আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জটিল সব ভাবনাগুলো

I am the red thread Between Nothingness And Eternity

Saturday Night, সিনেমা দেখে বের হতে হতে রাত ১:৩৫ টা বেজে গেছে। হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি বাস স্টেশনের দিকে। রাস্তায় মানুযের এলোমেলো হাটাচলা দেখতে দেখতে পৌছে গেলাম বাসস্টপে। রবিবারে বাস সার্ভিস এমনিতেও অনেকক্ষন পরপর, তার মধ্যে এখন গভীর রাত, যদিও দেখে বোঝার কোন উপায় নেই। সবাই নাইট ক্লাব অথবা পাব থেকে বাড়ী ফিরছে হইচই করতে করতে।

বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে চারপাশে তাকিয়ে দেখছি নানারকম মানুষদের। একটা মেয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের জুতোর দিকে তাকিয়ে আছে, যেন পৃথিবীর সব রহস্যের সমাধান সেখানেই লেখা আছে। হঠাৎ তাকালো আমার দিকে, ক্লান্ত কিন্তু কোন জড়তা নেই সেই দৃষ্টির মধ্যে। চোখ সরিয়ে নিলাম আমি, হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার দেশের কথা। অকারনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল, আমার দেশে এত রাতে মেয়ে তো দূরের কথা, সুস্থ মস্তিস্কের কোন লোক কোন বাসস্টপে দাড়াবার আগে দশ-বারবার চিন্তা করবে।

কেন আমি আমার দেশে যখন তখন বের হতে পারবনা? হঠাৎ করে মনেহল এটা আর এমন কি ব্যাপার, এমনতো আরো কতকিছুই আছে যেগুলো আমি দেশে করতে পারিনা। সেদিন গেলাম এক বাংলাদেশী কমিউনিটিতে, কথায় কথায় উঠল দেশে ফেরার কথা। সবাই চিন্তিত দেশের বর্তমান অবস্হা নিয়ে, একজন বলে উঠলেন, "মানুয যে কেমন করে থাকে বাংলাদেশে? থাকার মত অবস্হা কি আছে সেখানে?" আমি একটু অবাক হয়েই তাকালাম উনার দিকে, এখানে এসেছেন ৩ বছরও হয়নি, এর মধ্যেই উনি ব্রিটিশ বনে গেছেন। আমি বললাম, "এখানে একটা থার্ড ক্লাস সিটিজেন হয়ে থাকার চেয়ে কি নিজের দেশে ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেন হিসেবে থাকাটা ভালো না?" উনি একটু আহত কন্ঠে বললেন, "দেশে কি ভালোভাবে থাকার কোন উপায় আছে? সকালে উঠে অফিসে যাবেন, দেখবেন সিএনজি যেতে চাইবেনা। বাসে করে যাবেন, পকেটমারের ভয়, তার উপর ঘেমে একাকার হয়ে অফিস পৌছতে হবে।

পানি নেই, ইলেক্ট্রিসিটি নেই, ভয়াবহ গরম, রাস্তায় কোন সিকিউরিটি নেই, দোয়া দরূদ পড়ে বের হতে হয়, চাঁদাবাজির ভয়। কোন কিছুই তো শান্তিমত করতে পারবেননা। কেমন করে থাকবেন দেশে?" আমি গোঁয়াড়ের মত বললাম, "যেভাবে আগে থেকেছি সেভাবেই থাকব, আমি এখানে থাকতে আসিনি, পড়তে এসেছি। পড়া শেষ হলেই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাব। " উনি তাচ্ছিল্যভরে বললেন, "এখনো তো পড়া শেষ হয়নি, তাই রক্তগরম।

আরও কিছুদিন যেতে দিন, আপনিও যেতে চাইবেননা। " "আপনার ধারনা ভুল" বলে আমি চলে আসলাম। বাসায় এসে ভাবতে লাগলাম উনার বলা কথাগুলো নিয়ে। যদিও সমস্যাগুলো আছে অস্বীকার করার উপায় নেই। নানারকম জটিল চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।

