আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শমসের সাহেবের আত্মহনন

...ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাচিয়া,সদাই ভাবনা, যা কিছু পায়, হারায়ে যায়, না মানে স্বান্তনা...

শমসের সাহেব সকাল থেকেই ভাবছেন আত্মহত্যা করবেন। এই জীবন রাখার কোন মানে হয় না। এখন পর্যন্ত কোন কাজে তিনি সফল হন নি। সেই ছোট বেলা থেকে যখনই কোন একটা কাজ করতে চান, কোন না কোন ঝামেলা বেধে যায়। তার জন্মের সময় থেকেই ঝামেলার শুরু।

মায়ের পেট থেকে বেড় হয়ে যখন তিনি দুনিয়াদারি একটু ভালো করে পর্যবেক্ষন করছেন তখনই কথা নাই বার্তা নাই হাসপাতালের কারেন্ট চলে গেলো। অন্ধকারে হুরোহুরিতে নার্স তাকে কার না কার কোলে তুলে দিলো সেই মহিলার গায়ে ভয়াবহ ন্যাপথালিনের গন্ধ। শমসের সাহেব আবার ন্যাপথালিনের গন্ধ মোটেই সহ্য করতে পারেন না। পুরো খালি পেট, তারপরো গন্ধে তার বমি হয়ে গেলো। আলো এলে সবাই তাকে বমি করতে দেখে আই সি ইউ তে পাঠিয়ে দিলো।

জন্মের প্রথম বাহাত্তর ঘন্টা তার কাটলো সেখানে। পরে যখন তাকে বের করা হোল, তখন কেউ খেয়ালই করলো না তিনি ছেলে না মেয়ে!মেয়ে ভেবে তার নাম রাখা হলো সুমাইয়া। তিন মাস পর সবার খেয়াল হলো যে সুমাইয়া আসলে ছেলে। কিন্তু তার নাম সুমাইয়াই রয়ে গেলো। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত শমশের সাহেব সুমাইয়া নাম নিয়েই ঘুরাঘুড়ি করলেন।

পাড়ার ছেলেদের সাথে সুমাইয়া ফুটবল খেলে, ক্রিকেট খেলে। এমনকি সুমাইয়ার মুসলমানীও করা হলো। ঝামেলা হলো স্কুলে ভর্তির সময়। কোন স্কুলই সুমাইয়া নামের ছেলেকে ভর্তি করাতে চাইলো না। তখন তার নাম বদলে রাখা হলো শমসের।

সংক্ষেপে সামছু-থেকে ছামছু। স্কুলে ছামছু ওরফে শমসের সাহেব ছিলেন খুবই ভালো ছেলে। কারো সাথে নাই পাছে নাই। কিন্তু ক্লাসের বদ পোলাপানগুলা তাকে নানা ভাবে জ্বালাতন করতে লাগলো। ক্লাসের বজ্জাত ছেলে সাজ্জাদ যখন তার নাকে ঘুসি মারলো তখন তিনি তার বাবাকে নালিস করলেন।

বাবা তাকে বললেন,’একটা মারলে দুইটা মেরে আসবি’। পিতার আদেশ শীরোধার্য মনে করে পরের দিন যখন তিনি সাজ্জাদের নাকে দুইটা ঘুসি মারতে গেলেন, তখনই টিচার দেখে ফেললো, আর তাকে পুরোদিন নিল ডাউন করিয়ে রাখলো। কলেজে উঠে যখন তিনি বয়সের দোষ বশত তার ক্লাশের সাবিনার প্রেমে পড়লেন, বন্ধু বান্ধব সবাই বললো সাবিনাকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে। তিনিও এক দুপুরে সাবিনাকে ‘আই লাভ ইউ’ বলে ফেললেন। ফেরার সময় সাবিনার সম্মতি নিয়ে ফিরতে না পারলেও তার নিজের সামনের পাটির দু’টো পড়ে যাওয়া দাঁত হাতে নিয়ে ফিরলেন-সাবিনার উঁচু হিলের জুতার কীর্তি।

তারপর থেকে তার নাম হলো ফোকলা ছামছু। তারপর কোন রকম পাশ করে তিনি চাকুরীর বিজ্ঞাপন দেখে দেখে চাকুরির জন্য আবেদন করতে লাগলেন। কেউই তাকে ডাকে না। অনেকদিন পড় একটা অফিস থেকে তাকে ডাকলো। তিনি তার সবচেয়ে ভালো সার্টটা ইস্ত্রী করে সেটা পড়ে রওনা হলেন ইন্টারভিউ দিতে।

