আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন দীপক কামালের মৃত্যু এবং রেখে যাওয়া কতোগুলো স্বপ্ন



দীপক কামাল। মাত্র ৪৪ বছর বসয়ে শেষ হয়ে গেলো একটি স্বপ্ন। তিনি আর নেই। যারা তাঁর ফেইসবুকের বন্ধু তারা যে কেউ এখন দীপক কামালের স্ট্যাটাস, তাঁর দেওয়া ছবি, তাঁর মন্তব্যগুলো দেখতে পারেন আবার। চোখ ভিজে যাবে জলে।

একটা মানুষ কতোটা ভালো হতে পারে দেখবেন সেটা। আর ভালো মানুষগুলো কেন এতো তাড়াতাগি মারা যায়! খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারজ অ্যান্ড মেরিন টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি। লোকটির সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি, কখনো আমরা গল্প করিনি একসঙ্গে, কখনো একসঙ্গে চা খাইনি। তেমন ঘনিষ্ঠ কেউও না তিনি আমার।

ফেসবুকের কিছু কমন বন্ধুর সূত্র ধরে আমি তাঁর বন্ধু হই এবং সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে পরিচয়। কিন্তু মনে হচেছ আমি আমার জীবনের ঘনিষ্ঠ কাউকে হারালাম। বাংলাদেশ হারালো একটি অমিত সম্ভাবনাময় স্বপ্নকে, একজন প্রগতিশীল ভালো মানুষকে। সাংবাদিকতা পড়তে গিয়ে অনেকরকম কন্টেন্ট অ্যানালাইসেস, বই রিভিউ অনেক কিছু বিশ্রেষন করতে শিখেছি। কিন্তু মানুষের ফেসইবুক তাঁর জীবন বিশ্লেষন করা শিখি নাই।

তবুও চেষ্টা করছি। দীপক কামালের জন্ম ১৯৬৫ সালের ৩০ জানুয়ারি পাবনা জেলার উপজেলার কামাল নগর গ্রামে। তিনি ১৯৮০ সালে এসএসসি পাস করেন। অনার্স করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সাইন্স থেকে। ১৯৮৯ সালে অনার্স পাস করেন।

মাষ্টার্স করেন ১৯৯১ সালে। ১৯৯২ সালে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ২০০৬ সালের ৩০ জানুয়ারি অধ্যাপক হন। থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এআইটি) পিএইচডি করছিলেন। ৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার সকাল ৭ টায় অসুস্থ্য হয়ে পড়লে তাকে এআইটির পাশে অবস্থিত থামাসাট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

থাইল্যান্ডের স্থানীয় সময় সকাল ১০ টায় তিরিন মারা যায়ন। তাঁর মৃতুর খবর দেশে এসে পৌছালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শোকের ছায়া নেমে আসে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন তিনি। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছেন খান জাহান আরী হলের প্রভোষ্টের।

ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। আর দশজর শিক্ষকের চেয়ে একটু বেশি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন তিনি তাঁর ছাত্রদের প্রতি। ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেখে চলুন জানার চেষ্টা করি তাকে। দীপক কামাল তাঁর ফেইসবুক স্ট্যাটাসের রাজনৈতিক আদর্শের জায়গায় লিখেছিলেন Towards a developed, modern & liberal Bangladesh. অর্থাৎ একটি উন্নত, আধনিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। নিজের অ্যাক্টিভিটিস সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন Reading & learning, Teaching, Research, Gardening।

সারাজীবন তিনি ছাত্র থাকতে চেয়েছিলেন। পড়াশোনার বিষয়ে তাঁর ছিল ব্যাপক আগ্রহ। তাঁর প্রিয় গান ছিল: আমি বাংলার গান গাই। ২৪ জুলাই রাত ১ টা ৭ মিনিটে ফেইসবুকে তিনি সর্বশেষ স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সেটি ছিল সুন্দরবন সম্পকির্ত-Shrimp fry collectors in the Sundarbans ।

