আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেশে এবং বিদেশে সমান নির্যাতিত বাংলাদেশী শ্রমিকেরা- শুভ্রা চক্রবর্তী

চোখ খুবলে নেয়া অন্ধকার, স্ফুলিঙ্গ জ্বেলে দাও!

দেশে এবং বিদেশে সমান নির্যাতিত বাংলাদেশী শ্রমিকেরা - শুভ্রা চক্রবর্তী গত মাসেরই ঘটনা। ন্যায্য মজুরির দাবিতে আন্দোলনরত বাংলাদেশী শ্রমিকদের রক্তে রাঙা হলো কুয়েতের রাজপথ। আন্দোলনরত শ্রমিকদের রক্তাক্ত করে খালি হাতে দেশে ফেরত পাঠালো কুয়েত সরকার। শ্রমিকদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হলো যে তারা যানবাহন ভাংচুর ও কুয়েতি পুলিশদের আহত করেছে। তাই নির্বিচারে ১০০০ শ্রমিককে গ্রেফতার করা হলো।

৮শ'র অধিক শ্রমিককে শাস্তিস্বরূপ দেশে পাঠানো হলো। বাংলাদেশ সরকারের এনিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা দেখা গেল না। কিন্তু শ্রমিকদের এ আন্দোলন আমাদের সামনে পরিষ্কার করলো এ নির্মম নির্যাতনের ইতিকথা। এবং আবারো সামনে তুলে ধরলো শ্রমিক আন্দোলনের ন্যায্যতা। দুর্ভাগা শ্রমিকদের জন্য এদেশ ও জাতি কিছু করতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু শ্রমিক আন্দোলন যে শক্তি ও সাহস প্রদর্শন করলো তা আবারো আমাদের আশাবাদী হতে শেখায়।

নির্মম নির্যাতনে পিষ্ট বাংলাদেশী শ্রমিকেরা শ্রমিক আন্দোলনের পর শ্রমিকদের ন্যুনতম ৪০ কুয়েতি দিনার (১০৩০৬ টাকা) এবং নিরাপত্তা রক্ষীদের বেতন ন্যুনতম ৭০ কুয়েতি দিনার (১৮০৩৫) টাকা করার বিধান করা হয়েছে। যেসব কোম্পানীর শ্রমিকেরা আন্দোলন করছেন মাসিক ৫০ কুয়েতি দিনারের চুক্তিবদ্ধ হলেও তারা মজুরী পেত ৮দিনার। কোনো কোনো কোম্পানীর শ্রমিকেরা নয় মাস যাবত বেতন পায়নি। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতেও আমরা বুঝতে পারি বর্তমান যুগে ২০০০-৫০০০ টাকা মজুরী কতটা অমানবিক! কুয়েতে কর্মরত শ্রমিকরো মুলত মিউনিসিপ্যালিটি, হাসপাতাল, অফিস, দোকান, স্কুল, মসজিদ পরিষ্কার করার সাথে জড়িত। তাদের খুবই কম এবং অনিয়মিত বেতন দেওয়া হয়।

কারাগারের মত ঘরে এ শ্রমিকরো বাস করে। তাদের চাকরির চুক্তি মেয়াদের ২-৩ বছরের অর্জিত অর্থ রিক্রুটিং এজেন্সিকে প্রদত্ত টাকা উপার্জনে শেষ হয়ে যায়। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের আইনি উপার্জনের পাশাপাশি কুলিগিরী থেকে শুরু করে সব রকমের কাজ করতে হয়। তারা নিয়মিত সাপ্তাহিক ছুটি পায় না। এশিয়ানরা কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের এ সব দেশে নিম্ন মজুরি, অতিরিক্ত সময়ের কাজ, কর্মক্ষেত্রে অনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সেবা না পাওয়া, শারীরিক এবং যৌন নিপীড়নের শিকার।

বাঙালী শ্রমিকরো মজুরী বৈষম্যেরও শিকার। মধ্যপ্রাচ্যে একজন বাংলাদেশী শ্রমিক পান ৩০০-৪০০ রিয়াল, যেখানে শ্রীলংকা বা পাকিস্তানি শ্রমিকেরা পান ৭০০-৮০০ রিয়াল। দীর্ঘদিন যাবৎ চলমান এসকল নির্যাতনই এশিয়ান বাধ্য করে আন্দোলনের পথ বেঁচে নিতে। কারণ, এ সব নির্যাতনের প্রতি নির্বিকার তাদের স্বদেশ এবং চাকুরিদাতা দেশের কর্তৃপক্ষ। তাই নির্যাতন প্রতিরোধে নিরুপায় শ্রমিকেরা ন্যায্য মজুরী, মানবিক কর্মপরিবেশ এবং নিয়মিত মজুরী প্রদানের দাবিতে আন্দোলন করে।

নির্যাতন এখানেই শেষ নয় কুয়েতে শ্রমিকদের উপর চলমান বৈষম্য ও নির্যাতন এবং কুয়েত সরকার দাবি মেনে নেওয়ায় এ আন্দোলনের বৈধতা প্রমাণ করে। কিন্তু যে কোনো দেশের সরকারের মত কুয়েত সরকারও এ আন্দোলনের বস্তুগত কারণকে সমাধানের উদ্যোগের চেয়ে শ্রমিকদের উপর আরও নির্যাতন চালানোর পথই বেছে নেয়। এমনকি আন্দোলনের সাথে জড়িত নয় এমন শ্রমিকদেরও গ্রেফতার করে তাদের খালি হাতে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তাদের উপর চলে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন। দেশে ফেরত আসা প্রতিটি শ্রমিকদের রক্তাক্ত দেহ তার স্বাক্ষী।

