আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আধুনিকতার প্রসঙ্গ ও বাংলা কবিতার প্রেক্ষিত



আধুনিকতার প্রসঙ্গ ও বাংলা কবিতার প্রেক্ষিত রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বিষয়ে ভাবতে গেলে শিল্প সাহিত্যের আধুনিকতার প্রসঙ্গটি অত্যাবশ্যকীয়রূপে এসে পড়ে। বাংলা কবিতার পরিপ্রেক্ষিত বিষয়টি দীর্ঘকাল হলো নানাভাবে আলোচিত হয়ে আসছে। ফলে এখন বাংলা আধুনিক কবিতা সম্পর্কে আমাদের চিন্তার কয়েকটি বিশেষ সাধারণ ধারণা বিদ্যমান। বলাবাহুল্য এই ধারণার উদ্ভব ঘটেছিল তিরিশ ও চল্লিশের দশকে; এবং তাও ঐ দুই দশকের কয়েকজন অসাধারণ প্রতীভাবান কবির কাব্যসৃষ্টির এবং সে সম্পর্কে তাদের কয়েকজনের তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকজন ধীমান সমালোচকের মূল্যবান বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঐ ধারণাসমূহ আমাদেরকে আধুনিক বাংলা কবিতার একটি প্রতিষ্ঠিত সংজ্ঞায় উপনীত করেছে।

এই সংজ্ঞানুযায়ী আধনিক বাংলা কবিতাকে কালের দিক থেকে রবীন্দ্র পরবর্তী এবং গুণের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত বলে সনাক্ত করেছে। এই কবিতাকে আমরা নগরকেন্দ্রিক, যান্ত্রিক সভ্যতার দ্বারা তীব্রভাবে প্রভাবিত, নৈরাশ্যে নিমজ্জিত, নিঃসঙ্গতাবোধ ও অনিকেত মানসিকতায় গভীরভাবে আক্রান্ত, প্রচলিত বাক প্রতীমার পরিহারে স্বতন্ত্র্য এবং প্রাতিস্বিক চর্চায় উৎকেন্দ্রিক, আর সে কারণে কুটত্ব লাঞ্ছিত- এইসব বিভিন্ন অভীধায় দীর্ঘকাল হলো চিহ্নিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিকতা স্থাপন করতে গিয়ে এই কবিতাকে আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপীয় এবং বিশেষভাবে ইংরেজী কবিতার ও কাব্যভাবনা দিয়ে গভীরভাবে প্রভাবিত ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছি। কিন্তু এই ধরণের বিশ্লেষণের প্রক্রিয়ায় নিবদ্ধ হয়ে সম্ভবতঃ এটাও ল্য করিনি যে, এই সমস্ত প্রভাব আধুনিক বাংলা কবিতা কমবেশি অঙ্গে ধারণ করলেও ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক কারণে তার একটি নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ও একটি বিশিষ্ঠ প্রবহমান ঐতিহ্যের ধারার বিশুদ্ধ প্রোপট বিদ্যমান; এবং তার অন্তর্গত গুণাবলী ও বহিরাবরণের শ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ গুণসমূহের চারিত্র নির্ধারণ করেছে সেই অবিনশ্বর উত্তরাধিকার। সেই তিরিশ ও চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত বাংলা কবিতার গতি প্রকৃতি ল্য করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বসাহিত্যের জটিল প্রোপটে বাংলা কবিতা নিজেকে স্থাপন করতে গিয়ে যেমন একদিকে একটি বিশুদ্ধ পরিমার্জিত কাব্যবোধের জন্ম দিয়েছে আধুনিককালের বিশ্বসমাজের ধ্যানধারণার অনুবর্তনে, আবার তেমনি অপরদিকে আধুনিককালের বস্তু সমর্পিত, সাফল্য কবলিত, জীবন চেতনার পরিক্রমণে ‘অর্থ, কীর্তি, বা স্বচ্ছলতা’ নয়, বরং তার অন্তর্গত প্রবহমান রক্তের ভিতরে অনুভব করেছে ‘ কোন এক বিপন্ন বিস্ময়’, যে বিস্ময় কখনই ্ধুনক জবিন বীার প্রায়োগিক প্রবণতার দ্বারা চিহ্নিত নয়।

