আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অমলিন শহীদ মিনার ফেরত চাই

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

২ টাকার নোটের উপরে শহীদ মিনারের ছবি দেখে ছেলের ইচ্ছা হয়েছে যাবে শহীদ মিনার। তাকে কয়েক দিন ধরেই এই দিক সেই দিক বুঝিয়ে হয়রান। অবশ্য শহীদ মিনারের একটা ইতিহাস আছে। টোনাটুনি সিরিজের একটা ভিসিডিতে দেখিয়েছিলো স্কুলের ছেলে মেয়েরা শিক্ষা সফরে যাচ্ছে লালবাগের কেল্লা, সেখানে যাওয়ার পথে তারা হাইকোর্ট বিল্ডিং, কার্জন হল এবং শহীদ মিনার দেখে বাসের জানালা দিয়ে। সুতরাং ভিসিডি শিক্ষিত ছেলে যখন দুই টাকার নোটের উপরে আঙ্গুল দিয়ে বললো এটা কি? আমি না দেখেই উত্তর দিয়েছিলাম, ওটা দোয়েল পাখি।

ছেলের প্রতিবাদে তাকিয়ে দেখলাম ও শহীদ মিনারে আঙ্গুল রেখে বলছে এটা শহীদ মিনার। অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই, তাই বললাম ওটা শহীদ মিনার। আমরা কি শহীদ মিনার যেতে পারবো? আমরা অবশ্যই শহীদ মিনার যাবো। ছেলে কোথা থেকে এই রকম নাটকীয় ভঙ্গীতে কথা বলা শিখেছে এটা নিয়ে ব্যপক পারিবারিক গবেষণা চলছে, এখনও অনির্ণীত বিধায় আমি জানি না ও কোথা থেকে এই কথা বলবার ভঙ্গীটা অর্জন করলো। ঠিক আছে বাবা আমরা শহীদ মিনার যাবো।

সেদিন সন্ধ্যায় ওকে নিয়ে বাইরে বের হলাম, কলা কিনতে, আমরা কোথায় যাচ্ছি বাবা? আমরা যাচ্ছি কলা কিনতে। না, আমরা যাচ্ছি শহীদ মিনার। আমরা শহীদ মিনার যাবো শনি বার। আজকে আমরা কলা কিনবো। নাহ আমরা আজকে শহীদ মিনার যাবো, শনি বার কলা কিনবো।

এইসব কথা বলে ঘোর সন্ধ্যায় শহীদ মিনারে যাওয়ার জন্য কোনো ভাবেই উদ্বুদ্ধ হলাম না আমি। তবে শনি বার স্বরস্বতী পূজা। পূজার মন্ডপ দেখতে যাবো জগন্নাথ হলে। সে সময়েই শহীদ মিনার দেখানো যাবে। সুতরাং স্বরস্বতী পূজার দিনে সকালে উঠে ফুরফুরে মেজাজে রওনা দিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে।

আমরা কোথায় যাচ্ছি বাবা? আমরা যাচ্ছি শহীদ মিনার। শহীদ মিনারে আমরা কি করবো? আমার প্রথম শহীদ মিনার দেখবার স্মৃতি মনে পড়ে প্রতিবার শহীদ মিনারের সামনে আসলে। এমনিতে মফস্বলের ছেলে হিসেবে শহীদ মিনারের সাথে পরিচয় বইয়ের পাতায়। জল রং এ শহীদ মিনার দেখেছি আগে, নিয়মিত প্রভাত ফেরীতে খালি পায়ে যাওয়ার প্রবনতাও ছিলো একটা সময়ে। তবে স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো ঘটনা ঘটলো প্রথম বার ঢাকায় আসবার পরে।

তখন ফাল্গুনের শেষ, রমজানের বন্ধ ছিলো বোধ হয়, ঢাকায় এসে চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ডাবল ডেকার বাস দেখে, চড়ে, শিশু পার্কে ঘুরে দিন কাটানোর পরের দিন বাবার সাথে আসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন ঢাকা অনেক শান্ত, অনেক বেশী নিঃস্তব্ধ। ফেরীওয়ালা নেই তেমন, টিএসসির পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল ফ্যাসিলিটির পাশ দিয়ে আগাচ্ছি, ফুটপাতে তখন ততটা আবর্জনা থাকতো না। শহীদ মিনারের পাশ সোনালু গাছের হলদে লতানো ফুলের ঝুড়ি, পাশে লাল কৃষ্ণচুড়া, চমৎকার রৌদ্রোজ্জল একটা দিনে আমরা বাবার সাথে শহীদ মিনারের সামনে। শহীদ মিনারের বেদী তখন ঝকঝকে তকতকে থাকতো।

