আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিকিৎসা ব্যবস্থা- ১৪ কোটি গিনিপিগ এবং ১০ হাজার অশিক্ষিত ডাক্তার



স্বাস্থ্যসেবার মান নিম্নমুখী বাংলাদেশে। ভুল চিকিৎসার কারণে আহত-নিহত এবং খুন হওয়া মানুষের সংখ্যা ইদানিং বেড়েছে অনেকগুণ। যদিও এটা সামগ্রীক ব্যর্থতা, তবে মূলত ব্যর্থতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন তিনি সরকারী ডাক্তারদের প্রাইভেট প্রাকটিস করতে দেবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের ১৩টি সরকারী মেডিক্যাল কলেজ এবং ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার মাণ ও ডাক্তারের মান নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে অদ্যাবধি? বাংলাদেশের সরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলো হয়েছে রাজনীতিবিদদের আখড়া।

সেখানে ছাত্ররা গিয়ে নিয়মিত রাজনীতি করে, দলীয় ক্যাডার হয়ে কাটায় কয়েক বছর, এবং এই রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে পাস করে। এবং এদের অনেকেই কোনো রকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই রাজনৈতিক ক্ষমতার কারণে চিকিৎসক এবং পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী চিকিৎসক দল কিংবা জাতীয় চিকিৎসক লীগের সভাপতি, সদস্য এবং সভ্য হয়ে বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবা শুরু করে। বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোতে রাজনীতির খেলা নেই, তবে তোয়াজ আর পয়সার খেলা চলছে। কিন্তু এই চিকিৎসকদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশের সবাই। বাংলাদেশের মানুষদের ল্যাবেরেটরির গিনিপিগ বানিয়ে তারা বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছে এবং ভুল চিকিৎসা করে অনেক সময়ই হত্যা করছে।

গত ১ বছরে বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে ক্ষুব্ধ মানুষের হামলা দেখে মনে হয়েছে এসব হামলার নেপথ্যে আসলে আমাদের অযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আমাদের রাজনীতিমুখীতা দায়ী। এরা এমন চিকিৎসক তৈরী করতে পারছে না, যাদের উপর ভরসা করতে পারে মানুষ। সুতরাং বিভিন্ন বিষয়ে স্পেশালিস্টদের কদর বেড়েছে, সাধারণ একজন প্রাকটিশিং ডাক্তারের কাছে না গিয়ে মানুষ ছুটছে বিশেষজ্ঞের কাছে, সর্দি, কাশি, এমন কি সামান্য ফোঁড়ার জন্যও মানুষ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ চাইছে। এর কারণ মানুষ অন্য সব সাধারণ ডাক্তারদের উপরে ভরস করতে পারে না। বরং মানুষের মুখে মুখে প্রসার ঘটছে বিশেষজ্ঞদের।

এক একজন বিশেষজ্ঞ এতই ব্যস্ত যে তাদের প্রত্যেক রুগীর নাম জিজ্ঞাসা করবার মতো অবসর নেই। তারা ব্যবস্থাপত্র দেখে আউড়ে যাচ্ছেন ঔষধের নাম, এবং অসংখ্য টেস্ট করতে দিচ্ছেন। নিজেদের ব্যবসায়িক মনোভাব, সময় না দেওয়ার বিপক্ষে তারা রিপোর্টের উপরে ভরসা রাখছেন বেশী। সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থাই আদতে হয়ে উঠেছে পয়সার খেলা। শুধু ডাক্তার নয়, ডাক্তারের সাথে সংযুক্ত হাসপাতালের অন্যান্য কর্মীরাও অযোগ্য হয়ে উঠছে দিন দিন।

বাংলাদেশে প্রতিদিনই হাসপাতাল নয়তো ক্লিনিকের উদ্বোধন হচ্ছে, মানুষের তুলনায় হাসপাতালে সীট কম, কিংবা মানুষের ভরসা কম, সুতরাং মানুষ ভালো চিকিৎসার লোভে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে ডাক্তার খুঁজছে, এবং ক্লিনিকগুলোতে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ডাক্তারীর ব্যবসা করছে যারা তারা তো অন্য গ্রহের মানুষ নয়, সাধারণ দায়িত্বজ্ঞানহীন বাংলাদেশী মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা চিকিৎসক। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবার মানউন্নয়নের জন্য অনেক ব্যবস্থাই গ্রহন করতে হবে তবে সর্বপ্রথমে উন্নত করতে হবে শিক্ষা ব্যবস্থা। এখানে রাজনীতির প্রকোপ কমাতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনো প্রভাব খাটিয়ে যেনো অযোগ্য কেউ চিকিৎসকের সার্টিফিকেট না পায়। সংবাদপত্রের মানুষদের অসংখ্য সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয়, এটাও এক ধরণের সামাজিক দায়িত্ব হবে, তারা যেনো গত ৫ বছরে বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ থেকে সার্টিফিকেট পাওয়া ডাক্তারদের তালিকা ধরে ধে ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে দেখে, তারা আদৌ ডাক্তার হওয়ার যোগ্য ছিলো না কি অন্য কোনো অবৈধ উপায়ে তারা ডাক্তারীর সার্টিফিকেট পেয়ে মানুষ হত্যা শুরু করেছে। পরবর্তী পদক্ষেপ হবে চিকিৎসকদের দায়িত্ববোধ বাড়ানো ।