২৪ জুলাই তিনি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তাতে মানচিত্রসহ ছিল-Marine Fishing Zone of Bangladesh in the North Bay of Bengal. এই স্ট্যাটাসে তিনি সর্বশেষ মন্তব্য করেছিলেন ২৫ জুলাই ১২ টা ১৪ মিনিটে। তাতে লেখা ছিল It is due to lack of interest by big investors in launching industrial fishing fleets in the Bay and also due to lack of Governmental initiatives. There is no expert on marine fisheries in the Department of Fisheries. Fishing in the sea is not easy as fishing in the pond, river or lake. It involves knowledge in Climatology, Oceanography, GIS and ... Read MoreRemote sensing (i.e. eco-sounding) technology. Ordinary fisheries graduate don't have these skills. Moreover, there is no educational institution (except the Marine Fisheries Academy) in Bangladesh. We are so bad nation that we have no institution or policy (Marine Policy) although we have a sea full in living and non-living resources and the size of our sea is nearly double of our mainland. We make even politics not to establish the National Institute of Oceanography!! এখনো বাংলাদেশ তার সমুদ্র সীমা ঠিক করতে না পারায় তিনি খুব উদ্বেগে ছিলেন। ২৪ জুলাই তিনি এ সম্পর্কে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তাতে কানাডার ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনার সময় তিনি যে সমুদ্রসীমা ঠিক করেছিলেন সেটি দেখান।

জাতিসংঘের আইন অনুযায়ী তিনিই প্রথম বাংলাদেশের সমুদ্র সীমা ঠিক করেন। একুশ শতকের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের একটি সাক্ষাতকার ছাপা হয়েছিল ‌‌একুশ শতকের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার দিকদর্শন শিরোনামে। দীপক কালাম তাঁর স্ট্যাটাস এবং ছবিতে এই লেখাটি অ্যাড করেছিলেন। তিনি চাইতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আরো বেশি ভালো হোক। গবেষণনা করুক।

সুন্দরবন নিয়ে অনেক গবেষনা করেছেন তিনি। এ নিয়ে তাঁর অনেক লেখালেখি আছে। ২২ জুলাই সুন্দরবন নিয়ে একটি বিশেষ স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তিনি। ১৮ জুলাই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে স্ট্যাটাস হিসেবে দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন এই পতাকাকে তিনি কতোটা ভালোবাসেন।

বখাটেদের নির্যাতনে এক ছাত্রী স্কুলে যেতে পারছে না এই সংবাদটি তাঁর খুব মন খারাপ করে দিয়েছিল। ৫ জুলাই তিনি এ নিয়ে স্ট্যাটোস দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এসব শেষ হবে কবে? শিক্ষামন্ত্রী সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেবেন বলে যে ঘোষনা দিয়েছিলেন সেটিও উল্লেখ করে স্বাগত জানিয়েছিলেন ৯ জুলাই ১২ টা ৫১ মিনিটে। ২৭ জুন প্রথম আলোয় একটি শনিবাররে প্রতিদবেদন ছাপা হয়েছিল চাষের খরচ কমাবে জাদুরনল শিরোনামে। দীপক কামাল এই খবরটি দিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন এ বিগ অ্যচিভমেন্ট।

২৭ জুন ব্যাংককে খুব বৃষ্টি হয়। তিনি সেদিন স্ট্যাটাস দেন Aji borshon mokhorito... সেদিন সন্ধ্যায় প্রবাল বড়ুয়াকে মন্তব্য করেন থাইল্যান্ডে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। অনুভব করছি। সম্ভবত তিনি অনুভব করছিলেন তাঁর প্রিয় বাংলাদেশের সেই বৃষ্টিকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা নিয়ে আদালত যে রায় তাতে খুবই খুশি হয়েছিলেন তিনি।

ভেবেছিলেন এবার বুঝি এসব বিতর্কের অবসান হবে। তিনি সেদিন লিখেছিলেন: Verdict of the High Court: Should We Learn a Lesson on the Deceleration of Liberation War of 1971? Mujib, not Zia proclaimed independence: HC :: Bangladesh :: bdnews24.com :: ২০ জুন সন্ধ্যা ৭ টা ৩২ মিনিটে তিনি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন : Les us change ourselves towards a batter Bangadesh. তিনি স্বপ্ন দেখতেন একটি উন্নত, প্রগতিশীল বাংলাদেশের। তাই বারবার এসব কথা বলতেন তাঁর ছাত্রদের, বন্ধুদের। বলতে, চলো আমরা সবাই মিলে দেশটা গড়ি। ১৩ জুন তিনি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, Ban Jamayat, hate the war criminals, stand against the fake politics. বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধদের বিচারের কথা বারবার বলেছেন তিনি।

