আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নেকাব, হিজাব, বোরখা - এনলাইটমেন্ট, মাংস, বিড়াল এবং রসগোল্লা

পরে

আমার এক সহপাঠিনী আছে, একটু ঠোঁটকাটা স্বভাবের। ছাত্রবয়সে তাকে অনেকের সঙ্গেই নারীবিষয়ক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে তর্ক করতে শুনেছি। আমিও কিছু বিষয়ে তার সামনে মত প্রকাশ করে বিপদে পড়েছিলাম। তার স্পর্শকাতরতা বিষয়ে আমার কোনো আন্দাজ ছিল না। বিশেষ করে নারী সংক্রান্ত ব্যাপারগুলোয় সে খুব কাটা কাটা কথা বলতো।

আমি একবার তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম, 'আমার চিন্তাও অন্যসব পুরুষের মতই। ' সেই মেয়ের সঙ্গে বছর খানেক পর দেখা। এর মধ্যে সে বিয়ে করেছে। তাকে দেখে একটু হকচকিয়েই যেতে হলো। এ কী! নারী অধিকার বিষয়ে এত স্পর্শকাতর বান্ধবীটি দেখি মাথায় হিজাব দিয়ে আছে! তার স্বামীও আমাদের বন্ধু।

সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জানতাম, ছেলেটা জোর করে এই মেয়েকে হিজাব পড়াতে পারবে না। তার মানসিকতাও তেমন না। আমি সহসা একটা বেফাঁস কথা বলে ফেললাম। 'তোমার নারী-অধিকারের কী হইল, মাথায় যে হিজাব দিছ!' এই কথায় সহপাঠিনীটি হিসহিস করে উঠল।

হিসহিস করে সে যা বলল তা আমায় গভীর চিন্তায় ফেলে দিল। আমি বাসায় এসে ব্যাপারটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, ব্যাপারটা নিয়ে লিখতে হবে। ২. মেয়েটি হিসহিস করতে করতে আমাকে বলেছিল, 'নারী অধিকার ব্যাপারটা তুমি বোঝ?' আমি চিন্তা করে দেখলাম, আমি বুঝি, তবে কম বুঝি। আরেকটু বাড়িয়ে বোঝার জন্য ইন্টারনেট ঘাঁটলাম, হাতের কাছে ছিল এমন কিছু বই আরেকবার ঘেঁটে টেটে দেখলাম।

আমার অনুসন্ধানের বিষয়Ñনারী অধিকার এবং পর্দা। আমার মনে হলো, আজকের বিশ্বপ্রেক্ষাপটে নারী অধিকার বিষয়ক আলোচনায় পর্দা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। পর্দা কি নারীকে অবরুদ্ধ করে? এটা কি নারীর শরীরে পুরুষের আধিপত্যের পতাকা নয়? তাহলে যে নারীরা পুরুষের প্ররোচনা কিংবা রক্তচক্ষুর কারণে নয়, পর্দা বেছে নিচ্ছে স্বেচ্ছায়, গ্রীবা ঊঁচিয়ে--তাদের ক্ষেত্রে আমাদের কী বক্তব্য? ব্যাপারগুলোতে ভাবনার সংক্রাম আছে। প্রথমে দেখা যাক, পর্দা নারীকে অবরুদ্ধ করে কি-না। একে আমরা পুরুষের অধিপতি হয়ে ওঠার আরেকটি উপায় হিসেবে ধরব কি-না।

হ্যাঁ, আমরা ধরব। ধর্মগ্রন্থ বলেছে শালীন পোশাকের কথা। পুরুষ এবং নারী উভয়ের জন্যই। ধর্মগ্রন্থের যেসব ব্যাখ্যা হয়েছে সেসবে পুরুষকে মাথা-চোখ-মুখ-কান-বাহু উন্মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ রাখা হয়নি। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে উল্লেখিত হয়েছে নেকাবের কথা।

