আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন পতিতা ও একটি টোকাইয়ের গল্প(শেষ পর্ব)



সোবহান মিয়ার ঝামেলা একদম ভালো লাগে না। তবু কেন জানি সবসময় ঝামেলা তাকেই এসে জাপটে ধরে। ছোট থেকেই ডানপিটে। একটু বড় হওয়ার সাথে সাথেই বুঝতে পারল অভাব-অনটন তার চেয়ে দ্রুত গতিতে বাড়ছে। বাংলাদেশের মানুষগুলো যেমন বেশি বেশি সন্তান পয়দা করে এদেশের অভাব অনটনগুলোরও যেন উৎপাদন ক্ষমতা মারাত্মক।

বছর কয়েক আগেও সে ছিল পকেটমার। প্রচন্ড নেশাও করত। কত মার খেয়েছে। একবার তো মার খেয়ে পড়ে থাকতে দেখে কুকুর এসে ঘেউ ঘেউ শুরু করল। পরে এক টং দোকানদার বাঁচিয়েছিল।

একটূ সুস্থ হওয়ার পর সেও পাছায় দুটো লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এখন সে ওসব ছেড়ে এসেছে। তার ঘরে তার স্ত্রী পোয়াতি। এই কেসটাতে দু চার পয়সা কামানো গেলে তার জন্য খুব লাভ হত। ডাক্তার বলেছে মা ও শিশুর জন্য এখন ভালো ভালো খাবার প্রয়োজনীয়।

কিন্তু সাবিনার একগুঁয়েমি সব নস্যাৎ করে দিয়েছে। তবে মকবুল সাহেবের চেহারা দেখে মনে হয়েছে ব্যাপারটা ভীষণ গুরুতর এবং সহসাই এর সমাধান করা হবে। তাছাড়া এ ঘটনা থেকে যে কোন বিপদের আশংকা থাকতে পারে এই ব্যাপারটা এখনো ভাবার সময়ই পায়নি সে। আসলেই ভীষণ বিপদ হতে পারে। দ্বিতীয় লোকটার কথা শুনে মনে হয়েছে এরা কোন মামুলি বা ছিঁচকে হাইজ্যাকার নয়।

এদিকে সাবিনা আর টুনু। এরা জানেনা, এদের কখনো সে জানতেও দেবে না এদের সে ভীষণ ভালোবাসে। এতিম হওয়ার জ্বালা সে বোঝে। এদের জীবনের পরতে পরতে যে দারিদ্র্য আর অবহেলার কটাক্ষ, তাতে একরত্তি ভালোবাসার মেঘ না থাকলে কিকরে তারা সিক্ত হবে বৃষ্টি-স্নানের সুখে! ডাক্তার এলো আরও বড় ধরনের চমক নিয়ে। সাবিনা অন্তঃস্বত্তা।

টুনু ঠিক করে বুঝলও না প্রথমবার। বুবুর কাছে যাবে বলে বায়না ধরল। ডাক্তারনীটি ভীষণ ভালো। বলল, 'একটু পরে এসো। তোমার বুবু এখন ঘুমোচ্ছে।

' সোবহান মিয়া যেন বুঝে উঠতে পারছেনা, তার এখন কি করা উচিত! অনেকক্ষণ বাদে সাবিনার জ্ঞান ফিরল। টুনুও জেনেছে সাবিনা এখন পোয়াতি। তার ভীষণ মজা লাগছিল। সাবিনার বাচ্চাকে সে বিয়ারিং এর চাকার গাড়িতে করে চড়াবে। না না ওইটুকুন বাচ্চাকে ওই গাড়িতে চড়ালে ও ব্যাথা পাবে।

তাহলে সে একটা ফোম কিনে আনবে। ওতে বসিয়ে তারপর চড়াবে। ভীষণ মজা লাগছিল ভিতরে ভিতরে। কিন্তু সোবহান মিয়ার চেহারা দেখে ভিতরের মজাটা বারবার ঢোঁক গিলে খেয়ে নিচ্ছিল। সাবিনা: ডাক্তার কি বলছে? সোবহান: তুমি এত আহাম্মক আগে বুঝি নাই।

এই লাইনে এতদিন ধইরা কাম করতাছ আর এমন একটা ভুল করলা? আমি কই কি এই সতের মাইনষে্র বাইচ্চাডারে জন্ম দিবা কেন? তুমি রাজী থাকলে আমি ডাক্তরের লগে কথা কই। সাবিনা: এই বাইচ্চার বাপ আছে। হেয় কইছে আমারে ঘরে তুলব। সোবহান: কে্ডা? সাবিনা: না, এহন কমু না, আগে তার লগে কথা কমু। তারা ফিরে এলো বাড়িতে।

এর মধ্যে ফোনের দোকানটাতে কিছু লোক খোঁজ নিয়ে গেছে। ফোনের দোকানদার তাদের চিনেনা বলে বেঁচে গেছে। ওইদিকে মকবুলসাহেব খবর পাঠিয়েছেন সোবহান মিয়াকে থানায় যেতে। পরের দিন থানায় এলো সোবহান। যথারীতি ফোন করল সোবহান।