কেন এত পিছিয়ে আছি আমরা? কেন এত চিন্তা করতে হয় নিজের দেশে ফেরার কথা ভাবার আগে? কবে আমরা সত্যিকারের স্বাধীনতা পাবো? সবকিছুর জন্য কারা দায়ী? আমি? আমরা? আপনি? নিশ্চয়ই আমি একাই এইসব ভাবছি না? আরও অনেকেই নিশ্চয়ই ভেবেছেন? তাহলে কেনো এখনো এইসব সমস্যা আমরা সমাধান করতে পারছিনা? স্বাধীনতার এতদিন পরও কেন আমরা এমন কোন সরকার পেলামনা যারা নিঃস্বার্থভাবে দেশের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করেছে? দূর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে যেখানে আমাদের এত নামডাক, দেশের কতজন লোক আসলেই তেমন বড় ধরনের দূর্নীতির সাথে জড়িত? আমার দূর্নীতির দৌড় তো বড়জোর ইউনিভারসিটিতে অন্যের রিপোর্ট নিজের বলে চালিয়ে দেয়া পর্যন্ত। আর আমি নিশ্চিত যে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া সবারই অভিজ্ঞতা এরকমই। তাহলে এই কতিপয় দূর্নীতিগ্রস্ত মানুযের জন্য কেন আমরা এতবড় একটা টাইটেল নিয়ে বেঁচে থাকবো সারাজীবন? না। আমরা সমাধান চাই, চাই বেঁচে থাকার সব সুযোগ সুবিধা। কিন্তু তার আগে বের করতে হবে আমাদের সমস্যাগুলো আসলে কোথায় এবং যেগুলো আমরা সমাধান করতে পারব সবাই একসাথে।

অনেকগুলো ছোট ছোট অসঙ্গতি নিয়ে একটা বড় সমস্যার উৎপত্তি, আর এই অসঙ্গতিগুলোর পেছনেও অনেক সামাজিক, ধর্মীয়, সাংকৃতিক অথবা রাজনৈতিক কারন জড়িত। দেশের এই স্হবিরতার শিকার শুধু আমরা সাধারন মানুষই, আমাদেরকেই তাই এগিয়ে আসতে হবে এর সমাধানের জন্য। আমার কাছে যতটুকু মনে হয়েছে, আমাদের প্রধান সমস্যাগুলো হচ্ছে: ১| ঢাকাকেন্দ্রিকতা: আমাদের সবকিছু অনেকটা ঢাকা-কেন্দ্রিক, রাজধানী হিসেবে ঢাকার কাছে আমাদের দাবী অনেক বেশী। সবাই ঢাকায় থাকতে চান, কারন বেশীরভাগ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত ঢাকায় অবস্হিত। এই ঢাকাকেন্দ্রিকতার কারনে সৃষ্ট সমস্যাগুলো হচ্ছে: ----> অসহনীয় লোডশেডিং ----> স্হির হয়ে থাকা ট্রাফিক জ্যাম ----> পানির অভাব ----> গ্যাসের ঘাটতি ----> বেকারত্ব ----> আইন শৃঙ্খলার অবনতি ----> অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিকল্পিত রাস্তা-ঘাট ----> তথাকথিত ভিআইপিদের উৎপাত ----> বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ছাত্র দল/লীগ/শিবিরদের বাড়াবাড়ি ২| লাগামহীন উর্দ্ধমুখী দ্রব্যমূল্য: খুব সম্ভবত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে জিনিসপত্রের দাম শুধু বাড়তেই থাকে।