নেকাব আর হিজাব কিন্তু এক নয়। হিজাব নারীর কপাল, চোখ, মুখ উন্মুক্ত রাখে। কিন্তু নেকাবে নারীর প্রায় পুরো মুখমণ্ডল আবৃত থাকে। কেবল ছিদ্রপথে সে বাইরের বিশ্বে দৃষ্টি মেলতে পারে। হিজাবকে বলা যায় নেকাবেরই বিবর্তিত রূপ।

উন্মুক্ত কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে চাইলে, বলা বাহুল্য, হিজাবই নারীর জন্য বেশি সহায়ক। এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না, হিজাব নারীকে ধর্মরক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ--দুটো সুযোগই এনে দেয়। কিন্তু তারপরও কেন বলা হয়--হিজাব নারী-অধিকারের বিপক্ষে যায়? কারণ খুঁজতে হলে খুঁজে দেখতে হবে, পর্দাপ্রথার পেছনে কোন মনস্তত্ব লুকিয়ে আছে। ভেবে দেখতে হবে, বাইরের পৃথিবীতে পা রাখতে হলে নারীকে কেন পুরো শরীর মুড়ে বেরোতে হয়। একটা কারণ হতে পারে, যত বেশি বাধা সৃষ্টি করা যাবে নারীকে অন্তঃপুরে আটকে রাখাটা তত সহজ হবে।

আরেকটা কারণ সম্ভবত, নারী যদি ঘরের বাইরে পা রাখে তাহলে অন্য পুরুষের লোলুপ চোখ যাবে তার শরীরের আনাচে কানাচে। ফলে পুরুষটি তাকে বেদখল করে ফেলতে পারে। অর্থাৎ, আমার গাভীটির ওপর অন্যের লোভী দৃষ্টি যাতে না পড়ে সেজন্যে সেটাকে যেমন গোয়ালে বেঁধে রাখি, নারীকেও তেমন ঘরের ভেতরে আটকে রাখতে হবে। কিন্তু সকল সময় এবং সকল পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নারীকে আটকেও রাখা যায়না। তাকে বেরুতে দিতেই হয়।

অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের প্রয়োজনেই। কিন্তু বাইরে বেরুলে অন্যে দখল নিয়ে ফেলবে তো! হুমম, তাহলে নারী বেরোক, তবে আগাপাশতলা মুড়ে বেরোক। অর্থাৎ, সবসময়ই নারী একটি দখলীকৃত বস্তুই। এই চিন্তাব্যবস্থায় নারীর প্রবৃত্তির নিবারণ কীভাবে হবে তা নিয়েও কোনো সমাধান নেই। পুরুষের লোমশ পেশল উন্মুক্ত বাহু নারীর প্রবৃত্তিকেও তো জাগ্রত করতে পারে।

এই ব্যাপারটা নিয়ে এ ব্যবস্থা কোনো কথা বলে না। নারীর কামনাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় অশ্লীলভাবে। তাই পুরুষের বহুবিবাহ অনুমোদিত হয়। কামার্ত নারী হয় একটা 'ট্যাবু'। তৃতীয় আরেকটা কারণ হিসেবে দোহাই পাড়া হয়, পর্দা নারীকে ধর্ষণের হাত থেতে বাঁচাবে।

লন্ডনের এক মাওলানা মসজিদে বয়ান করেছিলেন, 'ধরুন আপনি বিড়ালের সামনে কিছু মাংস খোলা অবস্থায় রেখে দিলেন। বিড়াল তখন কী করবে? মাংস খোলা থাকলে বিড়াল তো কামড় বসাবেই। ' মাওলানা দেলওয়ার হোসেন সাঈদী এক বয়ানে বলেছেন, 'রসগোল্লা দেখলে জিবে তো পানি আসবেই!' মনস্তত্বটা খেয়াল করুন। নারী উপমিত হচ্ছে, মাংস এবং রসগোল্লার সঙ্গে। উভয়ই খাওয়ার বস্তু।

অর্থাৎ নারী একপ্রকার খাদ্যদ্রব্য। এবং উল্লেখ্য, নারীসঙ্গমের অশোভন পরিভাষা হলো 'খাওয়া'। সব দোষ খোলা মাংসের, রসগোল্লার। তাই মাংস লুকিয়ে রাখতে হবে। তবেই নারী উদ্ধার পাবে।