আধুনিক মনন তার পরিপার্শ্বকে অর্থাৎ যে বস্তু বিশ্বে তার অস্তিত্ব তাকে বিশ্লেষণ করে, জীবন ও জগতের তীè পর্যবেণে নিজেকে নিয়োজিত করে, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে তার অস্তিত্বের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে চায়, কিন্তু কখনই সজ্ঞা প্রভাবিত রহস্যের ঊর্ণাজালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেনা। বিশুদ্ধ অবিমিশ্র আধুনিকতা তাই এক অর্থে কবিতার ও শিল্পের পরিপন্থী। আধুনিক মানুষ ‘বিপুলাপৃত্থী ও নিরবধি কাল’ কে অণুবীণে বিশ্লেষিত করতে আগ্রহী, যে আগ্রহের ল্য হলো মহাকালের অর্থ উন্মোচন এবং সম্ভব হলে তার অস্তিত্বের অনুপূঙ্খ ব্যবচ্ছেদ। সম্ভবত অক্টাভিওপাজ আধুনিক মনন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এই কথাটি বোঝাতে চেয়েছেন“... আধুনিকতার মূল নির্যাস হলো মহাকালের সমালোচনা, বর্তমান সময় গভীর তাৎপর্যময় সময়)” প্রকৌশল ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রযাত্রা হয়তো মানুষকে নান্দনিক অর্থে এমন অনুর্বর ও নীরস দৃশ্যপটের দিকেই অমোঘভাবে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ শিল্পে সঙ্গীতে কবিতায় সৌন্দর্য সৃষ্টির যে কোনো প্রক্রিয়ায় মানুষের যুক্তি বুদ্ধিকে অতিক্রম করে তার বোধের ভেতরে থাকে আরেক চিরন্তন, এক নির্মোহ সত্য সুন্দরের অভিমুখে অভিযাত্রা যার সজ্ঞা দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে দুলিয়ে দেয় জীবনের সকল রহস্যের যবনিকা এবং হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে উন্মোচিত করে তোলে ‘বাতাসের ওপারে বাতাস’ ‘আকাশের ওপারে আকাশ’ অর্থাৎ সুন্দরের শাশ্বত অথচ দুর্বিশ্লেষ্য জগৎ; আর এই জগৎটাই সকল সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের অন্তিম অন্বিষ্ট।

পরষ্পর বিচ্ছিন্ন বস্তু নিচয়, বর্ণ আদল ও অবয়ব এবং ধ্বনি থেকে শিল্পী ও কবির মনে জন্ম নেয় এক বিশুদ্ধ সুন্দরের আবেগ যা অযোধ্যার চেয়েও সত্য হয়ে ওঠে অকস্মাৎ; হঠাৎ করে দেখা কোনো এক বিরল মুহূর্তে বাচন ও অনির্বচনীয়ের ভাষা ও কল্পচিত্রের সংযোগ রচিত হয়ে যায়, যেন এমন একটি স্তরে শিল্পীর বোধ এসে ঠেকে যায় যার কোনো ব্যাকরণ নেই, বিশ্লেষণ নেই, অঙ্কশাস্ত্রের অযৌক্তিক বা ইরেশনাল সংখ্যার মতো। প্রকৃতপে সভ্যতা যতই অগ্রসর হচ্ছে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতিতে রীতিক রহস্যময়তা যতো স্বচ্ছ হয়ে উঠছে তার কাছে। ততই মানুষের কর্মে, তার শিল্পবোধে এবং সে জন্যেই তার শিল্প সৃষ্টিতে বিশুদ্ধতার পরিচর্যা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আধুনিককাল থেকে শুরু করে বর্তমান কালকে তথাকথিত উত্তরাধুনিককাল বলে ধরলেও এই চরম শুদ্ধতার পরিচর্যাই আপাততঃ জ্ঞানে বিজ্ঞানে ও শিল্পে আমাদের ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’। এই বিশুদ্ধতার পরিচর্যা যা প্রকৃতপে সত্যানুসন্ধান কবিকে, চিত্রশিল্পীকে, ভাস্করকে কখনও কখনও বিমূর্ততার দিকে প্রণোদিত করে।