কিন্তু, ওই যে, তার কপাল খারাপ। যাওয়ার পথে এক বাসের জানালা দিয়ে কে যেন পানের পিক ফেলে তার কাপড় মাখামাখি করে ফেললো। সদ্য ফেলা পানের পিকের দাগ নিয়ে তিনি হাজির হলেন ইন্টারভিউ বোর্ডে। বোর্ডের সবাই ভাবলো তিনি বুঝি নিজেই নিজের পানের পিক নিজের গায়ে ফেলেছেন। পানের পিকের চিন্তায় বেশীর ভাগ প্রশ্নের উত্তরই পারলেন না।

চাকরিটাও হলো না। আজকাল কর্পোরেট যুগ। পান খাওয়া কর্মচারী কেউ রাখতে চায় না, বিশেষ করে যে আবার পানের পিকটও নিজের গায়েই ফেলে। কে বলতে পারে যদি কোনদিন ক্লায়েন্টের গায়েই পানের পিক ফেলে দেন। এরপর তিনি পাড়ার মধ্যেই একটা বই পত্র,খাতা পেন্সিলের দোকান দিয়ে বসলেন।

কয়েকদিন পর তার বাসা থেকেই তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য মেয়ে দেখা শুরু হলো। তিনিও খেয়াল করলেন, এবার বিয়েটা করা দরকার। আজকাল অনেকেই তাকে আঙ্কেল ডাকে। আর কয়েকদিন পর তাকে আর কেউ মেয়ে দিবে না। তাই তিনিও বেশ চনমনে হয়ে উঠলেন।

একটা মেয়েকে পছন্দও হলো। আগামী পরশু তার বিয়েও হবার কথা। দু'দিন আগে তার গায়ে হলুদও হয়ে গেছে। কিন্তু তার তো বরাবরই কপাল খারাপ। কাল রাতে খবর পেলেন মেয়ে তার পুরনো প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছে।

তিনি এখন গায়ে হলুদের বিকট গন্ধ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাই অনেক চিন্তা করে তিনি মনস্থ করলেন এই জীবনের আর মানে হয় না। আত্মহত্যাই বেশ। ডিসিশানটা নিয়ে ফেলার পর তিনি ঠিক করতে বসলেন কিভাবে আত্মহত্যা পর্বটা শেষ করা যায়। সহজ উপায় হচ্ছে গলায় দড়ি দেয়া।

একটা দড়ি ঝুলিয়ে তাতে ঝুলে পড়া। কিন্ত সমস্যা হলো গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেলে নাকি জিহ্বা বেড় হয়ে আসে। এমনিতেই তার চেহারা ছবি তেমন সুবিধার না। আত্মহত্যা করলে নিশ্চয়ই ‘প্রতিভাবান যুবকের(!) রহস্যজনক আত্মহত্যা’ শিরোনামে ছবিসহ নিউজ বের হবে পেপারে। জীবনে প্রথম ছবি বের হচ্ছে পেপারে, তাও যদি হয় জীহ্বা বের করা অবস্থায়।

হায়। জীহ্বা বের করা অবস্থায় তার ছবিটা কেমন দেখাবে পেপারে চিন্তা করেই তিনি গলায় দড়ি প্রকল্প বাদ দিয়ে দিলেন। আর যেটা করা যায় সেটা হলো কোন উচু দালান থেকে লাফ দিয়ে পড়া। কিন্তু তার বেজায় উচ্চতা ভীতি। উচু কোথাও উঠতেই তিনি বেজায় ভয় পান।

তাই এই চিন্তাও বাদ। সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ঘুমের মধ্যে মারা যাওয়া। তাই তিনি ঠিক করলেন ঘুমের ওষুধ খেয়ে মারা যাবেন। কিন্তু তিনি তো জানেন, তার কপাল বরাবর খারাপ। হয়তো ঘুমের ওষুধে দেখা যাবে ভেজাল।

মরবেন তো নাই, শেষে আবার হাসপাতালে নিয়ে মুখ দিয়ে পাইপ টাইপ ঢুকিয়ে কেলেঙ্কারী। তাই পুরো কাজটা করতে হবে খুবই প্লান করে। যাতে কোন ভাবেই মিস না হয়। তিনি খাতা কলমে নিয়ে প্রত্যেকটা স্টেপ লিখে ফেললেন। পুরো প্লান শেষে বেশ আবেগঘন একটা সুইসাইডাল নোটও লিখে ফেললেন।

