আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওরা কি ফিরবে আর সুপ্রভাতে...

...ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাচিয়া,সদাই ভাবনা, যা কিছু পায়, হারায়ে যায়, না মানে স্বান্তনা...
এক. রহিম মিয়া ধরফর করে উঠে বসলো। সারাদিন ভিক্ষা করে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতেই এই জ্বালাতন। এমনিতেই মশার যন্ত্রনায় ঘুমানো দায়। তার মধ্যে আজকাল যা শুরু হইছে। খালি মশাল মিছিল।

ছোট মিছিল, বড় মিছিল, মাঝারি মিছিল। সবারই একই কথা স্বাধীন দেশ চায়। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে মশাল মিছিল করে স্বাধীনতা আনা যাবে না এটা ছাগলেও বুঝে। খালি এই সব ছেলে ছোকড়ারা বুঝে না। আর স্বাধীন হইয়া হইবোটা কি? স্বাধীন হইলেও রহিম মিয়া ভিক্ষুক, না হইলেও ভিক্ষুক।

তাই এই সব ব্যাপারে তার তেমন আগ্রহ নেই। রহিম মিয়া ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। বড় রাস্তা দিয়ে ট্রাক যাচ্ছে। আগে সারা রাতই ট্রাক চলতো। গত কিছুদিন থেকে শেখ সাহেবের আন্দোলনে শহরে ট্রাক-ঠ্রাক আর ঢুকে না।

তাই হঠাৎ ট্রাকের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেছে রহিম মিয়ার। রহিম মিয়া মাথা উচু করে দেখার চেষ্টা করলো। ট্রাকটা এসে একটু দূরে থেমেছে। এটা রোজকার মাল বোঝাই ট্রাকের মতো না। পেছনে একটা ছাউনি আছে।

ট্রাকটা থামতেই পেছন থেকে একদল লোক নামলো। খুব খেয়াল করে রহিম মিয়া বুঝতে পরলো লোকগুলো হলো মিলিটারীর লোক। রাতটা ছিলো ২৫শে মার্চ, ১৯৭১। একটু পরেই পুরো এলাকাটা গুলির শব্দে কেঁপে উঠলো। শহরের অন্য অংশের মানুষজন সেটা খেয়ালই করলো না।

কারন পুরো শহরেই তখন গুলির শব্দ। দুই. রুবেলের মন মেজাজ আজ খুবই খারাপ। মিলির সাথে ঝগড়া করে সে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। মেয়ে মানুষের বুদ্ধি শুদ্ধি যে কম আর এরা যে খুব উল্টো লজিকে চলে, সেটা নিয়ে রুবেলের আর কোন সন্দেহই নেই। খুব সামন্য ব্যাপার নিয়ে মিলি আজ তুমুল ঝগড়া বজিয়ে দিলো।

সমস্যাটা কিছুই না। আজ ফেরার সময় সে কেন মিলির বাবার বাসা থেকে তার শাশুড়ির তৈরী করা খাবার নিয়ে এলো না। রুবেলের শাশুড়ী প্রায়ই নানান পদের খাবার তৈরী করে পাঠান তাদের বাসায়। আজও খবর পাঠিয়েছিলেন, কি নাকি রেঁধে রেখেছেন, সেগুলো নিয়ে আসার কথা ছিলো রুবেলের। কিন্তু রুবেলের সেটা একদমই মনে ছিলো না।

বাসার সামনে এসে মনে পড়লো। তখন আর যেতে ইচ্ছে করলো না। এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া। সবকিছুর একটা সীমা আছে। মিলির বকবক শুনার চেয়ে কিছুক্ষন বাইরে থেকে ঘুরে আসাটাই শ্রেয় মনে হলো রুবেলের।

তাছাড়া শহরের অবস্থাটাও একটু দেখা দরকার। বিকেল থেকেই গুজব যে আজ শহরে মিলিটারী নামবে। নানা জায়গায় নাকি ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে শহরের। মিলির সাথে ঝগড়ায় একটা লাভই হলো, আজ আর বাসায় ফিরবে না রুবেল। কাটাবনের দিকে একটা মেসে রুবেলের বন্ধু শাহেদ থাকে।

