আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পারমানবিক শক্তি আসছে ঘরে ঘরে - স্বপ্ন না বাস্তব?

সৃষ্টিকর্তার সকল অপূর্ব সৃষ্টির মাঝে একমাত্র খুঁত সম্ভবত তাঁর সেরা সৃষ্টি ...

সম্প্রতি বাংলাদেশ এবং রাশিয়ার মাঝে হওয়া পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবার সংক্রান্ত একটি চুক্তি সাক্ষর করেছে। সকল টেকনিকাল এবং আইনগত টার্ম বাদ দিলে এ চুক্তির আসল যে অর্থ বের হয় তা হল, বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশনকে Rosatom বা রাশিয়ার স্টেট পারমাণবিক শক্তি কমিশন ৬০০ থেকে ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনে সহায়তা করবে। রাশিয়ার মুখপাত্র স্প্যাসকি অবশ্য সরাসরিই স্বীকার করেছেন তারা এ চুক্তি করেছেন আন্তর্জাতিক মহলে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে সকলকে উৎসাহিত করতে। এবং সেইসাথে এটাও বলেছেন যে রাশিয়া এই পাওয়ার প্ল্যান্টের ডিজাইন এবং নির্মাণে বাংলাদেশকে সাহায্য করবার জন্য আগ্রহী। এটা ভালোই বোঝা যায় যে শান্তি-টান্তি সব ভুয়া কথা, এটা রাশিয়ার জন্য একটা ভালো ব্যবসা ছাড়া আর কিছূই নয় কারণ বর্তমানে তারা ভারত, চীন এবং ইরানসহ আরো কয়েকটি দেশেই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বসানোর কাজ করছে।

কাজেই আপাত এই শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার চুক্তি কেবল একটা কুটনৈতিক টেন্ডারবাজি ছাড়া আর কিছূই নয়। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়াও যখন একই বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এটা তাদের কাছে একটা ভালো ব্যবসা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আমাদের জন্য কি এটা ভালো কিছু? আসলেই কি পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান করতে পারবে? নাকি উদ্যোগটা গরিবের ঘোড়া রোগ বা মতান্তরে নাজমুল হুদার ম্যাগনেটিক ট্রেন রোগের মতোই একটা ব্যাপার হয়ে থাকবে? আসুন ব্যাপারটা পর্যালোচনা করে দেখা যাক। কেন দরকার? বিদ্যুত সমস্যার মোটামুটি স্থায়ী সমাধান: বাংলাদেশে বর্তমান ৫০০০ মেগাওয়াট ইলেকট্রিসিটির চাহিদার বিপরীতে আমাদের পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো মাত্র ৩৫০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।

এতে এখনকার মতো গরমে জনজীবন যেমন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে লোডশেডিঙের প্রকোপে তেমনি ভাবে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন দেশের কৃষিকাজ এবং শিল্পোন্নয়ন। চুক্তি অনুযায়ী যদি দুটো হাজার মেগাওয়াটের পাওয়ার প্ল্যান্ট বাংলাদেশে তৈরী হয় তবে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো হয়তো তার বিদ্যুত সমস্যার সমাধানের কাছাকাছি চলে যাবে। গ্যাস শেষ হবার আগেই বিকল্প: বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ১.৬ বিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে শেখ হাসিনা তাঁর কথা ভঙ্গ করে গ্যাস রপ্তানি করা শুরু না করলেও আমাদের বর্তমান যে গ্যাস এবং কয়লা রিজার্ভ রয়েছে তা ২০১৬ সালের মাঝেই শেষ হয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ টোটাল ব্ল্যাকআউট ফেস করবে। কাজেই বিকল্প শক্তি হিসেবে পারমাণবিক শক্তি খুবই ভালো হবে।

গ্রীনহাউজ গ্যাস বিহীন পাওয়ার: গ্যাস এবং কয়লা চালিত পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো প্রতি বছর প্রায় দুই মিলিয়ন টন গ্রীন হাউজ গ্যাস পরিবেশে ত্যাগ করছে, গ্রীন হাউজ পলিউশনে পারমাণবিক শক্তির কোন প্রভাব নেই। নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট থেকে সাপ্লাই হবে নিরবিচ্ছিন্ন। যেহেতু আমাদের দেশে ইউরেনিয়াম নেই, কাজেই ইউরেনিয়াম ফুয়েল আাদের বাইরে থেকে কিনতে হবে, আর যতদিন ইউরেনিয়ামের মজুদ থাকবে পাওয়ার জেনারেশন অবাধ হবে। কেন বিপজ্জনক? হাতি পোষা: পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের জন্য আন্তর্জাতিক পারমানবিক কমিশন যে আটটি উন্নয়নশীল দেশকে মনোনয়ন দিয়েছিল তার মাঝে বাংলাদেশ একটা। যদিও বাইরে ভদ্রতা করে আমাদের উন্নয়নশীলের খেতাম দেওয়া হয়, তবুও আমরা ভালো করে জানি আমাদের সামর্থ্য কতটুকু।