ব্যাপক আবেগের ধাক্কায় তিনি ‘হে পৃথিবী বিদায়’ নামে একটা কবিতাও লিখে ফেললেন সেখানে। সব কাজ শেষ করে তিনি বেড় হলেন ঘুমের ওষুধ কিনতে । এক দোকান থেকে তাকে এতো গুলো ওষুধ দিবে না। তাই তিনি একটা দোকান থেকে পাচটা করে দশটা দোকান থেকে সর্বমোট পঞ্চাশটা ওষুধ কিনবেন ঠিক করলেন। প্রথম দোকানটা থেকে পাঁচটা ওষুধ কিনে যখন তিনি বেড় হচ্ছেন তখনই বিপত্তি।

এক বুড়ো এসে হাত পাতলো। বেচারার মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা লাগবে, যদি তিনি কিছু সাহায্য করেন। এসব জিনিস রাস্তা ঘাটে হরহামেশাই হচ্ছে। তাই তিনি এসবকে তেমন পাত্তা দেন না। তার নিজের বিয়েই হলো না, আর একজনের বিয়ে দিয়ে তার কি?আর এসব ঠকবাজদের কিছু একটা শিক্ষা দেয়া দরকার।

মরবার আগে অন্তত একটা ভালো কাজ করা হবে যদি একটা ঠকবাজকে শিক্ষা দেয়া যায়। তাই তিনি মোটামুটি ধমেকর সুরেই বললেন,’আচ্ছা, চলোতো দেখি তোমার বাসায়, তোমার মেয়ের বিয়ের ব্যাবস্থা আমি আজই করবো’। হু হু বাবা এবারই বেড় হয়ে যাবে ঠকবাজ তোমার খেলা। হয়তো দেখা যাবে লোকটার মেয়েই নেই। তাকে অবাক করে দিয়ে লোকটা তাকে জড়িয়ে ধরলো।

‘বাবা আপনে অনেকদিন বাঁচবেন, আপনার এই ঋণ আমি কেমনে শোধ করুম’, লোকটা কেঁদে দিলো। শমসের সাহেব এবার প্রমোদ গুনলেন। হায় হায় এইটা কি রিয়াল কেস?নিজের নির্বুদ্ধিতায় এবার তিনি নিজেই খেপে গেলেন। নিজের পাছায় নিজে লাথি দেয়ার কোন উপায় থাকলে তিনি তাই দিতেন। আফসোস আল্লাহ সেই সিস্টেম রাখেন নাই।

লোকটার মেয়ের বিয়ের ব্যাবস্থা করবেন বলে এখন তিনি নিজেই ফেসে গেছেন। তাই মুখে হাসি ধরে রাখলেও তিনি রওনা হলেন লোকটার সাথে। শহরের শেষপ্রান্তে একটা ছোট বাস্তি মতো জায়গায় এসে পৌছলেন লোকটার সাথে। তাকে বসিয়ে রেখে লোকটা কোথায় যেন চলে গেলো। তিনি অবশ্য কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেন লোকটার হাতে।

বেশ কিছুক্ষন পর তিনি খেয়াল করলেন এই ভাঙ্গা বস্তি এলাকাটা আস্তে আস্তে সেজে উঠছে। এক সময় দেখা গেলো কয়েকজন মুরুব্বিসহ বর এসে পৌছলো। খুব সুন্দর মিস্টিমুখের কনেটিকেও নিয়ে আসা হলো। ছোট্ট এই বস্তিমতো এলাকার খুব সাধারন মানুষগুলোর আনন্দ দেখে শমসের সাহেব মুগ্ধ হয়ে গেলেন। অনেক অভাব,কষ্ট আর সমস্যার মধ্য থাকা মানুষগুলোর হাসিমুখ আর কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি তার মন ভালো করে দিল।

সবশেষে যখন তিনি মেয়েটাকে ছেলেটির হাতে তুলে দিলেন তখন মেয়েটির বাবার সাথে সাথে কখন যে তারও চোখ অল্প ভিজে উঠেছে তিনি খেয়ালই করলেন না। রাতে খুব সাধারন আয়োজনের বিয়ের খাবার খেয়ে যখন তিনি বাড়ি ফিরছিলেন তখন তিনি নিজেই অবাক হয়ে গেলেন এই ভেবে যে অবশেষে একটা কাজ তিনি খুব সফল ভাবে শেষ করতে পেরেছেন যদিও আসল কাজ আত্মহত্যা করাটা এবারো হলো না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.