আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শ্রদ্ধাঞ্জলি : ভাষাসৈনিক গাজীউল হক আজ ভাষাহীন.......... .সোহেল মো. ফখরুদ-দীন

মানুষ যা কল্পনা করতে পারে, তা সে অর্জন করেত পারে।

আমাদের জাতিসত্তা বিনির্মাণে যে কজন মেধাবী ছাত্র শৈশব থেকে আন্দোলন করে দেশের মানুষের ভাগ্য বদল এবং বাঙালি জাতিকে শিকল পরা থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার সাধ পেতে সহায়তা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে গাজীউল হক অন্যতম। বাঙালি জাতির ইতিহাসে দুইটি আন্দোলনের কথা শুধু দেশবাসী নয় সমগ্র বিশ্ববাসীর জানা আছে। একটি আমাদের মায়ের ভাষা রক্ষা (বায়ান্নের মাতৃভাষা আন্দোলন), অন্যটি পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে স্বাধীনতা অর্জন, (স্বাধীনতা-৭১)। দুই আন্দোলনেই দেশপ্রেমিক নাগরিকগণ জীবন দিয়ে রক্ষা করেছেন বাঙালির সম্মান।

কালো পিচঢালা রাস্তা লাল হয়েছে বাঙালির জোয়ানের রক্তে। রক্তের জোয়ারে ভেসে গেছে পাক দোসররা। সেই সংগ্রামের মহান নেতার সম্মান অর্জনকারী বিপ্লবী বীরের নাম গাজীউল হক। জীবনযুদ্ধে আজ ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঢাকার রামপুরার নিবাসে ভাষাহীন অবস'ায় মৃত্যুর প্রহর গুণছে আমাদের জাতীয় বীর। আমরা সেই দিন (১৫/০৪/০৯) তাঁকে দেখতে ভাষা আন্দোলন যাদুঘরের পরিচালক ও সদস্য সচিব অধ্যাপক এম.আর মাহবুব, প্রত্নতত্ত্ব আলোকচিত্র মিউজিয়ামের পরিচালক অর্থ হেলাল উদ্দিন (টিপু) সহ রামপুরার বাসভবনে যাই।

তাঁর বাসার চার দেয়ালে এই বীরের সাথে ছবিতে দেখা যায় বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বের সাথে আলোকচিত্র। তাঁদের মধ্যে অন্যতম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নোবেল বিজয়ী বাঙালি অমর্ত্য সেন, জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব কফি আনানসহ বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সাথে ছবি। প্রতিটি ছবি যেন এক একটি অধ্যায়। আজ সেই অধ্যায় যেন বইপত্র, খাতা কলমে সীমাবদ্ধ রেখে ভাষাহীনভাবে দিন যাপন করছেন। কেউ দেখতে আসলে অবুঝ বাচ্চার মত শুধু চেয়ে থাকেন।

পরিচিত জন হলে চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ে পানি। গাজীউল হকের চোখের পানি বলে দেয় দেশপ্রেমিক মানুষ কাকে বলে? কপালে হাত দিয়ে আমি তাঁকে বললাম, স্যার জাতি হিসেবে আমরা বড়ই দুর্ভাগা যে আপনার মতো যোগ্য দেশপ্রেমিক মানুষকে মূল্যায়ন করতে পারিনি। তবে আমরা কথা দিতে পারি আমরা মূল্যায়ন করতে না পারলেও জাতির ইতিহাস আপনার মতো মহাবীরকে একদিন যথার্থ মূল্যায়ন করবে। তখন আমার দিকে চেয়ে থেকে মৃদু হাসেন আর চোখ দিয়ে ঝর্ণার ধারার ন্যায় পানি ঝরছে। গাজীউল হকের সাথে আমার পরিচয় হয়- আমার লেখা প্রথম নাটক “মানিকের রক্তাক্ত বাঁশি” মঞ্চায়নের দিন।

৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে পটিয়ায় হাইদগাঁও বিজয় মেলায়। বিজয় মেলার অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন। অবশ্য সেই দিন বিজয় মেলায় একই মঞ্চে নাট্য ব্যক্তিত্ব নাদের খানও এসেছিলেন। আমি তখন সাতবাড়ীয়া নাট্য গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক। সেই সময়ে আমাদের বাম রাজনীতি জগতের সংগঠক সাইফুদ্দীন খালেদ বাবুলের আমন্ত্রণে বিজয় মেলা আমার নাটকটি মঞ্চায়ন করতে আমরা দলবল নিয়ে এসেছিলাম।

অবশ্য পরে সাইফুদ্দীন খালেদ বাবুল বাম রাজনীতি ছেড়ে ভিন্নপথে চলে যান। ১৯৪২ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস পালনের কতই আয়োজন চলছে। অন্যদিকে রাজনীতির মিছিলে মিছিলে একাকার ফেনীর মফস্বল জনপদ। ঐ মিছিলের সামনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন এক দুরন্ত কিশোর গাজীউল হক। তাঁর ডর নেই, ভয় নেই।

ওঁৎ পেতে ছিল সে একটা ঘটনা ঘটবার জন্য। প্রতিবাদ তাঁকে করতে হবে। মিছিল থেকে দৌঁড়ে গিয়ে থানার শীর্ষে উড়ন্ত ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা খাবলে ধরলো। টেনে ছিঁড়ে নামিয়ে ফেলল পতাকা। আর ইউনিয়ন জ্যাক পতাকার প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের জন্য দুরন্ত এই কিশোরকে জীবনে প্রথম অন্ধকার হাজতে বাস করতে হলো।