প্রথম বার দেখবার পরে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিলো শহীদ মিনারে একগোছা ফুল দিতে হবে। বাবার কাঁধে চড়ে সোনালু গাছে হলদে ফুলের ঝুড়ি ছিড়ে খালি পায়ে উঠে শহীদ মিনারে আমার প্রথম অর্ঘ্য দিয়ে আসলাম । এরপরে অনেক বার গিয়েছি শহীদ মিনারে, প্রতিবারই একই অনুভুতি হয়েছে, শুভ্র একটা অনুভুতি হতো শহীদ মিনারে গেলে। নিজের ভেতরে কোনো কথা খুঁজে পেতাম না। কিছুটা শ্রদ্ধামিশ্রিত নম্রতা চলে আসতো আচরণে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে শহীদ মিনার তখনও শুধুমাত্র ভাষা আন্দোলনকে সম্মান জানানোর একটা জায়গা। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে যখন পৌঁছালাম, তখন মাঘের মাঝামাঝি, প্রকৃতি অনেক রকম অনাচার দেখিয়েছে আমাকে, এমন কি ঘোর শীতের রাতে এক দিন কোকিলের ডাক শুনেছি, কিন্তু বাণিজ্যিক শহরে এখন এমন কি পার্কের কদম গাছ থেকেও ফুল ছিড়ে রাস্তায় বিক্রী করে মানুষ। ন্যাড়া গাছগুলোর সামনে এসে মনে হলো যদি বুদ্ধি করে এক তোড়া ফুল নিয়ে আসতাম ভালো হতো। সৈন্দর্য্য বর্ধনের নামে শহীদ মিনারের পাশে লাগানো ফুলের গাছগুলো উপড়ে ফেলা হয়েছে, সেখানে গগন শিরিষ আছে, আগে যে কয়টা সোনালু কিংবা স্বর্ণচুড়ার গাছ ছিলো, সেসব কাটে ফেলেছে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ, এনেক্সের সামনের কৃষ্ণচুড়া গাছটাও বোধ হয় কেটে ফেলেছে তারা। একেবারে ন্যাড়া একটা দিনে আমি ছেলেকে নিয়ে পৌঁছালাম শহীদ মিনারে।

প্রেমবিহীন শহরে শহীদ মিনারের বেদী এখন প্রেমিক-প্রেমিকাদের বসে ফুচকা খাওয়ার জায়গা। আমি প্রতিবার দৃশ্যগুলো দেখে আহত বোধ করি। কিন্তু প্রেম এবং বাণিজ্যকে অগ্রাহ্য করতে পারি না। পার্ক দখল করে নিচ্ছে মানুষ, সমস্ত শহরের প্রেমিক প্রেমিকা সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্ত্বরে প্রেম করবার অবসর খুঁজছে, অনাকাংক্ষিত হলেও শহীদ মিনারের সামনে প্রেমিক প্রেমিকাদের ফুচকা খাওয়া দেখতেই হবে। ঘাতক দলাল নির্মূল কমিটি যখন শহীদ মিনারের পাদদেশে উন্মুক্ত আদালত করলো এরপর থেকেই মনে হয় শহীদ মিনার অনেক বেশী রাজনৈতিক কর্মসূচির জায়গা হয়ে গেলো।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আমরণ অনশন- শহীদ মিনারের পাদদেশে। বামপন্থী দলগুলোর প্রতীকি অনশন- শহীদ মিনারের পাদদেশে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পথনাট্য উৎসব- শহীদ মিনারের পাদদেশে। রাজনৈতিক কর্মসূচি আর সাংস্কৃতিক কর্মসূচি নিয়ে আমার তেমন এলার্জি নেই, কিন্তু শহীদ মিনার স্থাপনার ভেতরে যেই স্তব্ধতা, মৌনতা এবং একাকীত্ব ছিলো, সেই বোধটুকু হারিয়ে ফেলেছি আমি। এখন শহীদ মিনার শুধু কয়েকটা উঁচু দেয়াল, শুভ্রতাবিহীন সভ্যতার কঙ্কাল, আমাদের সাংস্কৃতিক উৎশৃঙ্খলতার খোলস শহীদ মিনার।

টুরিস্টের মতো সংস্কৃতিক সম্পর্কবিহীন শহীদ মিনারের পাদদেশে বসে থাকা মানুষদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখনও শহীদ মিনার দেখি নি আমি, বাবা ঐ যে শহীদ মিনার? ছেলেকে আঙ্গুল তুলে দেখানোর সময় তাকিয়ে দেখি শহীদ মিনার নেই দৃষ্টিপটে। ক্যানভাসের ত্রিপল আর এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা কফিন শুয়ে আছে, মাঝের লাল সূর্য্যটা ঢেকে গেছে, সা'দাত হুসেনের ব্যঙ্গ চিত্রে সয়লাব হয়ে থাকা শহীদ মিনার আমি দেখাতে চাই নি ছেলেকে। এই শহীদ মিনার আমার নিজের ভেতরের শ্রদ্ধাবোধে ঘুণ ধরিয়েছে। আমি এখন শহীদ মিনারকে তেমন শ্রদ্ধা করতে পারি না, আশৈশব লালন করে আসা নম্রতার বোধগুলো হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন, যতবার এই রাস্তা ধরে যেতে হয়, আমি পারত পক্ষে শহীদ মিনারের দিকে তাকাই না এখন।