তাহলে অনিবার্য প্রশ্ন ওঠে, কেমন সে ধর্ম যা পুরুষের কামনা আর ধর্ষকামিতার মাঝে ছায়ারেখা টানতে পারে না? ধর্ম তো কেবল নারীর নয়, পুরুষেরও। তাহলে পুরুষের ধর্ম বাঁচাতে নারীকেই আব্র“ করতে হবে? ধর্ম এত দুর্বল? সম্ভবত তা-ই। নাহলে তো নাস্তিকমাত্রই ধর্ষক হবার কথা। একটু হিসাব করে দেখা প্রয়োজন, কয়জন আস্তিক ধর্ষণ করে, আর কয়জন নাস্তিক। প্রসংগক্রমে, আহমদ শরীফের একটা বাক্য (স্মৃতি থেকে) উদ্ধৃত করি : আস্তিকের চাইতে নাস্তিকেরই ন্যায়ের প্রতি পক্ষপাত বেশি।

কারণ ন্যায়কে বেছে নিতেই তাকে ধর্ম ছাড়তে হয়েছে। অর্থাৎ কথা দাঁড়ালো এই, হিজাব নারীর ব্যাপারে পুরুষের আধিপত্যবাদী এবং বর্বর চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করে। তাহলে এই জিনিস মাথায় দিয়ে নারী অধিকারেব কথা বলাটা স্ববিরোধী, তাই তো? ৩. কিন্তু নারী বিষয়ক ছোটকাগজ 'চন্দ্রাবতী'র ১ম সংখ্যায় সুজান মুয়াদ্দি দারাজের একটি প্রবন্ধের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অনুবাদক প্রিসিলা রাজ। এই প্রবন্ধে লেখক মন্তব্য করেছেন, 'তবে বোরখার (বা পর্দার) কোনো সাধারণ মানে কখনও তেমন করে ছিল না, এর কারণ সম্ভবত এই যে, প্রত্যেক সমাজ এবং প্রত্যেক ঐতিহাসিক মুহূর্ত বোরখার ওপর ভিন্ন ভিন্ন অর্থ আরোপ করেছে।

' পশ্চিমে বোরখাকে একটি আইডেন্টিটি হিসেবে নেওয়া হচ্ছে। প্রেক্ষিতটা সেখানে বদলে গেছে। হিজাব পরার অধিকার 'আদায়' করে নিতে হচ্ছে। হিজাবধারীদের দেখা হচ্ছে সন্দেহের চোখে। একজন মুসলিম নারী সাংবাদিকের লেখা পড়লাম ইন্টারনেটে।

তিনি আমেরিকান। হিজাব পরে রাস্তায় বেরুলে নানান মন্তব্য শুনতে হয় তাকে। কেউ কেউ বিন লাদেনের বর্তমান অবস্থান জানতে চায়। ট্যাক্সি থেকে নামার সময় ট্যাক্সিচালক অনুরোধ করে, 'ডোন্ট লিভ অ্যানি বম্ব অ্যাট দা ব্যাক সিট। ' পশ্চিমের এনলাইটমেন্ট মুসলমানদের সভ্যতা শেখাতে চায়।

চিন্তার পদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়ার এই পশ্চিমা বাতিক 'ওরিয়েন্টালিস্ট'দের ক্ষুব্ধ করে তোলে। ধর্মপালনের স্বাধীনতা তাই একটি অধিকার হয়ে দাঁড়ায়। হিজাব সেক্ষেত্রে আর ধর্মের পতাকা নয়, একটি সাংস্কৃতিক প্রতিবাদও। পশ্চিমা উদারতাবাদের ধোঁকাগুলো অনেক আগেই বেরিয়ে পড়েছে। তাই অধিকার সচেতন মুসলিম নারীরা নিজেদের মতো করে পথ বের করে নিতে চায়।

