আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এন্টিগল্প > বিপ্রতীপ পুনর্জন্ম >

যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
(শততম পোস্ট। উৎসর্গঃ যারা এখনো সমুদ্র দেখেনি) নিয়মিত যে পিচ্চি ঢেউগুলো আসছিল মেয়েটির পা স্পর্শ না করেই ফিরে যাচ্ছিল। এবার তাই মেয়টি আরো একটু এগিয়ে দাঁড়াল। এবার জল উঠে এল হাঁটু পর্যন্ত। ঠান্ডা স্পর্শ।

একটু যেন শির শির করে ওঠে। একটা বড়মাপের ঢেউ এসে হাঁটুরও ওপর উঠে গেল। সাথে যে কুঁচো শামুকগুলো ভেসে এসেছিল তাদের অনেকেই আর ফিরতে পারবে না জলে। বালিতে একদিন পরেই মৃত্যু ঘটবে। তখন সন্ধ্যা নামছে খুব ধীরে।

নববধুর দুই ভ্রুর মাঝখানে লাল টিপের মত সূর্যটা টুপ করে ডুবে গেল। লাল কিছু আভা তখনো মেঘের গায়ে লেপ্টে আছে। নীল জলরাশী মুহূর্তে মনে হলো যেন বিশাল একটা দোয়াত উপুড় করে সমুদ্রে ঢেলে দেওয়া কালির মত। কৃষ্ণপক্ষ তাই চাঁদ উঠবে না। সেই কালো তির তির করে নড়তে থাকা জলরাশীর দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকল মেয়েটি।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নিজের অজান্তেই। অন্য কারো জন্য যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল মেয়েটি সেই অন্যজন তখন তার বারান্দায় বসে নির্বাক আকাশ দেখছে। হাজার বার দেখা আকাশ,তবুও যেন মনে হয় অচেনা। আজই প্রথম দেখছে! আসলে সে আকাশ দেখছিল না। আকাশের দিকে চেয়ে রোজই সে আনমনা হয়ে রিওয়াইন্ড করে।

ফেলে আসা টুকরো টুকরো স্মৃতি জোড়া দিয়ে একটা লম্বা সূতো বানায় তাতে ঘুড়ি বেঁধে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে ফিরে যায় শৈশবে। যৌবনের প্যাক্ট স্মৃতিগুলো খুব একটা নাড়া দেয় না, কেননা সেসব কেবলই গড্ডালিকা প্রবাহের ইতিহাস। মিকা। এর নাম মিকা। অদ্ভুতধরণের নাম।

কেন এমন নাম তা নিয়ে আগে মাথা ঘামালেও এখন আর কিছুতেই কোন কিছু যেন যায়-আসে না ওর। মিকা। ব্যাস শুধুই মিকা। পরিণত বয়েসের মিকা আশ্চর্যজনকভাবে প্রকৃতির সবচেয়ে আশ্চর্য্য সৃষ্টি সমুদ্র দেখেনি! এটা নিয়ে অনেকদিন ধরে একধরণের অহমিকা তৈরি করেছিল সে! যেন খুব গর্ব করার মত একটা ব্যাপার! আসলে জীবনের বেপথু চক্রে ঘুরতে ঘুরতে কখন যেন একবার আবিষ্কার করল...সে সমুদ্র দেখেনি! কেন দেখেনি? তার চলনসই কোন কারণ বা ব্যাখ্যাও তার জানা নেই। শেষে এভাবে মিলিয়ে নেয় যে, দেখা হয়ে ওঠেনি।

ব্যাস। মনুষ্য জীবনে কতকিছুই তো করা হয় না। কত মানুষই তো সারাটা জীবন হাজারো না-পাওয়া সম্বল করে মরে যায়,যায় না? খুব যায়! এটা ভেবেই একধরণের সেটেলমেন্ট করে নেয় মিকা। যে মেয়েটি সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে পা ভেজাচ্ছিল তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে অনেকবার মিকা বলেছে তার এই না-দেখা কষ্টের কথা। মিকার সেই পরিণত বয়সের বন্ধু শাদরা মিকাকে বলেছে.... _ যাওনা, একদিন হুট করে চলে যাও, দেখবে ভাল লাগবে.. _কার সাথে যাব? _সাথে লাগে নাকি? বোকা।

একাই চলে যাও, নয়ত বউ-বাচ্চাদের নিয়েই যাও.... _না, এভাবে আর যাওয়া হয়না। যখন একা যাওয়ার বয়স ছিল তখনো যাওয়া যেহেতু হয়নি, আর কি দরকার! _তোমার এই একগুয়েমির কারণে জীবনে কি কি হারিয়েছ জানো? _জানি। নষ্ট সময়কে টেনে টেনে ভাল সময়ে নিতে পারিনি, জয়ীতার পেটের বাচ্চাটা ফেলে দেওয়ার সেই সাহসী সিদ্ধান্তটায় সায় নিতে পারিনি, তাকে তার স্বামীর শেকল থেকে মুক্ত করতে পারিনি,তোমাকে খুব সাহস করে কাছে টানতে পারিনি...... এমন আরো কত না-পারা আছে, যা নিয়ে আর ভাবি না। শাদরা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে অনেক চেনা মুখটা আবারো যেন নতুন করে দেখে। আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