আজ রাতটা সেখানেই কাটাবে ঠিক করলো রুবেল। রাজারবাগের কাছাকাছি এসে থেমে দাড়িয়ে পড়লো রুবেল। একটা ট্রাক থেমে আছে। দেখেই বোঝা যায় মিলিটারী ট্রাক। তাহলে শহরে সত্যিই মিলিটারী নামলো।

শাহেদ আগ্রহ নিয়ে এগিযে গেলো। এর ঠিক একটু পরেই রাজারবাগে মিলিটারী আক্রমন করে। তিন. ডাস্টবিনের খাবার খেয়ে বেশ একটা আয়েশী ঘুম দিয়েছিলো কুকুরটা। রোজকার মতোই সেই ফুটপাতের কোনাটায়। একটা নষ্ট মুরগী পাওয়া গেছে আজ।

নষ্ট হলেও খেতে খারাপ লাগে নি। ফুটপাতের কোনাটায় বসে কুকুরটা পরের দিন কি করে খাবার যোগার করবে তাই ভাবছিলো। সকালের দিকে ডাষ্টবিনে তেমন কিছু খাবার পাওয়া যায় না। তার ওপর আজকাল কি যেন হচ্ছে শহরটায়। খালি মিছিল আর মিছিল।

মাঝে মাঝে রাতের বেলা আগুন নিয়েও মিছিল করে। মানুষগুলোর খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই। খালি মিছিল করে। একটু শান্তিমতো ঘুমানোরও উপায় নেই। অন্যদিনের মতো চারদিক সুনশান হলে কুকুরটা ঘুম দিয়েছিলো।

কিন্তু একটু পরেই একটা ট্রাকের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। রাত দুপুরে ট্রাক কেন? কুকুরটা বুঝতে পারলো না। তাহলে কি আরো ময়লা আবর্জনা নিয়ে এসেছে ট্রাকটা? মাঝরাতে ট্রাক মানেই ময়লা বোঝাই ট্রাক। আর একটা ময়লার ট্রাক মানেই অনেক অনেক খাবার। কুকুরটা ঘুম ফেলে লাফ দিয়ে উঠে বসলো।

কিন্তু একটু পরেই হতাশ হতে হলো তাকে। ট্রাক ভর্তি মানুষ। তাও আবার পুলিশ। ধুর কিছুই হলো না ভেবে কুকুরটা আবার ফুটপাতের কোনায় চলে এলো। কুকুরটা তখনও জানতো না, আর কিছুক্ষন পর সেও ডাষ্টবিনের ময়লারই একটা অংশ হয়ে যাবে।

চার. সিনথাও ওতায়া এই দেশে এসে বিপদে পরে গেছে। অফিসের একটা কাজে এদেশে এসেছিলো। ঢাকায় নেমেই দেখে খালি মিছিল আর মিছিল। কি হচ্ছে কিছুই বুঝে না ওতায়া। কোন দুঃখে যে এই সময় জাপান ছেড়েছিলো সে।

এখন এই দেশ ছাড়াই সমস্যা হয়ে গেছে। প্লেনের টিকেটই বুকিং পাওয়া যাচ্ছে না। বিদেশীরা সবাই পালাচ্ছে। ওতায়া আজ সারাদিন চেষ্টা করেছে আর কিছু না হয় অন্তত ঢাকা ছেড়ে ভারত বা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতে। কিন্তু সারাদিনেও সে কিছু করতে পারে নি।

কাল আবার চেষ্টা করতে হবে। এদেশের অবস্থা তেমন একটা সুবিধার ঠেকছে না। ওতায়া সারাদিন পরিশ্রম শেষে হোটেলে ফিরছিলো রাজারবাগের পাশ থেকে। হঠাৎ দেখলো একটা ট্রাক থেকে কতগুলো মিলিটারী নামছে। ওতায়ার গাড়ির দেখে গাড়িটা থামালো।

ওতায়া গাড়ি থেকে নেমে এলো। ১৯৭১ এর ২৬শে মার্চ সকাল। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ভেতর অনেক অনেক পুলিশের মৃত লাশ পাওয়া যায়। পুলিশ লাইনের বাইরে একটা ডাষ্টবিনের পাশেও কয়েকটা লাশ পাওয়া যায়। একজন ভিক্ষুক, একজন তরুন, একজন বিদেশী আর একটি কুকুরের লাশও ছিলো সেখানে।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।