আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি

আমার সম্পর্কে বলার মতো কিছু নেই।

শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরিঃ বাংলাদেশে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি সবসময়ই একটা জ্বলন্ত ইস্যু। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে এ পর্যন্ত শ্রমিকদের যে সব বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ হয়েছে সেগুলির প্রধান দাবি ছিল মজুরি সংক্রান্ত। এমনকি মে দিবসে ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জাতীয় শ্রমিক লীগের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী যে ভাষণ দিয়েছেন তাতেও এ ইস্যুটিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি বলেছেন, বাজার পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হবে।

তাদেরকে বাঁচার মত মজুরি দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকের মজুরি নিয়ে আগ্রহ বেড়ে যায়। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমেও তা বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু কী হতে পারে বর্তমান বাজার অনুযায়ী শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি অথবা বাঁচার মত মজুরি? ''একজন মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে বেঁচে থাকতে হলে এবং কর্মঠ হিসেবে টিকে থাকতে হলে দৈনিক কমপক্ষে ২২০০ কিলো ক্যালরি তাপ উৎপাদন করার মত খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট যে খাদ্যতালিকা প্রণয়ন করেছে তাতে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের একদিনের প্রয়োজনীয় খাদ্যের জন্য কমপক্ষে ৫০ টাকা দরকার।

৪ সদস্যের একটি পরিবারের মাসের খাবার খরচ লাগে মাসে ৬০০০ টাকা। সাধারণত পরিবারের খাদ্যের জন্য ব্যয় ধরা হয় ৪৫%, ৫৫% ব্যয় হয় বাড়িভাড়া, যানবাহনব্যয়, কাপড়চোপড়, চিকিৎসা ও শিক্ষা ইত্যাদি খাতে। তাহলে এসব খাতে প্রয়োজন ন্যূনতম ৭৩৩৩ টাকা। মোট ব্যয় হওয়া উচিত (৬০০০ + ৭৩৩৩)= ১৩৩৩৩ টাকা। স্বামী-স্ত্রী দু'জন চাকরি করলেও বেতন হওয়া উচিত ন্যূনতম ৬৬৬৬.৫০ টাকা।

এছাড়া বহুল আলোচিত মিলেনিয়াম ডেভেলাপমেন্ট গোল-এ মাথাপিছু ২ ডলার আয়সীমা অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ২ জন চাকুরি করলে বেতন হওয়া উচিত ১২০ ডলার অর্থাৎ ৮৪০০ টাকা। ' তবে এদেশের বাস্তবতা, বিশ্ব অর্থনীতির সংকট বিবেচনায় জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশ- (জে এস এফ বি) ন্যূনতম মজুরি ৭০০০ টাকা দাবি করেছে। সেইসাথে প্রতিবছর জীবনযাত্রার ব্যয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে মহার্ঘ ভাতা প্রদানের স্থায়ী ব্যবস্থা ও প্রতি দু’বছর পর তা মূল বেতনের সাথে সমন্বয় করার দাবিও তারা জানিয়েছে। জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশ- (জে এস এফ বি) ন্যূনতম মজুরির পরিমাণ যা নির্ধারণ করেছে তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও জীবনযাত্রার চলমান ব্যয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও কনভেনশন ১৩১ অনুসারেও তা ঠিক আছে। ওই কনভেনশনের তিন নম্বর অনুচ্ছেদে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য 'শ্রমিক ও তার পরিবারের মোট চাহিদা, দেশের সাধারণ বেতন কাঠামো, জীবনযাত্রার ব্যয়, সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়সমূহ এবং সমাজের অন্যান্য গোষ্ঠী বা অংশের জীবনযাত্রার তুলনামূলক মান বিবেচনা' করার কথা বলা হয়েছে। অতএব মহাজোট সরকারের উচিত অবিলম্বে ন্যূনতম মজুরি ৭০০০ টাকা ঘোষণা করা ও তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নসহ আনুষঙ্গিক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে তেমন কোন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে ন্যূনতম মজুরির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছে।

কখনো কখনো এ আন্দোলন বেশ তুঙ্গে উঠেছে। ওই আন্দোলনের চাপে সরকার মজুরি কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু শ্রমিক অঙ্গনে আপোষকামী ও সুবিধাবাদী সংগঠনগুলোর প্রাধান্যের কারণে ওই চাপ সবসময় জারি রাখা যায়নি। ফলে সরকার তার ইচ্ছামত জাতীয় ন্যূনতম মজুরির ঘোষণা দিয়েছে, তা-ও আবার বাস্তবায়িত হয়নি বা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। যেমন, ২০০১ সালে সরকার জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করেছিল, ক্ষুদ্রশিল্পের জন্য ১২০০ টাকা, মাঝারি শিল্পের জন্য ১২৫০ টাকা ও বৃহৎ শিল্পের জন্য ১৩৫০ টাকা।

কিন্তু এর সপক্ষে প্রয়োজনীয় আইন না থাকায় মালিকপক্ষের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এ সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে। এর পর ২০০৬ সালে আবারও ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয় বিভিন্ন শিল্পের জন্য ২৪৫০ টাকা ও গার্মেন্টস শিল্পের জন্য ১৬৬২.৫০ টাকা। তৎকালীন বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী এটা একেবারেই সমুদ্রে বিন্দুবৎ। তারপরও তা সব কারখানায় বাস্তবায়িত হয়নি। জানা গেছে, অন্তত ৩০% পোশাক কারখানায় এ মজুরিও দেওয়া হয় না।