সেই দিনের ইতিহাসের প্রতিবাদী কিশোর আমাদের গাজীউল হক। আ.ন.ম গাজীউল হক ১৯২৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলা ১৩৩৫ সনের ১ ফাল্গুন ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিচিন্তা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাড়ির পাশের মক্তব থেকে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু। ১৯৩৫ সালে দু’টাকায় হাজী মোহাম্মদ মহসীন বৃত্তি নিয়ে, নিম্ন প্রাইমারি পাস করে কাশীপুর উচ্চ প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৭ সালে পুনরায় চার টাকার মহসীন বৃত্তি নিয়ে উচ্চ প্রাইমারি পাস করেন।

এবং ছাগলনাইয়া হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেখানেই প্রতিবাদী এ গাজীউল হক রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন। দেশবরেণ্য ধর্মীয় সু-পণ্ডিত পিতা মাওলানা সিরাজুল হক এবং তাঁর পরিবার কিশোরের কর্মকাণ্ড দেখে দিশেহারা হয়ে পড়েন। উপায় না দেখে কিশোর গাজীউল হককে শিক্ষা ও নিরাপত্তার কারণে বগুড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। ভর্তি করা হয় বগুড়া জেলা স্কুলে।

১৯৪৬ সালে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে বৃত্তি নিয়ে ম্যাট্রিক পাস এবং ১৯৪৮ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ছাত্র গণ-আন্দোলনে ভীষণভাবে জড়িয়ে পড়েন। বগুড়া থাকা অবস্থায় গাজীউল হক ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে বগুড়ায় নেতৃত্ব দেন। ১৯৫১ সালে ইতিহাসে অনার্স এবং ৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাস করেন। রাজনীতির কারণে তখনকার কর্তৃপক্ষ তাঁর ডিগ্রীও কেড়ে নেয়। অবশ্যই ছাত্র সংগ্রামী জনতার চাপের মুখে তা আবার ফিরিয়ে দেন।

এ টগবগে যুবক ৫২ সালে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। আন্দোলন করেন সেজন্য তাঁর ওপর শুরু হয় বিভিন্ন জুলুম, অত্যাচার ও জরিমানা। আন্দোলন, রাজনীতি, দেশপ্রেম-গণমানুষকে ভালবাসার অপরাধে গাজীউল হককে জীবনে অনেক বার জেল বরণ করতে হয়েছে। ১৯৫৬ সালে তাঁর পিতা মাওলানা সিরাজুল হক মারা গেলে জেল থেকে প্যারোলে কিছু সময় মুক্ত হয়ে পিতার দাফন কাজে অংশ নেন এবং আবারও জেলে। এতে গাজীউল হক ভেঙে পড়েন নি।

তবুও তিনি সংগ্রামী। সংগ্রাম ও দেশের মানুষের মুক্তির শপথ নিয়ে যেন পৃথিবীতে আসা, সেখানে তাঁর জন্মের সার্থকতা। মানুষের মন জয় করতে সক্ষম পুরুষ গাজীউল হক। অত্যাচার ও বেআইনিভাবে জুলুম সইতে সইতে নিজে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তিনি আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেন।

১৯৭২ সাল থেকে হাইকোর্টে এবং পরে সুপ্রিম কোর্টে সাফল্যের সঙ্গে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৭১ সালে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। সময়ের তাগিদে অথবা জীবন জীবিকার প্রয়োজনে তিনি কখনো হয়েছিলেন সাংবাদিক, পত্রিকার হকার, প্রাবন্ধিক, কথাশিল্পী, কবি ও গীতিকার। প্রত্যকটি কর্মে তিনি সফলতা লাভ করতে পেরেছিলেন। গাজীউল হক বেশ ক’টি গ্রনে'র রচয়িতা হলেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রথম লেখা গ্রন' “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” ব্যাপকভাবে সাড়া জাগায়।

বাংলা একাডেমি ও দেশের বিভিন্ন প্রকাশনা সংস'া ছাড়াও ইংরেজি ভাষায় বিদেশেও তাঁর একাধিক গ্রন' এবং নিবন্ধ প্রকাশ হয়। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনের তিনি সংগ্রামী পথিকৃৎ। সেই উচ্চ আদালতে বাংলা প্রসঙ্গে তাঁর এক গ্রনে' তিনি লিখেছেন “ভাষা সৈনিকদের সম্মেলন শেষে ১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের বেদীমুলে দাঁড়িয়ে শহীদ রফিকের মা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তোমরা উচ্চ আদালতে বাংলা বলো কি না? উত্তর দিতে পারিনি। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও সর্বস্তরে এখনো আমরা বাংলা প্রচলন করতে পারিনি। সুতরাং এ লজ্জা ঢাকতে চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করেছি”।

সেই ভাষা সংগ্রামের ভাষার মানুষ আজ শব্দহীন, ভাষাহীনভাবে জীবন যাপন করছে। আমি, আমরা সবাই এক বুক আশা নিয়ে সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত নিবেদন জানাবো মৃত্যুর পর মরণোত্তর নয়, জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বোচ্চ সম্মান তাঁকে দেয়া উচিত। আমাদের ইতিহাসের জাগ্রত বিবেক ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান সৈনিক গাজীউল হককে অচিরেই এই সম্মান দেয়া হোক। ইতিহাসতো নিজের গতিতে চলে। সময় কাল পেরিয়ে গাজীউল হককে মূল্যায়ন করা সরকারিভাবে এখন সময়।

তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য হিসেবে নয়। জাতির উন্নয়ন, মায়ের ভাষার স্বীকৃতি, স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন পাওয়া আমাদের কাছে বড় কিছু নয়। গাজীউল হক জীবনব্যাপী কর্মে ও সাধনায় জাতিকে দিয়েছেন অনেক। কিন' তাঁর পাওয়ার খাতায় শূন্য। শূন্য গাজীউল হকের চলে যাওয়া দেশের কোন মানুষের কাম্য নয়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।