কেবল কুয়েত নয় সারা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে একই অবস্থা সারা বিশ্বের মোট ১০০ টি দেশে ২.৪ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত আছেন। এর বেশীর ভাগই মধ্য প্রাচ্যে কর্মরত। এদের ৮০ ভাগ নিম্নতম মজুরী পান। গত বছরে শ্রমিকেরা দেশে মোট ৭-৯১ বিলিয়ন রেমিটেন্স পাঠান। যেখানে ৪-৯৮ বিলিয়ন আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এবং ৩-১৯ বিলিয়ন আসে আরব ও কুয়েত থেকে।

কিন্তু সব জায়গাতেই শ্রমিকদের উপর চলে সমান নির্যাতন। মালদ্বীপের মতো একটি ছোট দেশেও নির্যাতনের পর একজন বাংলাদেশি শ্রমিককে খুন করা হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতে শ্রমিকেরা যখন নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা এবং দেশে ফিরতে চায় তখন কর্তৃপক্ষের অত্যাচারের সম্মুখিন হয়। আর কুয়েতের প্রেক্ষিতে বর্ণিত অত্যাচারের এসব দেশের ক্ষেত্রেও সত্য। নির্যাতন সত্ত্বেও নির্বিকার বাংলাদেশ সরকার শ্রমিক আন্দোলনের পরে বাংলাদেশের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের গ্রেফতার করা হলেও সে সব দেশের দূতাবাস তাদের দ্রুত মুক্তির পদক্ষেপ নেয়, সেখানে বাংলাদেশি দূতাবাস ছিলো সম্পূর্ণ নির্বিকার।

তারা আন্দোলনের বেশ কয়েকদিন পর কুয়েত সরকারকে নির্দোষ শ্রমিকদের গ্রেফতার না করার অনুরোধ করলেও তা মানাতে পারেনি। কুয়েতি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সরকারকে ভিডিও পে দেখিয়ে তথাকথিত দোষী শ্রমিকদের গ্রেফতার করার কথা বললেও গণহারে গ্রেফতার, নির্যাতন ও দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার কোনো প্রতিবাদ তো দূরের কথা নিন্দাও করেনি। শ্রমিকেরা দেশে ফেরার পর তাদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা করেনি। কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যে চলমান নির্যাতনের কারণে যে শ্রমিক বিপদ ঘটতে পারে সে বিষয়ে ৮ মে ২০০৮ এফবিসিসিআই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলো।

কিন্তু সরকার কোনো আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এসব দেশে বাংলাদেশের যে সব শ্রমিক কাউন্সি ল আছে তারা শ্রমিকদের সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করে এবং তাদের সমস্যা সমাধানের কোনো পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করে না। গত বছর দুর্নীতিবাজ রিক্রুটিং এজেন্সির হাতে পড়ে ১১ বাংলাদেশী শ্রমিকের মৃত্যু হয় এবং ২৪ জন শ্রমিকের পরিত্যক্ত হওয়ার ঘটনায় সরকার দুটি কমিটি গঠন করে। কিন্তু এসব তৎপরতা থেমে যায়। এভাবে দেশে ও বিদেশে শ্রমিকদের স্বার্থের প্রতি উদাসীন বাংলাদেশ সরকার।

সমগ্র বিষয়টিকে আরেকটু গভীরে গিয়ে ভেবে দেখা যাক বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প তথা জাতীয় অর্থনীতিকে সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদের স্বার্থে ক্রমাগত ধ্বংস করা হচ্ছে। এর ফলে দেশের প্রয়োজনীয় উৎপাদন ক্ষেত্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং জনগণ কর্মসংস্থাসনর সুযোগ হারাচ্ছে। ফলে তৈরি হচ্ছে সস্তাশ্রমের এক বিশাল মজুর বাহিনী। আমাদের দেশে এই সস্তাশ্রমের সুযোগ নিয়ে যেমন এদেশে বিদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শিল্প, ব্যবসা, ফুলে ফেঁপে উঠেছে (গার্মেন্টস শিল্প), তেমনি আবার আমাদের দেশের শ্রমিকেরা কম মজুরিতে মূলত দাসবৃত্তি করতে বাধ্য হচ্ছে বাইরের দেশগুলোতে। দেশের কাজের সুযোগ ও খেয়ে পরে বেঁচে থাকার সুযোগ না থাকায় দেশের মানুষ শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যান এবং চরম অপমান শোষণ ও বৈষ্যমের শিকার হন (সাম্প্রতিক কুয়েতের শ্রমিক আন্দোলন এমনই এক শোষণচিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরে)।

সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ তথা বিদেশীদের দালাল এদেশী শাসকগোষ্ঠীই দেশে কিংবা বিদেশে শ্রমিকদের উপরে শোষণের পেছনে দায়ী। কারণ, তারা দেশের স্বার্থকে বিদেশীতের হাতে বিকিয়ে দিয়েছেন যার করুণ পরিণতি এককভাবে ভোগ করেছে এদেশের কৃষক শ্রমিক মধ্যবিত্ত নিপীড়িত মানুষ। তাই এরা কি আমাদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করবেন? কখনোই নয়। এই ব্যবস্থা, এদের উচ্ছেদের মাধ্যমে আমাদের নিজেদরে করতে হবে। দেশে-বিদেশে মহান শ্রমিক জনতার আন্দোলন এই সত্যকে আমাদের সামনে তুলে ধরে।

এই আন্দোলন তাই ন্যায্য, মহান ও শিক্ষনীয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.