আবার যারা দিচ্ছে তারাও নানা উসিলা দেখিয়ে শ্রমিকের বেতন দু'-তিন মাস বকেয়া ফেলে রাখছে। এ পর্যন্ত যাদের নিয়ে আলোচনা হল তারা কিন্তু মোট শ্রমশক্তির ১০% ভাগ মাত্র। তারা সবাই প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। তারা নানা বাধা সত্ত্বেও একভাবে না একভাবে সংগঠিত, অর্থাৎ মালিক বা সরকারের সাথে যুঝার ক্ষমতা কিছুটা হলেও তারা রাখেন। প্রচলিত শ্রম আইনেও তাদের কথা সামান্য হলেও আছে।

কিন্তু বাকি ৯০ ভাগ শ্রমিকের অবস্থা কী? তারা সবাই ওয়েল্ডিং, মৎস্য, নির্মাণ, চাতাল, দোকান, ইটভাঁটা ও গৃহস্থালি ইত্যাদি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সংখ্যায় তারা ৬ কোটিরও বেশি হলেও প্রচলিত শ্রমআইনে তাদের কথা বলা নেই। তাদের বেলায় ন্যূনতম মজুরিরও কোনো বালাই নেই। তারা আক্ষরিক অর্থেই দিনে এনে দিনে খান। এসব কাজের অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ।

ঝুঁকি মোকাবেলায় ন্যূনতম সুরক্ষাও তারা পান না। আরো উদ্বেগের বিষয় হল, শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও এখানে প্রায় ৩৮ লাখ শিশু নিয়োজিত, যাদের মধ্যে ১৩ লাখ আছে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। এদেরকে মজুরিও দেওয়া হয় নামমাত্র। এখন এ রকম একটা পরিস্থিতিতে - যেখানে মালিক শ্রেণীর ইচ্ছা-অনিচ্ছাই চূড়ান্ত - প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়িত হবে কীভাবে? এজন্য সরকারকে প্রথমেই মালিকশ্রেণীকে আইনের আওতায় আনতে হবে। পৃথিবীর বহুদেশে তথাকথিত মুক্তবাজারের মধ্যেও ন্যূনতম মজুরি আইন আছে যা মালিকশ্রেণীকে মেনে চলতে হয়।

মুক্তবাজারের প্রবক্তা খোদ আমেরিকাতেই আইন অনুসারে যেকোন বৈধ শ্রমিককে ঘণ্টায় ন্যূনতম সোয়া ৬ ডলার মজুরি দিতে সংশ্লিষ্ট মালিক বাধ্য। এর ব্যত্যয় ঘটলে মালিককে জরিমানা গুণতে হয়। আমাদের দেশেও অন্তত এ আইনটুকু করতে হবে। এখানে যে শ্রমআইন চালু আছে তা চরম অগণতান্ত্রিক, মজুরি সংক্রান্ত কোনো বিধান এতে নেই, মালিকশ্রেণীর চলমান স্বেচ্ছাচারিতা জারি রাখতে তা সহায়তা করে। তাই শ্রমিক সংগঠনগুলো এ আইন প্রত্যাখ্যান করে আইএলও কনভেনশন মেনে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের মতামতের ভিত্তিতে একটা গণতান্ত্রিক শ্রমআইন প্রণয়নের দাবি তুলেছে।

কিন্তু মহাজোট সরকার কি তা বাস্তবায়ন করতে পারবে? অন্যদিকে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বের দাবিদার সংগঠনগুলোরও বেশিরভাগ আপোষকামী ও সুবিধাবাদী নেতৃত্বের দ্বারা আকীর্ণ। অতএব শ্রমিকদের স্বার্থের পক্ষে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলার সামর্থ্য এদের নেই। এ অবস্থায় সচেতন শ্রমিকদেরকে যেমন কারখানায় কারখানায় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে তেমনি একটা বিপ্লবী ধারার শ্রমিক সংগঠনকে চিহ্নিত করে তাকে শক্তিশালী করার কাজটুকুও এগিয়ে নিতে হবে। আমেরিকা ও ইউরোপের শ্রমিকশ্রেণী মালিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করেছেন। তারা তাদের জনপ্রিয় দাবি - ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম, ৮ ঘণ্টা বিনোদন - নিয়ে বহু বিক্ষোভ ও ধর্মঘট করেছেন, একপর্যায়ে রক্তও দিয়েছেন।

এ নিয়ে তাদেরকে বহু পথ হাতড়ে বেড়াতে হয়েছে। কিন্তু যখনই ওই আন্দোলন তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক ধারার নেতৃত্বের (সর্বহারার মহান নেতা ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ছত্রছায়ায়) নির্দেশনা পেয়েছে তখনই তা একটা যৌক্তিক পরিণতি পেয়েছে। আজকে বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণীকেও সমাজতান্ত্রিক বাম প্রগতিশীল ধারার নেতৃত্ব বেছে নিতে হবে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.