শেষ বার যখন এসেছিলাম শহীদ মিনার, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কয়েক দিন পরেই, তখন একটা প্রতীকি দৃশ্য দেখেছিলাম, শহীদ মিনারের বেদীর উপরে এক পা তুলে প্রস্রাব করছে একটা কুকুর, এই দৃশ্যটার পৌনপুনিকতা দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত। আমি ২৭তম বিসিএসে বঞ্চিত সকল মানুষদের বঞ্চনার প্রতিবাদকে সমর্থন করতে পারি না। তাদের নিয়ে বিশিষ্ট সুশীল সমাজের সুশীল চুলকানি আমার পছন্দ না এমন কি যারা নির্বাচিত হয়েছিলো, তদের স্বজনদের কাফন পড়ে হাস্যরক মিছিল এবং কফিনে শুয়ে থাকাটাকেও হাস্যকর মনে হয় আমার কাছে। এদের অনেকেই হয়তো অন্যায় করে নি, হয়তো অনেকেই বাস্তবিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এটাও সত্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনে রাজনৈতিক প্রভাবে এবং ঘুষ দিয়ে বিসিএসের চাকুরী নেওয়া মানুষের সংখ্যা কম নয়, এই সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটাই একটা অসুস্থ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের চিত্র।

এখানে যোগ্যতার যাচাই হয় না। যেসব মানুষ বিসিএস ক্যাডার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলো তাদের সবার যোগ্যতা ছিলো এমনটা আমার বিশ্বাস হয় না। তারা একটা ইমোশন তৈরি করতে চাইছে, এবং এই ইমোশনটা তৈরিতে ব্যর্থ হয়ে তারা নানাবিধ কর্মসূচি দিচ্ছে। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে গেজেট প্রকাশর উচিত হয়েছে কি হয় নি, এটা নিয়ে আইনি বিতর্ক চলতে পারে, তাদের বিষয়টা মানবিক ভাবে বিবেচনা করা হবে বলবার পরে, তাদের পুনর্বহাল না করে নতুন সাক্ষাৎকারে নির্বাচিতদের চাকুরি প্রদান করা উচিত হয়েছে কি হয় নি এটা নিয়ে যে বিতর্ক চলবে সেটাতে তাদের আমরণ অনশনের বদলে বিকল্প যেই ব্যবস্থাগুলোর সুপারিশ করা হয়েছে সেসব নিয়ে ভাবলে বোধ হয় ভালো। তারা যদি সত্যিকারের যোগ্য হয় তবে তাদের জন্য এই বিসিএস, এবং পরবর্তী বিসিএসে বিশেষ ব্যবস্থায় পরীক্ষা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, তারা সেই সুযোগ গ্রহন না করে যখন নিজেদের পুনর্বহালের দাবিতে আমরণ অনশন করে, যখন তাদের বাবারা কাফন জড়িয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকে, সেই দৃশ্যের ভেতরে একটা মানবিকতার বিকার প্রকাশের চেষ্টা থাকে।

আমি আক্রান্ত বোধ করি, তাদের বলতেও পারি না, এইসব সস্তা নাটক না করে বরং ছেলেকে সাহস যোগান। সে যেনো পুনরায় পরীক্ষা দিয়ে নির্বাচিত হতে পারে, যে মানুষটা একবার নির্বাচিত হয়েছে, তার সে যোগ্যতা আছে, যে যতবার পরীক্ষা দিবে টিকে যাবে। যদি সেটা পছন্দ না হয়, তবে আদালতে মামলা করেন। কিন্তু এই মচ্ছব থামান। নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, বঞ্চিত বিসিএস নির্বাচিতরা এবার আমরণ অনশনে যাচ্ছে।

শহীদ মিনারের বেদীতে শুয়ে থাকা এই মানুষগুলোকে পুলিশ পিটিয়ে সরিয়ে দিবে ২০শে ফেব্রুয়ারী রাতে। এটাই বাস্তবতা। বরং অনুরোধ অপরাজেয় বাংলা, যেখানে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালিত হওয়ার এবং রাজনৈতিক আন্দোলন সুচনার ঐতিহ্য আছে, সেই স্থানে গিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেন ভাইয়েরা। এমন কি চাইলে পিএসসির সামনের রাস্তায় শুয়ে, বসে ঘুমিয়ে প্রতিবাদ করেন। শহীদ মিনারকে দুষণমুক্ত রাখেন আপনারা।

নিতান্ত অমানুষের মতো শোনালেও, আমার অবস্থান পরিস্কার, আমি শীদ মিনারের সামনে এইসব তথাকথিত মানবতাবাদী , বঞ্চিতদের অব্যহত নাটক দেখে দেখে ক্লান্ত, এখন বোধ হয় এইসব স্থানে নিয়মিত পুলিশ টহলের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, এসব জায়গায় যেনো অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরু না হয় এটা নিশ্চিত করবার দায়িত্ব প্রশাসনের। আমি অমলিন শহীদ মিনার ফেরত চাই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।