সমস্ত দৃশ্যমান অবয়ব থেকে সেইসব অবয়বের মূল নির্যাস টেনে নিয়ে একটি বিশুদ্ধ অবয়ব সৃষ্টির আকাক্সায় সে উন্মোথিত হয়। এই উন্মোথিত হওয়া, এই উদগ্রীব অন্বেষণই শিল্পীর, কবির ও স্বপ্ন দ্রষ্টার অনন্য জাগরণ। এবং সে জাগরণ সমস্তকালকে অতিক্রম করে যায়। শিল্পী ও বোদ্ধার এই জাগরণ দূর্ভাগ্যবশতঃ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি একই দেশের বিভিন্ন সামাজিক স্তরে বিভিন্ন জণগোষ্ঠীর মধ্যে একভাবে সঞ্চারিত হয় না, তার কারণ দেশে দেশে এমনকি একই দেশের বিভিন্ন সামাজিক অর্থনৈতিক স্তর বিন্যসে একটি সমাজের বিপুল জনগোষ্ঠীতে বাস্তব ও বৌদ্ধিক অগ্রযাত্রার সমার্থক নয়, ফলে শিল্পীর নতুন উপলব্ধির ধারণা সঞ্চারিত হয়ে যাচ্ছে না সর্বত্র। এবং সেজন্যে দেখা যায় শ্রেষ্ঠ কবি বা শ্রেষ্ঠ শিল্পী সবসময় তার সময় থেকে এগিয়ে থাকেন আর সে জন্যই যখন তিনি দ্রষ্টার ভূমিকায়- তখন সমাজের সঙ্গে তার সংঘর্ষ।

ইয়েটস যখন ‘কেন্দ্রের টান আর থাকছেনা এবং কেন্দ্রাতীগ শক্তিতে বস্তু নিচয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে’ সভ্যতার এমন অবস্থা প্রত্য করেন তখন প্রকৃতপে তিনি এই পরিবর্তিত পরিপ্রেেিতর ধারণাটিকে ষ্পষ্ট করবার চেষ্টা করছেন, অভূতপূর্ব সঞ্চরমান চিত্রকল্পে, বলাবাহুল্য বিমূর্ত চিত্রকল্পে। তাহলে আসলে যা ঘটছে সময়ের বিবর্তনে ইতিহাসের অমোঘ যাত্রায় সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বস্তু নিচয় ও মানব সম্পর্কের পরিবর্তন। তাই এই জীবন ও জগৎকে কবি সেই পরিবর্তিত প্রেক্ষিত প্রত্যক্ষ করছেন; আর সেই জন্যই বদলে যাচ্ছে তার উপমা-রূপক-উৎপ্রোর চেহারা। তার বাচনের প্রস্বর, তার জ্যোতির পারম্পর্য, তার শব্দের চিত্রকল্পের ব্যঞ্জনা ও গূঢ়ার্থ। ’ কাজেই কবিতা বিষয়ে ‘আধুনিকতা’র প্রসঙ্গটাই আর অর্থবহ থাকে না।

তিরিশ ও চল্লিশের দশকে বা এমনকি পঞ্চাশের দশকেও আমাদের কবিতা সম্পর্কে আধুনিকতার প্রসঙ্গটি হয়তো কিছুটা প্রাসঙ্গিক ছিল। কারণ তৎপূর্ববর্তী কাব্যভাষার সঙ্গে তৎকালের কাব্যভাষার ব্যবধান হযে যায় বিস্তর। এখন এই প্রসঙ্গটিই প্রকৃতপক্ষে অবান্তর। আরো স্পষ্ট করে বললে তখন বিষয়টির প্রাসঙ্গিকতা ছিল এই অর্থে যে, একটি বিশেষ সময়ের পরিসরে ধরা যাক প্রথম ও দ্বিতীয বিশ্বযুদ্ধকালীন ও তার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে। ‘ধরা যাক যে তা মহাশূন্যে অভিযাত্রার কাল’ পর্যন্ত প্রসারিত, সমগ্র বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পট পরিবর্তনের সমান্তরালে কবিতার তথা নমনীয় শিল্পের আঙ্গিকে একটি অতি ষ্পষ্ট ও ল্যযোগ্য পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছিল।

