আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদশের বুকে আমি, না আমার বুকে বাংলাদেশ অথবা এক অনিবার্য প্রেমপোখ্যান



আমার বাবার দুরন্ত কৈশর, প্রথম যৌবণের দিনগুলো আর আমার কৈশর যৌবণের সেই সময় অনেকটাই একরকম। মাঠে ময়দানের সেই উচ্ছলতা বাবাকে যেমন করে ছূঁয়ে গেছে তেমনি আমাকেও। তবে এক অলিখিত ও অনিবার্য বিষয় আমাদের দুই সময়ের মাঝে এক বিশাল পার্থক্যের প্রাচীর তৈরি করে রেখেছিল। আমার বাবার কৈশর আর প্রথম যৌবণের সময়টা ছিল পরাধীন। যা আমার ছিল না।

আমাকে স্কুল কলেজে যেতে দিতে আমার মায়ের চেহারায় কোন দুশ্চিন্তার চিহ্ন ছিলনা। আমার মা তার ছেলেকে স্বাধীন দেশের স্কুলে পাঠাতেন লেখাপড়ার জন্য। কিন্তু এমনিভাবে নিঃশ্চিন্ত মনে আমার বাবাকে তার মা পাঠাতে পারেননি স্কুলে। কারন পরাধীনতার বিষাক্ত ছোবলে সে সময় আমার বাবার চেয়েও বয়সে ছোট মতিউর নামের কোন এক কিশোরকে হতে হয়েছিল শহীদ। তাই স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠা এই আমার এবং জীবনের প্রথম সময়গুলোতে পরাধীন বাবার মধ্যে জীবনের স্বাদ নেয়ার পার্থক্য অনেক।

২. মানুষ হিসেবে খুব কম বিষয় আছে, যেখানে আমার দূর্বলতা ব্যাপক। কম বিষয়ের একটি দেশ। আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে এই দূর্বলতার কারন কি? আমি হয়তো এর কোন ভালো জবাব দিতে পারবোনা। পারবোনা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে যে এই এই কারনে আমি আমার দেশের প্রতি দূর্বল। তারপরেও আমি আমার দেশকে অসম্ভব ভালোবাসি।

এই দূর্বলতার কোন যুক্তি নেই। এই ভালোবাসার কোন কারন নেই। এ আমার দেশ এর চেয়ে বড় কোন কারন নেই। বড় কোন পরিচয় নেই। হয়তো প্রয়োজনও নেই।

৩. দ্রুত পরিবর্তনশীল এক সময়ের মধ্য দিয়ে চলছি। আমাদের মানসিকতাও পাল্টাচ্ছে দ্রুত। তাই আমাদের প্রত্যাশা এবং উচ্চাকাঙ্খাও হয়তো হচ্ছে প্রবল। যে কারনটা আমাকে প্রায়ই সংকুচিত করে ফেলে। আমাকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলে দেয় যখন আমার সমবয়সী কেউ বলে ওঠে, এ্যাই দ্যাশে থেকে কী লাভ? ভবিষ্যত নাই।

আমি আতকে উঠি। আমি ভাবনায় পড়ে যাই। কথাগুলো ভাবি। এই দেশে থেকে কী আসলেই কোন লাভ নাই। এই দেশ কী আমাদের ভবিষ্যত তৈরি করে দেবেনা? কী জানি? কিন্তু তারপরও কেন জানি আমি এই দেশ ছাড়ার কথা ভাবতে পারিনা।

কারন যে দেশেই যাই, যতই উন্নত হোক কিন্তু তা তো আমার না। আমি তো আর সেখানে দাবী করতে পারবোনা এটা আমার, আমার দেশ। আমার স্বাধীনচেতা মনকে প্রশ্রয় দেবে? দেবে না। কখনোই দেবেনা। ৪. আমার অনেক প্রবাসি আত্মীয় আমাকে প্রায়ই তাদের উন্নত জীবনের গল্প শোনান।

সরাসরি না হলেও হাতছানি দেন সেই জীবনের পথে। মানুষ হয়ে জন্মে অনেক মানবীয় দোষ ত্রুটিকে আমি অতিক্রম করতে পারিনী। পারিনা। মাঝে মাঝে তাই হয়তো সে জীবন যাত্রা আমাকে মোহাবিষ্ট করে ফেলে। ইচ্ছে হয়, যাই কী হবে? আবার কেন জানি থেমে যাই।

থেমে যেতে হয়। কোন এক অদৃশ্য বাধন আমাকে পেছনে আটকে রাখে। আমার যাওয়া হয়না। ফরিদা পারভীনের দরাজ কন্ঠ আমার ভেতরে সুর তোলে অবিরাম, এই মধুমতি ধানসিড়ি নদীর তীরে... নিজেকে হারিয়ে যেন পাই ফিরে ফিরে...। আমাকে সেই মধুমতি, ধানসিড়ি আটকে টানে।

আমাকে টানে আমার নদী শীতলক্ষ্যাও। আমাকে টানে আমার স্বাধীনতার বিজয় চিহ্ন আমার লাল সবুজ পতাকা, আমার শহর, আমার গ্রাম, আমার প্রতিদিনের রাস্তা, আমার বাড়ি, আমার বাড়ির ছাঁদ, আমার চিরচেনা মানুষ, তাদের চেনা মুখ। সব। সব আমাকে টানে। দ্বিধাহীনভাবে বলে দিতে পারি আমার বাড়ির সামনে যে ছোট্ট ময়লা ডোবাটি আছে সেটাও আমাকে টেনে ধরে রাখে গভীর মমতায়।

৫. আমার ছোট্ট এই জীবন আমি আমার এই স্বাধীন দেশে স্বাধীন মাটিতেই পার করতে চাই। তাই আমি এটা কখনোই চাইনা, আমার এই স্বাধীনতায় কোন অন্য আধিপত্য, কোন ভুল ব্যাখ্যা অথবা এই স্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে তাদের চেহারা, যে চেহারা আমার বাবা এবং তার সমসাময়িক মানুষেরা ভালো করেই দেখেছেন। যারা এখন অন্য ব্যাখায়, অন্য চেহারায় উঠে আসে বারবার। ৬. আমার বাবার মুখে শোনা তার পরাধীন সময়ের গল্প আমাকে স্বাধীনতার মূল্য বুঝতে শেখায়। আমাকে বুঝতে শেখায়, আমার এই দেশ কী? এই বাংলাদেশ কী? কত কষ্টে, কত রক্তে এই দেশ আমার হয়েছে।

আমাদের হয়েছে। আমি একদিন চলে যাব এটা আমাকে যতটা না কষ্ট দেয়, তারচে বেশী কষ্ট দেয় আমি আমার দেশ ছেড়ে চলে যাবো। আমার চলে যাবার পরও এই দেশে জীবন জীবনের টানে ছুটে চলবে, রোদ ওঠবে, বৃষ্টি পড়বে। আমার প্রিয় বৃষ্টি। যে বৃষ্টিতে নির্দ্বিধায় ভিজেছি ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে।

আমি জানিনা মৃত্যুর পর কী হয়? কেমন হবে সেই চিরপ্রত্যাশিত স্বর্গ? যেমনই হোক স্রষ্টার কাছে আমার প্রার্থনা আমার কোন পূণ্যে যদি আমাকে স্বর্গে পাঠাও এবং সেখানে যদি আমার জন্য অল্প পরিমান জায়গাও রাখো তবে সেই ছোট্ট জায়গাটুকু আর যাই করো তা অন্তত এক টুকরো বংলাদেশ বানিয়ে দিও।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.