এবং এটা প্রথম আলোর মতো সাধারণ শপথের মাধ্যমে করা সম্ভব না। এটার জন্য একটা আইনী কাঠামো নির্দিষ্ট করতে হবে । একজন চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমাণা করতে হবে এবং সে জরিমাণা আদায় করতে হবে সরকারকে। এখানে সরকার ক্ষতিগ্রস্তকে ডাক্তারের কাছ থেকে প্রাপ্য ক্ষতিপুরণ আদায় করে দেওয়ার এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে। যদি কেউ এক বছরে ৩ জন রোগীর ভুল চিকিৎসা করে তবে তার সার্টিফিকেট বাতিল করতে হবে।

এবং ইন্টার্নশিপের মেয়াদ বাড়াতে হবে। একজন ডাক্তার নিজস্ব বেতান-ভাতা এবং অন্যান্য সরকারী সুবিধার জন্য আন্দোলন করতে পারে, সে সময় তাদের বক্তৃতাবাজীর সময় হয় কিন্তু একজন রোগীকে ঠিক মতো সময় দেওয়ার ব্যাপারে তাদের অনীহার কারণ তদন্ত করতে হবে। নার্সদের শিক্ষার মাণ বাড়াতে হবে। এবং একই সাথে যারা চিকিৎসকের সাথে সহায়ক হিসেবে কাজ করে তাদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ডায়াগনিস্টিক সেন্টার থেকে হাসপাতালে রূপান্তরিত হওয়া অন্তত দুটি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, ল্যাব এইডের স্পেশ্যালাইজড কর্ডিয়াক সেন্টারের পরিবেশ জীবানুমুক্ত নয়, গত ৬ মাসে সেখান থেকে বাইপাস করে আসা ৭ জন রোগীর পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারে মৃত্যুর অভিযোগও আছে।

এটা ভুক্তোভগীদের অভিযোগ। একই সাথে যারা এনেস্থেশিয়া নিয়ে কাজ করছে তাদের জন্য বিশেষায়িত কয়েকটি শিক্ষালয় থাকলেও সেখানে সম্ভবত শিক্ষার মানও বাংলাদেশের সরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর মতোই। কয়েক দিন আগে একটি ক্লিনিকে অপারেশনের মাঝামাঝি সময়ে রোগীর এনেস্থেসিয়ার প্রভাব কেটে যায়। এটা মূদ্রার একটা পিঠ, যেখানে পরিমাণমতো এনেস্থেসিয়া দেওয়া হয় নি। এনেস্থেসিয়ার পরিমাণ এবং ধরণ নির্ভর করে রোগীর উপরে, প্রতিটা রোগীর জন্য তার নিজস্বসহ্য ক্ষমতা অনুসারে ব্যাথানাশক দেওয়ার নিয়ম, শরীরের ওজন এবং রোগীর এলার্জির ইতিহাস ঘেঁটে এসব প্রদান করতে হয়।

কড়া এনেস্থেসিয়ার কারণে একজনের মৃত্যুর সংবাদও দৈনিক পত্রিকায় এসেছে। প্রয়োজনের তুলনায় কম কিংবা বেশী এনেস্থেশিয়া দেওয়ার অভিযোগ প্রতিটা ক্লিনিকেই রয়েছে, সুতরাং এই দিকটাও গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। সামগ্রীক ভাবে চিকিৎসা সেবার বেহাল অবস্থার কারণেই বাংলাদশের অবস্থাপন্ন মানুষের বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবা নিতে সাহস পায় না । এই দেশের সাংসদেরা, তাদের পরিবার পরিজন চিকিৎসার জন্য মালোয়শিয়া, ভারত, সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ড যেতে পারলেও সাধারণ মানুষের তেমন সঙ্গতি নেই । তাদের ভরসা এলাকার ক্লিনিক কিংবা সরকারী হাসপাতাল, অবস্থা গুরুতর হলে ঢাকা মেডিক্যাল, এইসব স্থানীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি না করে তাদের এই চিকিৎসাউপলক্ষ্যে বিদেশভ্রমন দেখে মনে হয় তারা নিজেদের জীবন নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন ততটা উদ্বিগ্ন নয় তারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে।

সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য এবং তাদের জীবনের মূল্যের প্রভেদ করছে যে ব্যবস্থা সে ব্যবস্থাও আদতে সাধারণ মানুষের ভোটের কারণেই তৈরী হয়। দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক এবং মালিকগণের ব্যবসার সমৃদ্ধি হয়েছে অনেক। তারা বিভিন্ন সামাজিক দায়বদ্ধতার কাজ করছেন, কিন্তু স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে তাদের উদাসীনতার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না। অন্তত সাধারণ মানুষের জন্য হলেও এইসব অব্যবস্থার নিয়মিত রিপোর্ট প্রথম পাতায় আসুক, সাধারণ মানুষ জানুক তারা কাদের হাতে নিজেদের জীবনকে নির্ভাবনায় ছেড়ে দিচ্ছে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.