কিন্তু আজকে একবিংশ শতকের ঊষালগ্নে দাঁড়িয়ে আমরা সেই পরিবর্তনের একটি পরিণত রূপ প্রত্য করি। তখন প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলতে পারি যে, সেই পরিবর্তনের কারণে শিল্পের মৌলিক চরিত্রে কোনো গুণগত পরিবর্তন আরোপিত হয়নি। - কবিতা এখনও কবিতাই রয়ে গেছে, চিত্রকলা চিত্রকলাই। তবে টেড হিউজ বা টমাস হিনি আলেকজান্ডার পোপের মতো কবিতা রচনা করেন না, শামসুর রাহমান বা আলমাহমুদ লেখেন না বিহারীলালের মতো, জয়নুল আবেদীন, সুলতান বা কিবরিয়া আঁকেন না রুবেনস এর মতো, অর্থাৎ শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। তার পরিপ্রেতি হয়তো গেছে বদলে।

এবং নতুন কিছু যুক্ত হয়েছে তার কৌশলে। ঠিক তেমনিভাবেই কবির কাব্য ভাষায়ও হয়তো যুক্ত হয়েছে কিছু অভিনব বৈশিষ্ঠ। কিন্তু কবিতার বহিরঙ্গ বা অন্তরঙ্গ আয়তনে যে ভাষার বঞ্জনায় কেঁপে ওঠা, প্রচলিত অর্থের সীমা অতিক্রম করে শব্দের নতুন অর্থের যে উদ্ভাবক, শব্দের ধ্বনি ও সঙ্গীতে আনন্দের যে অনাবিল নির্ঝর তা কিন্তু বদলায়নি একটুও। হয়তো আগের তুলনায় বর্তমানের কবি আরো নির্মোহ হয়ে খুঁজছেন তার বিশুদ্ধতার অনন্য অবয়ব। আমার ধারণা ‘আধুনিকতা’র প্রসঙ্গটি মূলত কোন সময়ের জনগোষ্ঠীর এবং আরো বিশ্লেষিত করে বললে কোন পাঠক গোষ্ঠীর সাধারণ রুচি ও শিার মান ও প্রকৃতির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে সম্পর্কিত।

আধুনিকতা সর্বকালেই একটি আপেকি ধারণা। জন ডান যখন লিখতেন তখন অবশ্যই তিনি অত্যন্ত আধুনিক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার সময়ে অনাধুনিক ছিলেন না। এমনকি বিহারীলালও না। অনগ্রসর এবং সাধারণভাবে প্রতিক্রিয়াশীল রণবাদের কাছে সমর্পিত সময় থেকে অনেক অগ্রসর শিল্পকর্মকে সমস্ত যুগেই অভূতপূর্ব ও সেকারণেই দুর্বোধ্য এবং এমনকি উদ্ভট বলে মনে হয়েছে।