ওর এই শ্বাসটাকে দীর্ঘ করাও একটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে মিকার জন্য কষ্ট হয়,মায়া হয়,কখনো কখনো করুণাও হয়, কিন্তু যখনই বোঝে ‘না’ কে ‘হ্যাঁ’ করতে গেলে একটা বড়ধরণের চড়াই উৎরাই পেরুতে হবে,তখনই পরিণত বযস তাকে হ্যাচকা টানে থামিয়ে দেয়। কিছুতেই আর সে এগুতে পারে না। কোন কোন রাতে, অনেক রাতে মিকার কথা ভাবে। কোন কামনা বা অবসেশন নেই! কেবলই মনে হয় এই শেষহীন পথের শেষ কোথায? শরৎ হেমন্ত পেরিয়ে একসময় শীতও পার হলো।

অনেক দিন শাদরা আর মিকার দেখা হয়নি। আজকাল অবশ্য ওরা দেখা করার চেয়ে ফোনে কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। ফোনের অনেক সুবিধে। চোখে ঘৃণা না করুণা,নাকি প্রত্যাখান তা বেশ চেপে রেখে কথা বলা যায়। হাসি না পেলেও খিল খিল করে হাসা যায়।

মিকা তার ভেতরে বাসা বাঁধা আয়ূক্ষয়ী সেই পরম অনাত্মিয়দের কথা বলতে পারে, যারা খুব ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে মিকাকে শেষ করে দিচ্ছিল। শাদরা ব্যতিব্যস্ত হয়। অমঙ্গল আশঙ্কায় ফোনেই অস্ফুট শব্দ করে। মিকার এসব বেশ লাগে। জানে একদিন কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে তার মাথার ভেতর জায়গা করে নেওয়া পরমাত্মিয়টি বড় হবে, একদিন কাউকে সামান্যতম বিরক্ত না করেই সে আরো বড় হবে, এবং একদিন খুব কম সময়ের ভেতরই সব কিছু শেষের প্রান্তে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে আর কেউ ফেরানোর চেষ্টা করেও তা পারবে না।

এটা যে কষ্টের ভাবনা সেটাকে কি ভাবে যেন মিকা জয় করে ফেলেছিল! শীত শেষ হওয়ার পর পরই যখন পাতাঝরা শুরু হলো,একদিন মিকা শাদরাকে খুব করে কাছে পেতে চাইল। শাদরাও ঠিক করেছিল আসবে। এই শহরের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত অনেক মানুষ যাওয়া-আসা করল,প্রতিমুহূর্তে অজস্র মানুষ একে অপরের কাছে আসল,আবার দূরে চলে গেল। কিন্তু শাদরার আসা হলো না। পরকীয়া ব্যাপারটা বোধহয় এমনই,খুব লুকিয়ে ভালবাসতে হয়।

অনেক অভিজ্ঞতার মিশেলেও মানুষ যেন একেবারেই সেই শৈশবের ফুল ছুঁড়ে দেওয়ার লজ্জা আর বুক দুরু দুরু অবস্থানে চলে যায়। প্রেম বিয়ে সন্তান সংসার এসবের পরিণত অভিজ্ঞতাও কোন কাজে আসে না। তার পরও হতচ্ছাড়া মানব হৃদয় পরকীয়ায় লীন হয়। হতেই হয়। কখনো কখনো কোন উপায় থাকে না মানুষের।

শাদরা আসতে পারল না। মিকা জানে সে আসবে না। তার পরও কেমন একটা ঘোরলাগা টানে বিশ্বাস রেখেছিল, হয়ত আসবে। কিন্তু কেন আসবে সেটা মিকা জানায়নি। অথচ সেটা জানালে শাদরা যত বাধা বিপত্তিই থাকুক ছুঁটে চলে আসত! কেন আসত? এটাই বোধহয় মানুষ পরে ভাবে।

ভাবে.....কেন আগে বলোনি? তুমি যদি বলতে.....কিন্তু বলার পর যদি না আসতো? তাই মিকাও বলেনি। পরিণত বয়সের সামাজিক অবৈধ সম্পর্ক বোধকরি এমনই। সেই রাতে, যে রাতে মিকা খুব করে শাদরা অনুভব করেছিল, খুব করে চেয়েছিল শাদরা এলে তার কোলে মাথা রেখে শোবে। হয়ত সেই শোয়াই শেষবারের মত পরিতৃপ্ত শোয়া হতো। কোন অতৃপ্ত কামনা নয়, কোন শরীরী চাহিদাও নয়, কেবলই শাদরাকে কাছে পাওয়া, কেবলই পরম শান্তিতে তার কোলে মাথা রেখে প্রগাঢ় লম্বা টানা ঘুমের রাজ্যে ডুবে যাওয়া......কিন্তু ঘুমোতে যাবার আগেই মাথার শত্রু আর নালি বন্ধ হওয়া শত্রু একসাথে আক্রমন করে বসল! এ্যাম্বুলেন্স,হাসপাতাল,অক্সিজেন এসবের জন্য যে সময়টুকু পাওয়া গেল তা যথেষ্ট ছিল না, ডাক্তারদের মত সেরকমই।