এবার আর শহীদের সাথে কথা হল না তার। কথার সারসংক্ষেপ হল ভাষানটেকের বস্তির পিছনে কাল রাত সাড়ে আটটায় সব জিনিস পত্রসহ তাদের দেখা করতে হবে। আসলে এই চক্রটি আন্তর্জাতিকভাবে চালিত হচ্ছে। এদের কাজ হচ্ছে পৃ্থিবীর বড় ব্যাংকগুলো থেকে টাকা হ্যাক করা। ওই মহিলার আইডি কার্ডের পেছনে একটি স্টিকার লাগান আছে।

আগে কয়েকবার একাউন্ট এর পাসওয়ার্ড চুরি হওয়াতে অর্থাৎ হ্যাক হওয়াতে সে এখন আর তার মেইল কিংবা ওয়েব ভিত্তিক কোন স্পেসের উপর ভরসা রাখতে পারে না। সে তাই পুরনো এই পদ্ধতিতে কোডটি নিয়ে ঘুরে। পুরনো তবে নতুনত্ব এইটুকুই যে কার্ডটিকে একবার দেখে বোঝা যায় না ওতে এধরনের কোন কোড আছে। এই কোডটিতে এক্সেস করতে পারলে প্রায় ২৩ মিলিয়ন ইউরো আত্মসাৎ করা যেতে পারে। প্ল্যানমত রাত সাড়ে আটটায় পৌছোল সোবহান।

কথা ছিল সে যেন এসে টর্চলাইটের আলো মারে। সে অনেকক্ষণ ধরে আলো মেরেই চলেছে, কিন্তু কেউই এলো না। এক ঘন্টা পরে মকবুল সাহেব এসে বললেন, ওরা বুঝতে পেরেছে, তাই আসেনি। আপনি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যান। ওই ছেলেমেয়ে দুটোসহ কোথাও গা ঢাকা দিন।

সোবহান: কই যামু? আমার তো যাওনের আর কুনো জাগা নাই! মকবুল: অঅ(নিরাশ ভঙ্গিতে), তাহলে এই যে ঠিকানা লিখে দিচ্ছি, আমার নাম বলবেন। ওখানে কোন ভেজাল করবেন না। বেশি কথা বলবেন না। সোবহান চলে গেল। মকবুল সাহেব বুঝতে পারল ভীষণ ভুল হয়ে গেছে।

উনি তাড়াতাড়ি ফোন দিলেন উপরওয়ালাদের। ঘন্টা দুএকের মধ্যেই ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের লোকজন সহ পুলিশের কিছু বড় কর্মকর্তা চলে এল। ঐ নাম্বারে ফোন দিয়ে দেখল তা বন্ধ। ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের রাতভর অভিযান আর পুলিশবাহিনীর তৎপরতায় সকাল নাগাদ ধরা পড়ল শহীদসহ একজন আর পাওয়া গেল সেই মহিলাকে। বাকীরা পালিয়ে গেছে।

মহিলা এখন হাসপাতালে। এখনো জ্ঞান ফিরেনি। পরেরদিন পত্রিকায় বড় করে ছাপা হল খবরটি। বড় করে ওই মহিলার ছবি ছাপা হয়েছে। টুনু ভীষণ আনন্দিত।

তার কিছু বাদেই পত্রিকা অফিসের লোকজন ওই বাড়িতে হামলে পড়ল। টুনু আর সাবিনার ছবি তোলার জন্য। সোবহান মিয়াও এসেছে তাদের সাথে দেখা করতে। পত্রিকায় এবার ছাপা হবে তাদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। কোন এক সাংবাদিক বলে উঠল ওই মহিলা নাকি টুনুকে দেখতে চেয়েছে।

তারা বাড়ি ফিরে এল। পরদিন টুনুকে সাজিয়ে দিল সাবিনা। সোবহান মিয়ার সাথে যেতে বলল। সোবহান তাকেও নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু সাবিনা বলল তার কাজ আছে।

তার এক টা বোঝাপড়া করতে হবে। ওরা তিনজনই বেরুল ঘর থেকে। দুজন একদিকে আর সাবিনা অন্যদিকে। এতদিন সাবিনাকে কেউ ঘাটাত না। এখন তার বাচ্চা হবে শুনে সবাই যার যার ইচ্ছামতন কথা বলতে শুরু করল।

তখন তার ইচ্ছে হচ্ছিল মরে যায়। তীব্র নিন্দার ভারে অলংকৃত হয়ে একটু আশ্রয়ের খোঁজে সে ছুটে চলল রঞ্জু হাওলাদারের ঘরের দিকে। সেখানে গিয়ে তার দেখা হল রঞ্জুর সাত বছরের বাচ্চার সাথে। সাবিনা: ওই তোর বাপে কই? পিচ্চি: বাপে তো সিলেট গেছে মাজারে। প্রত্যেক বছর যায়।