কিন্তু তার অন্তর্নিহিত শক্তিকে অস্বীকার করা বড়ো কঠিন; এবং সেজন্যে তাকে বহুবার কাঠগড়াতেও উঠতে হয়েছে। কেবলমাত্র শিল্পেই নয় বিজ্ঞানের েেত্রও এমনটা ঘটেছে এই সেদিন পর্যন্ত। ডারউইন সম্পর্কিত ঘটনা তো অল্পকাল আগে। এসব কিছুর কারণ কিন্তু একটাই প্রচলিত রুচির বাইরে সর্বসাধারণ মানুষ বা একটি সমাজের বিপুল সংখ্যক সদস্য সহজে বেরিয়ে আসতে পারে না। নিউটনের সূত্রের অনুসরণে বস্তুর মতো রুচিতেও পরিবর্তন আনতে হলে কিছু শক্তির প্রয়োজন হয়; এবং সেই শক্তি সরবরাহ করেন পিকাসো বা জয়নুলের মতো শিল্পী, বোদলেয়ার বা জীবনানন্দের মতো কবি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ও প্রসার ও তার সমান্তরালে রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের আধুনিকতর পরিপ্রেতি নিরবে বদলে যায়। রবীন্দ্রনাথের গানের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা ও জনপ্রিয়তার প্রসার ঘটেছে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের পরিসরে। এর কারণ যতোটা রাজনৈতিক তার চাইতে অনেক বেশি শিাগত ও নান্দনিক। কিন্তু তবু কি তার গান সর্বসাধারণের মধ্যে সম্পৃক্ত হতে পেরেছে এতোদিন পরেও? দেশের সর্বত্র কি সমানভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা হচ্ছে বা লোকে শুনছে? কিন্তু তবুও যুক্তিগ্রাহ্যভাবে বলা যেতে পারে যে মূলধারার শিার ক্রমাগত চিন্তার এবং সংস্কৃতির ব্যাপকতর চর্চায় মানুষের রুচি পরিবর্তনের ফলে একদিন এমন পরিস্থিতি উদ্ভব অসম্ভব নয় যে রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের সাধারণ লোকায়ত ঐতিহ্যের মধ্যে মিশে যাবে।

কবিতার ক্ষেত্রেও যে ঐ একই সূত্র কাজ করে তা বলা হয়তো অসঙ্গত হবে না। আধুনিক বাংরা কবিতার প্রসঙ্গে আবার স্বাভাবিকভাবেই কিছু কঠিন বাস্তবতার অনুপ্রবেশ ঘটে যার একটি হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের সমাজ মানসের প্রোপট। অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর তৃতীয় বিশ্বে সাধারণভাবে যা ঘটে তা হচ্ছে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও তার ব্যবহারের মধ্যে সময়ের তফাৎ এবং অনগ্রসর সমাজে জীবনযাত্রার মাঝে অপোকৃত পিছিয়ে থাকা। অগ্রসর বিশ্বে যখন স্বয়ম্বু প্রযুক্তির উদ্বর্তনের ভেতর দিয়ে অল্েয সমাজ মানুষেও বিবর্তন আসতে থাকে আমাদের েেত্র তখন উন্নত প্রযুক্তি নিজের ভেতর দিয়ে উদ্ভূত না হয়ে বাইরে থেকে আমাদের ওপর অনেক সময় আরোপিত হয়। অতএব নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব ও বিকাশে যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি অন্যত্র সাধিত হয়েছে তার প্রোপট এবং তাকে অন্য আরেকটি একেবারে ভিন্ন পরিস্থিতিতে ধারণ করবার মতা- এ দুয়ের মধ্যে বিরাট ব্যবধান থেকে যায়।

আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ, এমনকি সমাজের শিতি শ্রেণীর এক বিরাট অংশ এই ব্যবধানজনিত পশ্চাদপদতার শিকার। অতএব তাদের মানসিক বিবর্তন অপোকৃত শ্লথ গতি হওয়াই স্বাভাবিক। উপরন্তু সকল সমাজে সর্বকালেই সাংস্কৃতিক দিক থেকে বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা সাধারণত নগণ্য হয়ে থাকে। আমাদের দেশে শিল্প সাহিত্যে বিশেষত কবিতার েেত্র নতুন করে আধুনিকতা ও তজ্জনিত দুর্বোধ্যতার প্রসঙ্গ এই বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত। কেননা কবি, চিন্তাবিদ, দার্শনিক, শিল্পী এরা সাধারণত স্বকীয় সমাজেও তাদের কায়িক সময় থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকেন এবং এ কারণেই স্ব স্ব সমাজে সম সাময়িক রুচির পরিবর্তনে অনুঘটকের ভূমিকা গ্রহণ করেন তারাই।