ভেতরে ভেতরে কতখানি শেষ করেছিল তা কেউ জানেনি বলেই নাকি সময়টা খুব কম ছিল। এই শহরে যখন কোথাও একসাথে হাজার বাতি জ্বলে উঠেছিল, যখন পরম আদরে কেউ তার সন্তানকে বুকে চেপে ধরছিল, যখন নতুন শয়ে শয়ে শিশুর আগমন ঘটছিল..... ঠিক সেই সময়ে, বরাদ্দের শেষ সময়ে মিকা শেষ বার চোখ মেলে চাইল... ব্যতিব্যস্ত আত্মিয়রা ব্যাকুল। কে যেন জানতে চাইল, "কাউকে কি দেখতে চাও?" কোন কথা বেরুল না সেই মুখে। নাকে অক্সিজেন মাস্কটার উপরে ভাবলেশহীন চোখে মনে হয় মুহূর্তে কিছু বলতে চাওয়ার অনুভূতি। কে যেন মুখের কাছে কান নিয়ে শুনতে চাইল.....আরো কিছুক্ষণ বাদে একটা অস্পষ্ট শব্দ.....‘সমুদ্র দেখতে কেমন? ’ একসাথে সমস্বরে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করল, কেউ কেউ বলতে থাকল.....কে শুনছে? বিকেলের আধোআলো আধোআঁধারেরর নীল জলের ওপর শেষ বারের মত চক্কর দেওয়া গাংচিলের নখরে ছোট মাছটা কিছুক্ষণ ছটফট করে শান্ত হয়ে গেল।

এখন আর সীগালরাও নেই। এ্যালবাট্রসরা মাস্তুলে ছিল, তারাও ঘরে ফিরেছে। অনেক দূরে কিছু সাম্পান একবার ডুবে যাচ্ছে আবার যেন ভেসে উঠছে। অনেক রাতে মিকার ফোনে একটা কল এলো। টেলিপ্যাথী না।

স্রেফ শাদরার রুটিন কল। মিকার ছোট ছেলে বলেছিল খবরটা। ধাক্কাটা সামলানোর জন্য শাদরা প্রায় মিনিট খানেক পজ নিয়েছিল। তারপর ফোনটা কেটে দিয়েছিল। ঘোরের মধ্যে হেঁটে হেঁটে বড় আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ নিজের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়েছিল।

হাতে উঠে এসছিল চুলের কাঁটা। কাঁটা দুটো খুব ধীরে চোখের দিকে উঠে আসতে চেয়েও আসেনি। মানুষ বোধকরি তার একটা লোমকূপকেও প্রচন্ড ভালবাসে। এরও সাত দিন পর একটা কিশোরী দাঁড়িয়েছিল বেলে ভূমিতে। একা।

নিয়মিত যে পিচ্চি ঢেউগুলো আসছিল মেয়েটির পা স্পর্শ না করেই ফিরে যাচ্ছিল। এবার তাই মেয়টি আরো একটু এগিয়ে দাঁড়াল। এবার জল উঠে এল হাঁটু পর্যন্ত। ঠান্ডা স্পর্শ। একটু যেসন শির শির করে ওঠে।

একটা বড়মাপের ঢেউ এসে হাঁটুরও ওপরে উঠে গেল। দরিদ্র ঘরের অনাদরে বেড়ে ওঠা মেয়েটি দুটি চোখ হারিয়ে কতকাল যে অন্ধ ছিল, সে কার যেন দান করা একজোড়া চোখ পেয়ে হাসপাতাল ছাড়ার পরদিনই বলেছিল....... ‘সমুদ্র দেখতে কি অনেক টাকা লাগে বাবা!’ দিনমজুর বাপ মেয়েটির এই আব্দার মেটানোর জন্য সেই রাতেই ঘরের খুঁটিতে জমানো পয়সা দিয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে গেছিল সমুদ্রে। কেন তা নিজেও যানে না। একটা জামা কিনে দিতে পারে না যে বাবা সে কেন এলো কেউ জানতে পারল না। বড় বড় দুটো চোখ দিয়ে মেয়েটি অবাক বিস্ময়ে অপার মমতায় সমুদ্র দেখতে থাকল।

নিজের অজান্তেই জলের ধারা গন্ড বেয়ে নোনা জলে মিশে গেল!
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।