বাংলাদেশের মতো একটা দেশে যেখানে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে মানুষ না খেয়ে থাকছে, মঙ্গায় অনাহারে মারা যাচ্ছে শিশুরা, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হচ্ছে না আর মাথার ওপর আছে বিশাল ঋণের বোঝা - সেখানে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বসানো আসলে কতটা যুক্তিসংগত? তাছাড়া নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের যে মেইনটেনেন্স এবং ইউরেনিয়াম ফুয়েল কেনার প্রতিনিয়ত যে বাধ্যতামূলক খরচ রয়েছে তা কি সরকারের কর্তা ব্্যক্তিরা ভেবে দেখেছেন? পর্যাপ্ত জায়গার অভাব: আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানেও পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র আছে। কিন্তু তারা সেগুলো নির্মাণ করেছে মরুময় এলাকায় যেখানে জনবসতি বিরল। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এরকম জায়গা খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর যদিও বা পাওয়ার প্ল্যান্ট জোরজুলুম করে জনবসতির কাছেই স্থাপন করা হয় তবে চেরনোবিলের মতো নিউক্লিয়ার মেল্টডাউন এর মতো একটা দুর্ঘটনা ঘটলে যে কি পরিমাণ বিপর্যয় হবে তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট নিউক্লিয়ার এনার্জির সবচেয়ে বড় সমস্যা হল তার ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট। নিউক্লিয়ার বর্জ্যকে কখনোই পুরোপুরি পরিশোধন করা সম্ভব নয়।

তাই যা করা হয় তা হলো খুব সেফ জায়গায় বর্জ্য ডাম্প করা হয় এবং পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। ৩০ থেকে ৫০ বছরের মাঝে বর্জ্যের রেডিও আ্যাকটিভিটি শেষ হয়ে তা নিরাপদ হয়ে যায়। কিন্তু একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া বাংলাদেশের এরকম কোন সেফ ডাম্পিং স্পট আছে কি? নিরাপত্তা নিউক্লিয়ার বর্জ্য থেকে পাওয়া প্লুটোনিয়াম এবং অন্যান্য ল্যান্থানাইড ও অ্যকটিনাইড নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। এজন্য নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট গুলো সবসময় আন্তর্জাতিক টেররিস্টদের লক্ষ্যবস্তু থাকে। বাংলাদেশে জঙ্গি সমস্যা এমনিতেই বিরাজমান, এবং যেখানে সরকারি মহলে দুর্নীতির মাত্রা রেকডৃ পরিমাণ - এই পরিস্থিতিতে আসলেই কি সরকার পাওয়ার প্ল্যান্টের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারে? হাতি পোষা ভালো, কিন্তু দীর্ঘজীবি হাতি হলে আরো ভালো: নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের আরেকটি বড় সমস্যা হল যে ২৫ বছরের পর এই পাওয়ার প্ল্যান্ট পুরোপুরি আউট অফ অর্ডার হয়ে যাবে।

এবং পাওয়ার প্ল্যান্ট বাধ্যতামূলকভাবে শাটডাউন করে দিতে হবে। কাজেই নিউক্লিযার প্ল্যান্ট কস্ট ইফেক্টিভ হলেও আমরা পুরোপুরি তার লাভ ওঠাতে পারবো কিনা আশা করি সরকার তা হিসাব করেই সদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কিছুটা পড়াশোনা করে আমার নিজের যা মনে হচ্ছে তা হল, এই পাওয়ার প্ল্যান্ট যে উদ্দেশ্যে স্থাপন করা হচ্ছে তা অন্তত বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কখনোই সফল হবে না। ম্যাগনেটিক ট্রেন যেমন আমাদের জন্য নয়, তেমনি পারমানবিক শক্তিও হয়তো আমাদের জন্য নয়। অন্যভাবে বলতে গেলে আমরাই হয়তো এখনো পারমানবিক শক্তি ব্যবহারের উপযুক্ত হয়ে উঠিনি।

সরকার যে সিদ্ধান্ত এত দ্রুত নিয়ে নিলেন তা আশা করি সব দিক বিবেচনা করে ভেবে চিন্তেই নিয়েছেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.