১৩ জুন সন্ধ্যায় তিনি পত্রিকার একটি সংবাদ ছবি হিসেবে দিয়েছিলেন। সংবাদটি ছিলো: ঘুমেই মিলবে সব সংকেটর পথ। তিনি তখন স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন: So try to have a deep sleep! এই পর্যন্ত আসার পর কিছুতেই সামলাতে পারছিলাম না নিজেকে। চোখ ভিজে আসছিল বারবার। দীপক কামাল ফেইসবুকে মোট ১৪ টি ফটো অ্যালব্যাম দিয়েছিলেন।

এর মধ্যে দুটি ছিলো তাঁর স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে, ছিলো বৃষ্টির ছবি। বাংলাদেশের প্রকৃতি, নববর্ষ, মানুষ এবং সুন্দরবন নিয়ে কয়েকটা অ্যালবাম ছিলো। My Family My Life নামে একটি অ্যালবামে তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছবি দিয়েছিলেন। দীপক কামাল পিএইচডি নিয়ে গত কয়েক মাস খুব ব্যস্ত ছিলেন। আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবী দীপক কামালের খুব ভক্ত।

ও দীপক কামালের মৃতু্ খবর শুনে সারাদিন খুব মন খারাপ করে ছিলো। ও জানালো দীপক স্যার তাকে শেষ যে বার্তা ছিলো তাতে লেখা ছিলো: এখন খুব ব্যস্ত। ফ্রি হলে তোমার সঙ্গে কথা বলবো। সেই ফ্রি তিনি হলেন, তবে মারা গিয়ে। দীপক কামালের স্ত্রী একজন চিকিৎসক।

ঢাকায় চাকুরি করেন। তাদের একটি ছেলে আছে। আমাদের চীফ রিপোর্টার পিন্টু ভাই দীপক কামালের পরিবারের ঘনিষ্ঠ। পিন্টু ভাই বলছিলেন, খুব শিগগিরই পিএইচডি শেষ করে দেশে আসার কথা ছিলো দীপক কামালের। কথা ছিল, এসেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবেন।

তাই তাঁর স্ত্রী ঢাকা থেকে বদলি নিয়ে খুলনায় ট্রান্সফার হন। সেখানে গত মাসে বাসা নেন। সব গোছগাছ করেন। কিন্তু দীপক ফিরছেন লাশ হয়ে। দীপক কামাল ফেইসবুকে তাঁর প্রিয় উক্তি হিসেবে লিখেছিলেন: What is the meaning of life? আসলেই জীবনের অর্থ কি? এই যে হঠৎ চলে যাওয়া এভাবে চলে যাওয়া, সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাওয়া এর মানে কি? ভালো মানুষগুলো কেন হুট করে চলে যায়।

মাত্র ৪৪ বছর বয়সে কেন একজন মানুষ এভাবে মারা যাবেন? গত বছর এই বয়সে আমার মা মারা গিয়েছিলেন। কেন ভালো মানুষগুলো এতো তাড়াতাড়ি মারা যায়। অসম্ভব দেশ প্রেমিক, একজন ভালো মানুষ দীপক কামাল বারবার বলতেন, চলুন সবাই মিলে একটি ভালো দেশ গড়ি। নানা সমস্যার মধ্যে হয়তো একদিন আমরা সেই দেশ গড়বোও। সেদিন কি আমরা মনে রাখবো এই মানুষটিকে।

নিশ্চয়ই মনে রাখবো। মনে রাখবে, তাঁর ছাত্ররা, তাঁরে ছেলে মনে রাখকব এই বাংলার মাটি, এই বাংলার সবুজ শ্যামল। মনে রাখবে সুন্দরবন। লাল সালাম এই ভালো মানুষটির জন্য।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.