যিনি যতো বেশি শক্তিমান তিনি ততো বেশি পরিবর্তন ঘটিয়ে দেন। সর্বকালে সর্ব দেশে অল্েয এমনটা সংঘটিত হয়ে চলেছে। কাল পরম্পরায় শিল্পের অবয়বে যে পরিবর্তন বা তাতে আধুনিকতার যে পরিচয় বা চিন্তাসমূহ বিধৃত হয় তা তো মূলত বহিঃরঙ্গে যদিও তার অন্তরঙ্গেও যে পরিবর্তন সূচিত হয় না তা নয়। তবে স্পেনসরের সময় থেকে ফিলিপ লারকিনের সময় পর্যন্ত চর্যাপদের কাল থেকে আল মাহমুদের কাল পর্যন্ত পরিবর্তন ঘটেছে কি ইংরেজী বাংলা বিষয় আসয়ে, প্রকৃতি, প্রেম, নারী, ঈশ্বর, মানুষ, মানুষের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা-হতাশা- এই সবই তো সেকালে যেমন একালেও তেমনি সমানভাবে কবির উপজীব্য। আমাদের অন্তরের গহীন ভেতরে যে চিন্ময়, শাশ্বত বহমান ধারা কাজ করে তার চরিত্রে কি হয়েছে কোনো পরিবর্তন? পরিবর্তন ঘটেছে কি মানুষের গভীরতম নিবিড় অনুসন্ধিৎসার? মানব সভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, জীবন জগৎ ও আমাদের পরিপার্শ¦ সম্পর্কে অধিকতর তথ্য ও সংবাদ আহরণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের উপলব্ধির দিগন্ত ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হয়ে যায়।

আর তারই প্রোপটে কোনো মানব গোষ্ঠীর সমকালীন কবিতাসহ সকল শিল্পসৃষ্টি তার নির্দিষ্ট অবয়ব খুঁজে নেয় তার নিজের আর্থ সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার নিরিখে। আমাদের েেত্রও সেটাই ঘটেছে। কেবল কবিতা কেন শিল্পের যে কোন ত্রে সম্পর্কে কথাটি প্রযোজ্য- চিত্রকলা, ভাস্কর্য, নাট্যকলা, সঙ্গীত, স্থাপত্য। এই সমস্ত েেত্রই আধুনিকতা বলতে আপাতত আমরা সাধারণ অর্থে যা বুঝি তা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে জারিত হয়ে আসা কেবল পাশ্চাত্য সমাজে সংঘটিত কিছু পরিবর্তনের চিহ্ন, কিন্তু প্রথমত ও বিশেষতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে কেবল পাশ্চাত্য সমাজই নয় প্রকৃতপে সম্পূর্ণ মানব সমাজই একটি নতুন সময়ের মধ্যে জেগে উঠেছিল। পরবর্তীতে বিগত শতাব্দীর মধ্য বিন্দু থেকে আজকে একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতিতে যে বৈষম্যমূলক উদ্বর্তন এবং এশীয় উন্নয়নের প্রারম্ভ সত্ত্বেও তৃতীয় বিশ্বের যে বিভ্রান্ত বাস্তবতা ‘এইসব রং রক্ত বিভীষিকা’, এবং ‘এইসব ভয়াবহ আরতির ভিতর দিয়ে’ মানব সমাজ হয়তো আরো সংশয়ী হয়েছে।

সতর্ক হয়েছে সন্ত্রস্ত হরিণের মতো। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় সে নিশ্চলতা হারিয়েছে, স্বস্তি হারিয়েছে, সচকিত হয়েছে সন্ত্রাসে যখন সে জেনেছে নিজের সম্পর্কে ভীতিপ্রদ হন্তারক সত্য, পশুশক্তির এখনও জয়জয়কার এবং তার আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা যা শেষ, আপাতদৃষ্টিতে শেষ হবার নয়। কেননা সে এখনও পর্যন্ত পর্যুদস্ত হচ্ছে এক নায়কত্বে, স্বৈরাচারে, রাজনৈতিক শঠতার আক্রমণে, আনুপূর্ব মিথ্যাভাষণে, মানুষের বর্তমান ভাষা ও বাস্তবতার দ্বৈরথে। তার নিজের সমস্যা সম্পর্কে এই ঋণাত্বক জ্ঞানের ভার অনেকেেত্র দুর্বিসহ হয়ে উঠে তার জন্য। সন্ত্রাস তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে কখনও কখনও।

