আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের সমাজের একজন তৃষ্ণা চক্রবর্ত্তী

মানুষে মানুষে সমানাধিকারে বিশ্বাস করি

৪০ বছর বয়স অথবা কয়েক বছর মাত্র । কয়েক বছরই আমাদের কাছে তার বয়স। এইতো সেদিন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাতক্ষীরা জেলা শাখা গঠনের ভার নেয়ার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল যে নারীর গৃহস্থালীর বাইরে ক্ষয়িষ্ণু সমাজের মাঝে নারী মুক্তির স্বপ্নযাত্রা আজ সে আর নেই! তৃষ্ণা চক্রবর্তী দীর্ঘদিন পরিচিত ছিলেন বন্ধুবৎসল, সাতক্ষীরা সুধি সমাজের সুপরিচিত আইনজীবী এড. তপন চক্রবর্তীর স্ত্রী ও আগরদাঁড়ির বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন ঘোষালের কন্যারুপে। তারই বোন তন্দ্রা ভট্টাচার্য যিনি কিনা দীর্ঘদিন যশোর জেলা মহিলা পরিষদের সাথে জড়িত আছেন তিনিই তৃষ্ণা চক্রবর্তীকে সাতক্ষীরাতে মহিলা পরিষদের সংগঠন শুরু করার জন্য প্রভাবিত করেন। এরপরের ইতিহাস সাফল্য, সম্ভাবনা এবং বিস্ময়ের।

সাতক্ষীরা যে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার আবরণে মোড়া বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি থেকে পিছিয়ে থাকা এক জনপদ এ বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। এহেন সাতক্ষীরায় নারীর অধস্তনতা এবং পুরুষতন্ত্রের ভিত ভাঙ্গার সংগ্রাম সূচনা করার সাহস যে নারী দেখিয়েছিল মৃত্যু তাকে অমরত্ব দিয়েছে মাত্র, মৃত্যুঞ্জয় তৃষ্ণা চত্রবর্তীর স্মৃতি সাতক্ষীরার নিপীড়িত সকল নারীর জন্যই শক্তি। তার অকাল দেহত্যাগ সাতক্ষীরার নারী মুক্তি আন্দোলনে যে শূন্যতা তৈরী করবে তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় যখন তপন দা’ এবং অপু (অর্পণ,আইনের শেষ বর্ষের ছাত্র, তৃষ্ণা চক্রবর্তীর একমাত্র সন্তান) তৃষ্ণা চক্রবর্তীকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নেন তখন অসুস্থ সাংবাদিক সাতক্ষীরায় প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক কল্যাণ ব্যানার্জিকে দেখে ফিরছিলাম আমি, প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারী এবং পৌর কাউন্সিলর সৈয়দ মাহমুদ পাপা। জরুরী বিভাগে ঐ রাতে ভিড় কেন সেই কৌতুহল নিবারণ করতে গিয়েই জানতে পারলাম অসুস্থ ব্যক্তি আমাদেরই তৃষ্ণা দি’।

রাত ১২ টায় ১নং কেবিনে তাকে শায়িত অবস্থায় রেখে যখন বাসায় ফিরি তখনও নিশ্চিত ছিলাম সকালেই সেরে উঠবেন তিনি, ফোন করে বলবেন, ‘কই বাউল ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে আমরা কি অনুষ্ঠান করব ঠিক করলেন না তো?’ যে কথা বলতে এসে আগের দিনই বিকেলে আমার অফিস থেকে ফিরে গিয়েছেন আমাকে না পেয়ে। কথা বলবার জন্য ফিরে তিনি এলেন না আর, ফিরে এলো তপন দা’ আর অপুর বিধ্বস্ত মুখ। সাতক্ষীরা থেকে যশোর হয়ে ঢাকা নেওয়ার পথে ৩১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ ভোর ৪টায় মারা গেলেন সাতক্ষীরার প্রথম এবং একমাত্র চলচ্চিত্র সংগঠন সাতক্ষীরা ফিল্ম সোসাইটি’র সাধারণ সম্পাদক, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি (ঢাকায় কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর যা দেশের ৬৩ জেলার মধ্যে প্রথম ) সাতক্ষীরার সদস্য সচিব আর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সাতক্ষীরার সাধারণ সম্পাদক তথা প্রাণ তৃষ্ণা চক্রবর্তী। বেশ কিছুদিন ধরে হার্টের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। যদিও বাইরে তার প্রকাশ ছিলনা কখনও।

ঢাকার এ্যাপোলো হসপিটাল, ভারতের বিরলা হার্ট ফাউন্ডেশন উভয় স্থানে তাকে চিকিৎসা করানো হয়। দু’স্থানে দু’রকম চিকিৎসা পরামর্শ তার পরিবারকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা সমস্যায় ফেলে। তারপরও আসছে ডিসেম্বরে তার বুকে ‘পেস মেকার’ বসানো হবে এমনটিই শুনেছিলাম। কিন্তু সে সময় নিয়তি তাকে দেয়নি। যেমনটি মান্না দে তার বিখ্যাত -সে আমার ছোটবোন গানে গেয়েছিলেন, ‘....তবুও শ্রোতারা তাকে দিল না রেহাই শেষ গান গাইলো সে পরে শেষ মালা’, আমরাও তাকে রেহাই দিইনি।