এক্ষেত্রে, অনেক সময়ই, হিজাব একটি অস্তিত্বগত প্রতীকে পরিণত হয়। লন্ডনের রাস্তায় হিজাব মাথায় হেঁটে চলা নারীটি প্রতি পদক্ষেপে একেকটি দৃষ্টির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। এই প্রতিবাদে সে তার পরিচয়টিকেই মহাস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে। এবং বলে রাখা দরকার সেইসব পশ্চিমা দৃষ্টিতে মুসলিম মেয়েটির পোশাক 'এক্সোটিক'ও। পশ্চিম এবং পুবের সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্বক্ষেত্র বোধহয় তুরস্ক।

এর ভৌগোলিক অবস্থানও একটি কারণ। দেশটি না ইউরোপ, না আরব। তুরস্কের 'কার' নগরীকে কেন্দ্র করে লেখা ওরহান পামুকের 'স্নো' উপন্যাসটি এনলাইটমেন্টের সঙ্গে মুসলিম সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব এবং এদের পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং অবিশ্বাসপ্রসূত সংঘর্ষকে খুব প্রকটভাবে উপস্থাপন করে। 'স্নো' উপন্যাসে দেখা যায়, 'কার' নগরীতে আত্মহত্যা মহামারী রূপে দেখা দিয়েছে। আত্মহত্যার এই প্রকোপ কিশোরী এবং তরুণীদের মধ্যে।

তাদের আত্মহত্যার কারণ হলো, স্কুলে তারা হিজাব মাথায় দিয়ে যেতে পারছে না। সরকারি নির্দেশে তাদের মাথা থেকে হিজাব খুলে নেওয়া হচ্ছে। এটা তাদের কাছে সম্ভ্রমহানির মত ভয়াল একটা ব্যাপার। তারা এই অমর্যাদার শিকার হয়ে কিংবা এর প্রতিবাদ হিসেবে আত্মহত্যা করছে। পশ্চিমে যারা হিজাবের পক্ষে কথা বলছেন তাদের মূল যুক্তি হলো, পশ্চিমা উদারতাবাদ সমাজকে সংহত করেনি, উদভ্রান্তি উৎপাদন করেছে।

এনলাইটমেন্ট তার চিন্তাপদ্ধতি চাপিয়ে দিতে চায়। ধর্ম কিংবা জীবনাচারণ বেছে নেওয়ার অধিকার সকলের হলে, সেটা মুসলিম নারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রযোজ্য তার পোশাকী পরিচয়ের ক্ষেত্রেও। এবং সুজান মুয়াদ্দি দারাজের ভাষায় মুসলিম নারীরা পশ্চিমা নারীবাদীদের 'ছোটবোন' নয়। ৪. এখন প্রশ্ন হলো, ২০০৯ সালের বাংলাদেশে হিজাব মাথায় দেওয়া আমার সহপাঠিনীটিকে কোন গোত্রের অন্তর্ভূক্ত করব।

এক্ষেত্রে কয়েকটি প্রসঙ্গ বোধহয় আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। আমাদের সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে কোন চিন্তাসূত্রটি অধিক শক্তিমান। আমাদের সমাজেও নারীর অস্তিত্বগত প্রকাশের বড় সহায় কি পর্দা, নাকি সেটাই একটা অন্যতম বাধা? ক্ষমতাভোগী শ্রেণীটির মতাদর্শিক অস্ত্রটি কী? নারীকে দমিয়ে রাখতে কোন কৌশল সব থেকে বেশি কার্যকরী? হিজাব নারীকে বেরিয়ে আসতে শেখায় নাকি আপোস করতে বলে? এটি কী তাকে রক্ষণভাগের দিকে ঠেলে পাঠায় না? যদি আমাদের দেশে ধর্ষণের হারের কথা বলা হয়, তাহলে কি একথা বলা যায় না--পর্দা পুরুষের ধর্ষকামিতাকে স্বীকার করে নেয়? আমাদের সমাজ, সময় এবং সংস্কৃতির উপাদানগুলো বিবেচনা করলে বলা যায়, হিজাবটা সুবিধাভোগী পক্ষেরই। আমাদের দেশে পুরুষমানুষ মাংস আর রসগোল্লার মিথটাকেই মিত্রপক্ষ ভাবে। এই মিথেই তারা বুঁদ হয়ে থাকতে ভালোবাসে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.