আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বন্ধুরা ভুলে গেছে,চলে গেছে দৃষ্টির আড়ালে,ঢেকেছে আঁধারে...

দ্য ইনভিজিবল

মাঝে মাঝে আমার ইন্দ্রিয়টা খুবই তীক্ষ্ণ আর স্পষ্ট হয়ে উঠে। একদম ধূষর-ধূলোপড়া স্মৃতিও টনটনে হয়ে যায়। সেই কবে ন্যাংটা কালে দুষ্টুমি করতে গিয়ে কোথায় কোন ব্যথাটা পেয়েছি, কাকে চিমটি কেটে নখের আগায় মাংস উঠিয়ে এনেছি বা কোন ছোট্ট ন্যাওটার সাথে স্থানীয় প্রতিশোধে সুযোগ মত আচ্ছা করে কিলিয়েছি-সবকিছু মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় স্কুলের পাশের টং দোকান থেকে দুইটাকা বাকি খাওয়া, স্কুলের পিছনের বড় কৃঞ্নচূড়া গাছের ডালে শাখামৃগের চিক্কুর দেওয়া আর বাঘা স্যারের অংক ক্লাসে মার খেয়ে ডিব্বা মিয়ার(বন্ধুর আদুরে নাম) পেচ্চাব করে দেয়ার কথা। তুচ্ছ কোন ঘটনাও আমাকে জাগিয়ে রাখে কখনও কখনও।

তেমন আর কীই বা বয়েস আমার। মাত্র ... অথচ বাল্য কত বন্ধুদের রেখে এসেছে গাঁয়ের পাড়ে। রয়ে গেছে তারা বাপের সংসার সহকারি হয়ে। দুরন্ত বন্ধুদেরকে ছেড়ে এসে বৈষ্ণুবী শহরে এসেছিলাম শিক্ষা নিতে। ব্যাপক শিক্ষা হয়েছে।

নিত্য আরো কত শিখছি!। এখনও বাড়ি গেলে সেসব ‘ছোটেমিয়া’ সংসারীদের সাথে কত্ত কত্ত জরুরী বিষয়ে আলাপ করি! তারা কত্ত ব্যস্ত থাকে। কেউ জমিতে ধান রোপে,কেউ নিড়ানি দেয়। কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। আবার কেউবা বেশ গেরহস্ত হয়ে উঠেছে।

আমি সমস্ত ব্যবধান ছিড়ে বসে যাই তাদের পাশে ক্ষেতের আলে। ইরি ধানের ক্ষেতের টলটলে পানিতে পা ভিজিয়ে হাটি। তারা হিসহিস করে উঠে। আমাকে প্যাক লাগবে বলে ধমকায়। আমার সাহেবগিরিকে উসকিয়ে দিতে চায়।

আমি থোড়াই কেয়ার করি! শহুরে জীবনে কত্ত কত্ত বন্ধু-বান্ধব। কত উদারও তারা। কিন্তু গায়ের এইসব বাল্যবন্ধুগুলো, যারা আজো রোদে পুড়ে,বৃষ্টিতে ভিজে তাদের সামান্য বাল্য বন্ধুকে দেবতা বানায় তাদের বিনম্র শ্রদ্ধা না করে কি আমি পারি! একসময় যে হাত দু’টো দিয়ে তারা আমার সাথে হস্তপেশন (কে কার হাত কত জোরে চাপ দিতে পারে) খেলতো,আজ আমার অবলীলায় করমর্দনের জন্য বাড়িয়ে দেয়া হাত দু’টোতে হাত লাগাতে তারা কুঞ্চিত,কুণ্ঠিত হয়। যে বুক চিতিয়ে এক সময় কুস্তি কুস্তি খেলায় তাদের সাথে লড়েছি,আজ তারা আমার বুকে এসে জড়াতে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে উঠে। যাদের সাথে পুকুর পাড়ে সি­প খেলেছি,আজ আমার খেলার সাথীরা আমায় দেখে সম্ভ্রমে নেতিয়ে উঠে।