বিগত কিছুকাল যাবৎ সাতক্ষীরাতে নারী প্রগতি তথা নারী-পুরুষের সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার স্বপক্ষে কোন মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান তৃষ্ণা চক্রবর্তীর সক্রিয় উদ্যোগ ছাড়া হয়েছে এমনটি আমার জানা নেই। প্রতিটি অনুষ্ঠানে দাওয়াতপত্র বিতরণ করার পর একাধিকবার সবাইকে মনে করিয়ে দেয়ার কাজটি নিরলসভাবে করে এসেছেন তিনি। তার যে সমস্ত গুণাবলী তাকে এত স্বল্প সময়ের মধ্যে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য করেছিল তা হলো তার সামজিকতাবোধ এবং কাজের প্রতি নিষ্ঠতা। তার সামাজিক অবস্থান এবং পারিবারিক সহযোগিতার ভূমিকাও এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। তৃষ্ণাদি’ পূর্ণাঙ্গ ছিলেন এমন দাবি আমি করি না, কিন্তু তিনি ছিলেন পরিপূর্ণভাবে ‘সম্ভাবনাময়’।

এই সম্ভাবনা ক্রমেই পরিণত হয়ে উঠছিল নারীমুক্তির আলোকময়তায়। স্বীয় পরিচয় নির্মাণের এই স্বার্থকতার কারণেই মৃতদেহ আসার পর তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সর্বস্তরের মানুষের যে শোকাবহ ঢল নেমেছিল তা কোন সাধারণ গৃহকর্ত্রীর মৃত্যুতে নয়। জাতিসংঘ থেকে পুরস্কৃত শ্যামনগরের শামীমা খাতুনকে স¤প্রতি তার স্বামী নির্যাতন করার পর শামীমাকে স্বসম্মানে স্বীয় গৃহে প্রতিষ্ঠিত করার যে দায়িত্ব তৃষ্ণা দি’- কে আমরা সবাই দিয়েছিলাম তার সফলতায় এখন শামীমা অধিকার নিশ্চিত করেই ফিরেছে নিজের গৃহে। এমন অসংখ্য নারীকে নানাভাবে সহযোগিতা করতেন তিনি ও তার সংগঠন। তার সম্পাদনায় জানুয়ারী’০৯ থেকে সাতক্ষীরায় একটি নারী প্রগতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশের সকল প্রস্তুতি আমরা সম্পন্ন করে ফেলেছিলাম।

তার মৃত্যু এই বৈপ্লবিক উদ্যোগটিকে পিছিয়ে গিয়েছে নিঃসন্দেহে। তৃষ্ণা চক্রবর্তীর মৃত্যু সাতক্ষীরার নারীমুক্তি আন্দোলনের সদ্য গড়ে ওঠা সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অধ্যায়টিকে যারপরনাই দূর্বল করবে একথা বলা অত্যুক্তি নয় মোটেও। মৌলবাদের কালো থাবায় যখন আমাদের পশ্চাৎগমন প্রতিরোধে আরও অনেক তৃষ্ণা চক্রবর্তীর দরকার তখনই জীবন প্রদীপ নিভে গেল আমাদের একমাত্র তৃষ্ণা চক্রবর্তীর। বিদ্যাসাগর তার কাল থেকে যতটা অগ্রসর ছিলেন, রোকেয়া তার সময় থেকে যত বেশি অগ্রণী ছিলেন আমাদের বাংলাদেশ, আমাদের প্রাণের সাতক্ষীরা নারীর সমানাধিকার বিচারে ততটাই পিছিয়ে। এই অনগ্রসর সমাজে একজন তৃষ্ণার ‘নারী মানুষ’ হয়ে ওঠা ছোট কোন ঘটনা নয়।

মার্কসের যে কথা পুরনো হয়নি আজও তা হলো, ‘কোন সমাজ কতটুকু এগিয়েছে তা নির্ভর করে ঐ সমাজে নারীর মুক্ত অবস্থা বিচারে’। সে বিচারে আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্বব্যবস্থার দ্বারা অধস্থন নারীকে অবদমনের সমাজ। আর তৃষ্ণা দি’ আমাদের সাতক্ষীরার ক্ষণজন্মা মেরি ওলস্টোনক্রাফট এ কথা স্বীকার করতে আমার কোন আড়ষ্ঠতা নেই। আমাদের আশা তার কর্ম, তার স্মৃতি আরও অনেক অধিকার সচেতন এবং অবশ্যই সক্রিয় নারীর জন্ম দেবে এই সাতক্ষীরায়। এই প্রত্যাশাও যেন বেঁচে থাকে চিরসবুজ সদাহাস্য তৃষ্ণাদি’র মতো।

সুপ্রাচীন এ পৃথিবীর টিকে যাওয়া মহাকাব্যগুলির মধ্যে প্রাচীনতম (খ্রিঃপূঃ ২০শতক) সুমেরীয় সভ্যতার ‘গিলগামেশ’-এ বলা আছে, “সবচেয়ে উঁচু যে মানুষ সেও কখনও আকাশ স্পর্শ করতে পারে না। সবচেয়ে গাট্টাগোটা যে মানুষ সেও শক্তিশালী নয় পৃথিবীর কাছে। মানুষেরা অতিশয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব”। তৃষ্ণা দি’র অকালপ্রয়াণ এর সত্যতা আমাদের নিশ্চিত করেছে বটে কিন্তু মানুষের সৃষ্টিশীলতা, কর্মতৎপরতার শক্তিও অসীম। তৃষ্ণা চক্রবর্তীর ফেলে যাওয়া কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে একথা প্রমাণের দায় সাতক্ষীরার নারীদের।

সহযোগিতার জন্য আমরা আছি সবসময়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.