আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেবলই চোখ ভিজে ওঠে...



যা কিছু ঘটে গেলো গত কয়েকদিনে, সেগুলোর কথা ভাবতে গেলে কেবলই বিমূঢ় হয়ে পড়ি। কোনো চিন্তাই গুছিয়ে করতে পারি না, ঘটনাপ্রবাহ মনের ওপর ভয়াবহ চাপ ফেলে, আর ভাবি- এসব ঘটনা বিশ্লেষণের কোনো পদ্ধতি কি আদৌ আমার জানা আছে? দেখি সারাদেশ দুই পক্ষে ভাগ হয়ে গেছে। কেউ বলছে বিডিআর জওয়ানদের দাবিদাওয়াগুলো সঠিক ছিলো, তাদের এই বিদ্রোহ অসঙ্গত নয়, যেহেতু 'অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত'! আবার কেউ বা বলছেন- যে বিদ্রোহ এতগুলো মৃত্যু উপহার দেয় তা কখনোই সঙ্গত হতে পারে না! ভাবি এ-ও, এই বিদ্রোহের সঙ্গে হয়তো সকলে জড়িতও ছিলেন না, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তো নয়ই। খুব ছোট্ট একটা অংশই এই বীভৎস খুনের সঙ্গে জড়িত। কারণ ইতিহাসই বলে, সারা পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতগুলো বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সব জায়গাতেই কিলার গ্রুপ ছোট আকারের।

যৌক্তিক কারণেই এটা হয়ে থাকে। খুনের পরিকল্পনা অনেক লোক জানা মানে, ফাঁস হয়ে যাবার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া। কিন্তু যারা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়নি, অথচ বিদ্রোহ করেছে, তারা? তাদের ব্যাপারে আমরা কি ভাববো? আমি নিজেই নিজেকে বোঝাবার জন্য বিশ্লেষণ করতে বসি। ভাবি- দীর্ঘকাল ধরে নিপীড়িত-বঞ্চিত বিডিআর সদস্যরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বিদ্রোহটা করেছে কম দুঃখে নয়! তারা জানতো- জয়ীই হোক আর পরাজিতই হোক তাদের জন্য অবধারিত হয়ে আছে কঠোর শাস্তি। সামরিক বাহিনীর ভেতরে থেকে 'শৃঙ্খলা ভঙ্গ' মানেই তো নিশ্চিত শাস্তি।

তবু তারা এই বিদ্রোহ করলো কেন? জীবন কি এতটাই দুঃসহ হয়ে উঠেছিলো যে এই অবধারিত শাস্তির কথা জেনেও এই বিদ্রোহটাকেই সঠিক উপায় বলে মনে হয়েছিলো তাদের? জানতে পারি, বেতন-ভাতার প্রসঙ্গ ছাড়াও তাদের প্রধান অভিযোগগুলোর মধ্যে একটি ছিলো- কর্মকর্তারা তাদেরকে মানুষ বলে মনে করতেন না, এতটাই ছিলো দুর্ব্যবহারের মাত্রা। ভাবি-- মানুষ হিসেবে নূন্যতম মর্যাদা পাওয়ার অধিকার তাদের ছিলো/আছে। তারা তো আমারই ভাই, এই দেশের খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিনিধি! এই বিদ্রোহ তো সেই মর্যাদাবোধ আর একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার ফল! কিভাবে তাহলে এই বিদ্রোহকে অসঙ্গত বলবো? আর ঠিক তখনই টেলিভিশন থেকে ভেসে আসে আহাজারির শব্দ, সামরিক কর্মকর্তাদের স্বজনদের কান্নায় আকাশ ভারি হয়ে উঠতে দেখি। মর্মান্তিক-বীভৎস মৃত্যুর শিকার হওয়া সামরিক অফিসারদের লাশগুলো দেখে শিউরে উঠি, আতংকে নীল হয়ে যাই... পরিবারগুলোর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, কান্না-হাহাকার-আহাজারি দেখি, অনুভব করি স্বজন হারানোর বেদনা, কারণ- তারাও তো আমারই ভাই! আমি মৃত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবি- এমন বীভৎস মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। প্রতিটি মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার আছে, প্রতিটি মানুষের অধিকার আছে মৃত্যুর আগে প্রিয়জনের মুখগুলো শেষবারের মতো দেখে যাওয়ার।

আমি কোনো পক্ষ নিতে পারি না। বরং সবকিছুর চেয়ে আমার কাছে বড় হয়ে ওঠে এই অনাকাঙ্ক্ষিত-অগ্রহণযোগ্য মৃত্যু। এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে আমি ক্ষুব্ধ, ব্যথিত, হতাশ ও বেদনাক্রান্ত হয়ে উঠি। অবশেষে কেউ একজন তাদের ইউনিফর্মগুলো খুলে নিলে আমার সামনে থেকে অফিসার-জওয়ান পার্থক্য ঘুচে যায়, দেখি সবগুলো মুখই মানুষের মুখ। আমি তাই মানুষের পক্ষ নিই।

দেখি, তাদের কেউ হয়তোবা গ্রামের কৃষক-পরিবার থেকে আসা যুবক, একটু 'ভালো' থাকার বা 'সুন্দর জীবনের স্বপ্ন চোখে মেখে তাকিয়ে আছে; কেউ হয়তো মধ্যবিত্ত, বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের যুবক, 'সিকিউরড' নিরাপদ জীবনের স্বপ্ন মাখা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে! তাদের সকলের চোখেই একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনের স্বপ্ন, একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। টের পাই, ইউনিফর্ম খুলে ফেলার পর যে লোকটিকে দেখতে পাচ্ছি, সে নিতান্তই এক সাধারণ মানুষ, ঠিক যেন আমারই মতো! আমাদের চাওয়াগুলোও যেন এক- একটু নিশ্চয়তা, একটু মর্যাদা, একটু সুন্দর জীবন! আমি নিথর হয়ে থাকা মুখগুলোর মধ্যে নিজেকেই দেখি, জীবনের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো অথবা রাতের অন্ধকারে গুম হয়ে যাওয়া মুখগুলোর মধ্যে নিজেকেই খুঁজে পাই! আমি তথাকথিত লেখকসুলভ নির্মোহতা আর ধরে রাখতে পারি না, এই মর্মান্তিক-ভয়াবহ-অসহনীয় মৃত্যু, এই অনিশ্চিত-নিরাপত্তাহীন-পলাতক জীবন আর তার মধ্যে বিমূঢ় হয়ে থাকা চিরদুঃখী মাতৃভূমিকে দেখে আমার চোখ ভিজে ওঠে, কেবলই চোখ ভিজে ওঠে... এ বিষয়ে আমার প্রথম লেখাটির লিংক : Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।