আমার লজ্জা লাগে। আমিও কুণ্ঠিত হই;তাদের কুণ্ঠা দেখে। তারা আমাকে সম্মান আর শ্রদ্ধা করার নামে আমার থেকে যোজন যোজন দুরে সরে গেছে। আমাকে আধুনিক শহুরে ভেবে তারা কাদা মাখানো গায়ে আমার সাথে কোলাকুলি করেনা দেখে আমার বুকটা ফেটে যায়। আমি কেঁদে উঠি।

বন্ধুত্বের কোন সীমারেখা,ব্যবধান আমি মানিনা। আমি জানিনা কোথায় কার কত সামাজিক স্ট্যাটাস! আমি তাদেরকে আকুল হয়ে বলে উঠি ’তোরা কেন এমন করিস? কেন আমায় দুরে ঠেলে দিস?’ তারা হাসে। আমার জন্য তারা দোকানে দুধ চা কিংবা গুলগুইল্যার অর্ডার না দিয়ে ভদ্রতার মাপকাঠিতে ৭আপ,কেকের অর্ডার দেয়। আমি প্রাণপনে বাধা দিই। আমি দুই টাকার মুড়ি খাবো।

সাথে এক কাপ চা! তারা অবাক হয়ে ফাজলামো ভেবে খিলখিল করে হেসে উঠে। তাদের ধারনায় একজন শহর প্রত্যাগত মানুষের জন্য পেপসি কোক যথাস্থ খাবার। তারা আমার কাছে শহরের কোন গল্প শুনতে চায় হয়তো। কোন অবাক করা গল্প। এসব আমার ভাল্লাগেনা।

আমি তাদেরকে শুধাই,মনে পড়ে তোদের- সেই যে একবার ঠাকুর বাড়ীর পিছনের বড় গাছটা থেকে তিনটা শালিকে বাচ্চা ধরেছিলাম। তাদেরকে বাচ্চা বয়েসেই পায়ে সূতা দিয়ে আটকে দিয়েছিলাম যাতে বড় হয়ে উড়তে শিখলেও পালাতে না পারে। পরে ’তুই’ ছোট্ট পাখিগুলোর জন্য দরদী হয়ে বল্লি, এত্ত ছোট্ট পাখির ছানাগুলোকে এভাবে বাইন্ধা রাখা অন্যায়। তারা বদদোয়া দিবো-ছাইড়া দে.... । আমি ছেড়ে দিলাম 'তোর' কথায়! তারা আমার এই অযাচিত স্মৃতিরোমন্থনে অনেক সময় খুশি হয়না।

কেন যে হয়না বুঝিনা। আমি ব্যস্ত হয়ে বলি, মনে আছে তোদের-একবার আমি বড় পুকুর পাড়ের ঐ যে নারকেল গাছটা থেকে পা পিছলে প্রায় পড়ে গেছিলাম। বুকের ছাল উঠে গেসিলো? বন্ধুত্বের এই যে আকুতি আমি মনে পোষন করি তাদেরকে বুঝাতে পারিনা। তাদের কাছে আমি এখন বিদেশ ফেরত। মাঝে-মধ্যে বাড়ী গেলে তারা আমায় দেখে সম্মান জানাবে আর কুশলাদি জিজ্ঞেস করবে-এই! আমি পারবোন আর তাদের সাথে গুলতি খেলতে,পারবোন ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকতে, ধুলো মেখে ধুলো মানব সেজে হা-ডু-ডু খেলতে।

পারবোনা জাল টেনে তাদের সাথে মাছ ধরতে কিংবা বর্ষামৌসুম শেষে বাধ দিয়ে পানি সেচে মাছ ধরতে। তারা এখন আমার থেকে যোজন যোজন দুরের মানুষ। চাইনা আমি এইসব!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।