এই উত্তরাধিকারকে সে অস্বীকার করতে পারবে আজ? আমরা কি আর নিরঙ্কুশ আনন্দ আর্জন করতে পারবো সরল একমাত্রিক এলিজি থেকে? কবিতায় কি আমরা আবার ফিরে যাবো প্রাতিষ্ঠানিক পয়ারে? হয়তো যাবো, হয়তো যাবো না। হয়তো পরীা নিরিা করবো। কিন্তু সেই পয়ার আর কোনোদিনই ভারত চন্দ্রের পয়ার হবে না, এমনকি জসীমউদ্দীনেরও নয়। কাজেই আধুনিকতাপূর্ব, আধুনিক ও আধুনিতা উত্তর কবিতা বলে সত্যিকার অর্থে কোন কাব্যিক আঙ্গিকের অস্তিত্ব আছে বলে ধারণা করা কষ্টকর। কারণ কবিতার ধারাক্রম চিরন্তন এবং তার মর্মেও রয়েছে মানুষের চিরন্তন পুরুষার্থ ও তার শাশ্বত নান্দনিক চৈতন্যের প্রবহমানতা, এই চলমানতার মধ্যেই পরবর্তী যুগের কবিতা, ভবিষ্যতের কবিতা নিজের বিশিষ্ঠরূপটি পরিগ্রহ করে নেবে।

কিছু পরিগ্রহণ করবে, কিছু বর্জন হয়তো করবে, কিন্তু তার অন্তরতম চরিত্রে নির্যাসে এবং অবয়বে থাকবে মানুষেরই চিরন্তন উপলব্ধি সমূহ- প্রেম-অপ্রেম, রিরংসা, ঈর্ষা, আনন্দবেদনা, সুদূরের পিপাসা সৌন্দর্যের উৎকর্ষে নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়ার উদগ্র অভীপ্সা। কী রূপে সে প্রতিভাত হবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা নির্ভর করবে ভবিষ্যতের সেই বিশেষ সমাজ বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং তার অর্থনৈতিক, সামাজিক, ভৌগোলিক, দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার বৈশিষ্ট্যের ওপরে। কেবলমাত এইটুকুই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে তা মৌলিকভাবে কবিতাই থাকবে অন্য কোনো শিল্প হবে না। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে আরেকটু ষ্পষ্ট করা যেতে পারে- গত শতাব্দীর প্রথম দশকে এপোলোনিয়ার কিছু অভূতপূর্ব বিশুদ্ধ কবিতা রচনা করেছিলেন। নানা ব্যতিক্রমী কাজের মধ্যে একটি কাজ তিনি করতেন বেশ আনন্দের সঙ্গে।

ক্যালিগাম রচনা। কিন্তু তার প্রতিটি ক্যালিগ্রাম রচনায় এ সমস্ত নানা আকারের অর বিন্যসের অন্তরালে উঁকি দিত একটি করে বিশুদ্ধ কবিতা। কাজেই অন্য শিল্পের সংমিশ্রণ থাকলেও কেবলমাত্র প্রোজ্জ্বল কবিতার জন্য এপোলিনয়ার ঐ কবিতা অবিনশ্বর হয়ে রইল। বিভিন্ন সময়ে কবিতা নিয়ে এমন অনেক পরীা নিরীা হয়েছে যেমন হয়েছে চিত্রশিল্পে। বেশ কিছুকাল আগে একটি মার্কিন কবিতা সংকলনে এক ভদ্রলোকের কবিতা(?) দেখলাম।