বিশ্ববাজারে কোনো জিনিসের দাম কমলেও দেশী মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা সেটাকে নিজেদের লাভ হিসেবে মনে করে তার দাম আর কমাননা। এই সমস্যার পেছনের সম্ভাব্য কারনগুলো হচ্ছে: ----> স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, যারা অনেকসময় সরকারের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। ----> নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অবৈধ গুদামজাতকরন। ---->পরিবহন খাতে ব্যাপক চাঁদাবাজি, যার বেশীর ভাগই ট্রাফিক এবং কালো চশমা পরিহিত সার্জেন্টদের পকেটে জায়গা করে নেয়। ----> সবচেয়ে দুঃখজনক ও হতাশাজনক যে কারন তা হচ্ছে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে সাধারন মানুষকে দুর্ভোগে ফেলা মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা।

৩| দূর্বল নেতৃত্ব এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব: দুঃখজনক হলেও সত্যি যে স্বাধীনতার এতদিন পেরিয়ে গেলেও আমাদের যতটুকু এগিয়ে যাবার কথা ছিল তার অর্ধেকটাও আমরা পেরোতে পারিনি। দূর্বল নেতৃত্ব এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব এর অন্যতম প্রধান কারন, এবং এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব অনেকটা ইচ্ছাকৃত। এর কারনগুলো হচ্ছে: ----> আমরা সৃষ্টিগতভাবেই একটা অনুভূতিপ্রবন এবং উচ্চমাত্রায় সংবেদনশীল জাতি। কোন নির্বাচনে ভোট দেয়ার আগে মস্তিস্কের বদলে আমরা আমাদের অনুভূতি ব্যবহারেই বেশী স্বাচ্ছ্যন্ধবোধ করি। যার কারনে দেশের উন্নয়নের কতটুকু অবদান রাখতে পারবেন বা পেরেছেন, এটা চিন্তা না করে কে টিভিতে বোরখা পড়ে ভোট চাইতে গিয়ে আবেগে কেঁদে ফেললেন বা কার আমলে এখানে সেখানে কম ১৪ টুকরা লাশ পাওয়া গেছে, তার উপর ভিত্তি করে আমরা ভোটটা দিয়ে দেই।

----> সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা-অনিহার একমাত্র রাজনৈতিক কারনটি হচ্ছে ৫ বছর মেয়াদী সরকার ব্যবস্হা। উন্নয়নমূলক যেকোন কাজের কৃতিত্ব দাবী করা এবং সেটি নিজেদের বলে জাহির করা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্যকর্তব্য বলে মনেকরে, যার ফলস্বরূপ ৫বছরের বেশীমেয়াদী যেকোন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার প্রস্তাব আবর্জনার স্তুপে স্হান পায়। ----> রাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের অবর্নণীয় মিশ্রন, যা থেকে আমরা যেন আর বেরই হতে পারছিনা। আমাদের পছন্দের তালিকায় নতুন কিছু যোগ হচ্ছেনা, পুরোনো মুরগীর পাড়া সেই ডিম থেকেই আমাদের মুরগী বের করতে হচ্ছে, সেই মুরগীর ক্রমাগত ঠোকরে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হলেও পরম সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে চলেছি এখন পর্যন্ত। আমাদের সমস্যার শেষ নেই, কিন্তু সমাধান নিশ্চয়ই আছে।

আপনি আর আমি মিলে যখন 'আমরা' হব তখনই পারবো আমরা এর সমাধান বের করতে। জানি লেখাটা অনেক বড় হয়ে গেছে, শুধুমাত্র কয়েকটি সমস্যার কথা বলতে গিয়েই। আমাদের মধ্য থেকেই এর সমাধান আসতে হবে, হতাশা থেকে আমার এই লেখার সূত্রপাত, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই হতাশা কেটে যাবে, আমি জানিনা কিভাবে, কিন্তু আমি আশা ছাড়তে রাজি নই। অনুগ্রহ করে আপনিও আপনার জানা সমস্যাগুলো শেয়ার করুন। সবধরনের সমাধান বা পরিকল্পনাকে স্বাগতম জানাই।

ধন্যবাদ!!!!!! বি:দ্র: উল্লেখিত সমস্যাগুলো ক্রমানুসারে সাজানো হয়নি, আমার যেটা আগে মনে এসেছে সেভাবেই বর্ননা করেছি।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।