কয়েকমাস থাকে। আওনের সোম আমার লাইগ্যা বহুত কিছু আনে। সাবিনার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। তার এতদিনের স্বপ্নগুলো শুকনো পাতার মত পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মচমচ করে উঠছে। সে আর কিচ্ছু ভাবতে পারছে না।

মাথাটা ভনভন করছে... টুনুরা পৌছুলো বিশাল এক বাড়িতে। এ ধরনের বাড়ি আগে টুনু দেখেছে কিন্তু কখনো ঢুকতে পারেনি। আজ ঢুকল। ঢুকার সাথে সাথেই একটা কুকুর ছুটে এল। তারা তো ভয়ে পালিয়ে যায়।

কিন্তু সাথে সাথেই মিসেস লুন্ডবার্গ ছুটে এলেন। তিনি এখন কিছুটা সুস্থ। একটু পরেই কুকুরটার সাথে ভাব হয়ে গেল টুনুর। একটু সময়ের অতিবাহনেই টুনুও হয়ে উঠল এই সম্ভ্রান্ত পরিবারের একাংশ। মহিলা এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল টুনুর দিকে।

তিনি নিঃসন্তান। কখনো সন্তান নেয়ার কথা ভাবেনওনি ওভাবে। তিনি অনেক কষ্টে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় সোবহান মিয়াকে বুঝিয়ে বললেন তার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আগামি মাসে স্টকহোমে যাওয়ার সময় টুনুকে তার সাথে নিয়ে যেতে চান। আর কয়েকদিন সে এখানে থাকুক। কিছুদিন পরে এসে তিনি যেন আবার তাকে নিয়ে যায়।

আসার সময় সোবহান মিয়াকে হাজার পাঁচেক টাকা দিলেন তার বউএর জন্য কিছু কিনে নিতে। সোবহান মিয়ার যে কি ভালো লাগছিল! আজকে তার বউয়ের জন্য অনেক কিছু কিনে নেবে। তার মনে হল এই মহিলা যদি টুনুকে নিতে চায় নিক না, টুনু তো ভালোই থাকবে। সে বাড়ি ফিরে এল। কখন গেল, টুনু টেরও পেল না।

সে তার নতুন বন্ধুর সাথে খেলায় ব্যস্ত। সাবিনা আবার হসপিটালে। লোকজন ধরাধরি করে নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে একজন আনিস। কাগজে সাবিনার ছবি দেখে খুশিতে ওর পিছু নিয়েছিল।

কিন্তু সাবিনা এত জোরে হাঁটছিল যে সে পুরো শব্দ মুখে আনতে আনতেই সাবিনা চলে যাচ্ছিল। চোখ খুলেই সাবিনা আনিসকে দেখতে পেল। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠল সাবিনা। ওর কান্না দেখে আনিস ও কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে সাবিনা দেখল আনিস আবার সেই প্যান্টটা পরেছে।

আবার হেসে দিল। কিছুক্ষণ পরেই এল সোবহান। সবিস্তারে বলল টুনুর বর্তমান সব ঘটনা। তার পাঁচ হাজার টাকার কথাও বল্ল। সাবিনা তাকে জানাল, সে গ্রামে চলে যাবে।

সোবহান মিয়া জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তোমার তো কেউ নাই গেরামে। যে কথা কখনো বলেনি, সে কথা আজই বলল, তার মা বাবা আছে। ভাইও আছে দুইটা। সে সবসময় তাদের জন্য টাকা পাঠাত। তাকে বিয়ে দেয়া হয় তার গ্রামের এক ছেলের সাথে।

সেই ছেলে বিয়ে করে এনে তাকে বেঁচে দেয় এক দালালের কাছে। সেখান থেকেই... সে কখনো একথা বলেনি যদি তাতে তার কাজ পেতে অসুবিধা হয়! সে আবার গ্রামে ফিরে যাবে,একটা ছোট্ট ঘর বানাবে, একটা গরু কিনবে। এগুলো বলতে বলতে দেখল আনিস তার বাঁশি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সাবিনা করুণ স্বরে আনিসকে জিজ্ঞেস করল, যাইবা আমার লগে? পূর্ণিমা রাইতে তোমার বাঁশি হুনুম! আনিস মৃদু হাসল। তার চোখের তারারা এখন আরো সুন্দর হয়ে জ্বলছে অনেক স্বপ্ন সাঝের প্রতীক্ষায়।

টুনুও ফিরে এসেছে মিসেস লুন্ডবার্গের বাড়ি থেকে। বুবুকে ছাড়া সে থাকতে পারবে না। তারা তিনজন ছুটে চলে গ্রামের দিকে, নাড়ীর টানে, নগ্ন শহরের পঙ্কিলতাকে পেছনে ফেলে, সম্পূর্ণ নতুন জীবনের আশায়, নতুন কিছু স্বপ্ন নিয়ে...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.