কিন্তু পড়তে পারিনি। কবির(?) নাম রিচার্ড কোস্টেলানেজ। কবিতার শিরোনাম নেই; ক্যালিগ্রাম আছে, কিন্তু কবিতা একেবারেই অনুপস্থিত। আসাদ চৌধুরীর প্রশ্নটি ছুড়ে দিতে ইচ্ছে করছিল, সত্য কোথায় গেলেন? কোস্টেলানেজের এই নির্মাণগুলো হয়তো কম্পিউটারে প্র¯ত্তত কিছু প্যাটার্ন হিসেবে বা এক ধরণের চিত্রকর্ম হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু কবিতার জন্য যে শব্দের ব্যাকরণাগত ব্যবহার, তার অর্থ ব্যঞ্জনা ও চিত্ররূপময়তার বাহনে জীবনের কোনো অংশের যে হঠাৎ প্রজ্জ্বলন, তা যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে আর যাই বলিনা কেন সেই নির্মাণকে কোন অর্থেই কবিতা বলা সঙ্গত হবে কি? কবিতা মৌলিকভবে নির্দিষ্ট একটি সাহিত্য আঙ্গিক। যা আবহমান কাল মানুষকে আনন্দিত করেছে, উদ্বোধিত করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে আর প্রত্যেক যুগেই ভাল কবিতা যেমন রচিত হয়েছে, তেমনি নিচু মানের কবিতাও লেখা হয়েছে প্রচুর।

কিন্তু কালের যাত্রাপথে যুগ যুগ ধরে প্রোজ্জ্বল টিকে আছে এবং পঠিত হচ্ছে তারই কিছু শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এই প্রবহমানতার মধ্যেই বিশ্ব কবিতা এবং বাংলা কবিতার সমূহ অস্তিত্ব। তথাকথিত আধুনিক বাংলা কবিতাও এই প্রবহমানধারার অন্তর্গত। বর্তমান কালেও পূর্ববর্তী কাল সমূহের মতো উৎকৃষ্ট কবিতার পাশাপাশি নিকৃষ্ট কবিতাও লেখা হচ্ছে। শিতি রুচিবান ও প্র¯ত্তত পাঠক সেই বিশাল অরণ্যে নিশ্চয়ই যথার্থ ফলবান বৃরাজীকে সনাক্ত করতে পারবেন।

তবে নতুন সহস্রাব্দের ঊষালগ্নে এসে যেহেতু মানুষের বিচিত্র জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও বিভিন্ন শৃঙ্খলার প্রভূত অগ্রযাত্রায় তার জানার পরিধি গ্যাছে বিপুলভাবে প্রসারিত হয়ে এবং কবিতা যেহেতু সর্বভূক অতএব বর্তমান কালের কবিতায় এবং সমস্তের অঙ্গীকার যে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এ কারণে তাতে পরিশীলন, পরিমার্জনা ও বিশুদ্ধতার বিষয়ও যে আরো উজ্জীবিত হবে তা অনুমান করা যায়। জীবনের অন্যান্য পরিচর্যার মতো কবিতায়ও অবশ্যই পরীা নিরীার েেত্র বি¯তৃততর হবে, আরো অনুপূঙ্খ হবে জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে কবির মনোযোগ। কিন্তু কবির সেই অর্জিত জ্ঞান সেই নিরীার নির্যাস কবিতাতেই প্রকাশিত হবে অনিবার্যভাবে অন্য কোনো শিল্প মাধ্যমে নয়। তবে ভবিষ্যতের কবিতা যে রূপই পরিগ্রহ করুক না কেন তা যদি বিশুদ্ধ কবিতার প্রজ্জ্বলনে ঝলসে না ওঠে তাহলে স্বভাবতই কাল তার বাধ সাধবেই।

আর বিশ্ব সভ্যতা যদি ধ্বংসের দিকে না গিয়ে মঙ্গলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতের সেই সমাজে কবিতার মাত্রা অবশ্যই বেড়ে যাবে এবং কেবলমাত্র ব্যক্তির জন্যই নয় সমাজের জন্যও তা হবে প্রয়োজনীয় , অর্থবহ ও তাৎপর্যময়।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.