কঞ্চি দিয়ে আচ্ছামতো পেটানোর পর তাঁরও ইচ্ছা হয়নি আর মাক্কুর দিক থেকেও কোনো সাড়া মেলেনি। এখন মাক্কুর পিঠে চড়ে ওইসব দিনের কোনো আভাস মাক্কুর মধ্যে না দেখে অবশেষে চাচারও মনে হতে থাকে, তাদের জীবনে কোনোদিন ওই ধরনের কোনো ঘটনাই হয়ত ঘটে নাই। এ রকম মনে হতে থাকে আর কী অদ্ভুত! বয়সী লিঙ্গটা দ্রুত শক্ত হতে থাকে। মাক্কুর পিঠের ওপর শরীর ছেড়ে দিয়ে চাচা নিচ দিকে একেবারে বেকায়দা ঝুলে পড়তে থাকেন।

এ সময় চাচার ঊরু দুইটা আলগোছে পেঁচিয়ে ধরে ঝাঁকি মেরে পিঠের ওপর তুলে নেওয়ার আগে মাক্কু সাবধান করে দেয়: ‘চাচা, একটু হইল অইয়া বইন। জুইৎ কইরা ধরুইন যেন্। লজ্জার কি আছে! আমি তো আফনের পোলার মতোই। আশ্চর্য! যেসব চিন্তা এতণ মাথার মধ্যে কিলবিল করছিল, সেসব যেন মাক্কুর এক ঝাঁকুনিতে, এ কথায় একেবারে কচুপাতার পানির মতো টুপ করে ঝরে যায়। ঝরে যাওয়ায় চাচা বেশ নির্ভার বোধ করেন।

আচমকা মাক্কুর পিঠটা তাঁর কাছে মোটর সাইকেলের গদির চেয়েও আরামের হয়ে ওঠে। একেবারে শিশুর মতো পরম ভরসায় মাক্কুর গলা পেঁচিয়ে ধরেন কোরবান চাচা। মাক্কুর কানের কাছে মুখ এনে শঙ্কিত হওয়ার ভান করে বলেন: ‘মাক্কু রে, তোর ওপর বহুত অন্যায়-অত্যাচার করছি। কহন যে মইরা যাই, কে জানে। আমারে মাফ কইরা দিছ রে বাপ!’ চাচার কথায় মাক্কু যেন মরমে মরে যায়।

পানি ছেড়ে গাঙের চরে উঠার আগপর্যন্ত তার মুখ দিয়ে কোনো কথাই সরে না। চরে উঠার পর পিঠ থেকে নামিয়ে সে ও খেমো মিলে চাচাকে ক্র্যাচের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়। ঝুমাও এসে তাদের পাশে দাঁড়ায়। বহুদিন পর এই প্রথম চাচার সামনে কথা বলতে গিয়ে মাক্কুর গলা বুঁজে আসে। আগে বলা কথাগুলো ফিরিয়ে নিতে সে আকুল হয়ে ওঠে।

আমতা আমতা করে বলে: ‘চাচা, আফনে মাইরধর কইরা মানুষ না করলে মাক্কু আর এই মাক্কু অইত না। হেইদিন আমার শাস্তি আরও বেশি অওয়ার দরকার আছিন। হেইডার লাইগাই জিগাইতাছিলাম যে, কইঞ্চাগুলান হেইদিন ভাইঙ্গা গেছিল কেয়া? এত অল্পে ভাইঙ্গা যাওয়াটা ঠিক অয় নাই। আফনের মনে যে আঘাত আমি দিছিলাম তা আমার পিডের আঘাতের চাইতে অনেক বেশি। ’ বলতে বলতে চাচার একটা হাত চেপে ধরে মাক্কু।

চাচার মুখের দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকে। তার এ ধরনের আচরণে চাচা খানিকটা বিব্রত হন। তারপরও হেসে হেসেই বলেন: ‘একটা বাশের বয়স আর একটা মাইনষের বয়স তো সমান না। বাত্তি মানুষ আর বাত্তি কইঞ্চা কি সমান অইল? তোর মতো বাত্তি পোলার লগে হেইদিন চনচনা বাত্তি কইঞ্চায়ও পারে নাই। ’ কোরবান চাচাকে মাক্কু বেশিণ ক্র্যাচে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেয় না।

চাচাকে বিব্রত করে যে পাপ সে করেছে তা থেকে রেহাই পেতে প্রায়শ্চিত্য হিসেবে তাঁকে আবার পিঠে তুলে নেয়। চাচাকে পিঠে নিয়ে মাক্কু একটা ভারবাহী পশুর মতো গাঙের ঢালু চর বেয়ে ওপর দিকে উঠতে থাকে। [গল্পটি এর আগে সাপ্তাহকি ২০০০ এর একটি বিশেষ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। ]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.