আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আবিষ্কার



লাশটা তিনদিন ধরে বেওয়ারিশ পড়ে ছিল - মর্গে। এ রকম খবর খুঁটিয়ে পড়ার আগ্রহ আমার কখনো হত না। কিন্তু নামটার ওপরে চোখ আটকে গিয়েছিল। পুরোটা পড়ে নিশ্চিত হলাম ইনি সেই মানুষ যার কাছে আমি এক সময় অঙ্ক করতাম - সেও দশ বছর আগের কথা। লোকটার মেধা নিয়ে আপনার সন্দেহ থাকার কথা না।

এই সময়ের হাজার হাজার পাঁচ পাওয়া মেধাবীর চেয়ে অনেক উঁচু স্তরের মেধা ছিল তার। তখনকার বোর্ডস্ট্যান্ড, বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম পাঁচে থাকা - আরেকটু বেশি বলতে পারলে ভাল লাগতো। কিন্তু বুয়েটে পড়ার সময়েই তার ক্যারিয়ার অন্যদিকে মোড় নেয়। অতি মাত্রায় টিউশনির নেশা পেয়ে বসে। অবশ্য এই নেতিবাচক ব্যাপারটি অন্যের মুখে শোনা।

তাই সত্যতার ১০০% নিশ্চয়তা দিচ্ছি না। প্রথম বছরে রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় আক্ষরিক অর্থেই তার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারপর বুয়েট ছেড়ে দেওয়া, সেই টিউশনি চালিয়ে যাওয়া, অসুস্থতার মাঝেও জগন্নাথ থেকে অঙ্কে মাস্টার্স করা। - এর পরে কোন এক সময়ে তার কাছে আমি পড়তে শুরু করি - ইন্টারমিডিয়েটের অঙ্ক। শুরুটা ভালোই ছিল।

বেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলাম। পড়ার মাঝেই মজা করতাম অনেক। তাকে ভাইয়া ডাকতাম। প্রায়ই চকলেট আনতেন আমাদের জন্য। মনে পড়ে - একবার বাজারে ছাড়া হয়েছিল পঞ্চাশ টাকার নতুন নোট।

ভাইয়া একটা নিয়ে এসেছিলেন। তার দুই স্টুডেন্ট এর মধ্যে আমি ছোট বলে নোটটা আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। আর একদিন পড়াতে এসে বললেন রিকশাওয়ালাকে একশ টাকার নোট দিয়ে এসেছেন, আর খুব অবাক হয়েছেন দেখে যে রিকশাওয়ালা কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না - ধন্যবাদ দেয়া দূরে থাক। মাঝে মাঝেই এরকম পাগলামি করতেন। তার যুক্তি ছিল - মানুষ তাকে ভাল বলবে!!! অনেক লম্বা আর মোটা ছিলেন ভাইয়া।

বেশ ভোজন রসিক ও বটে - মা হাসাহাসিও করতেন তাকে নিয়ে। কখনো কখনো পড়ার সময়ের বাইরেও এসে বাবার সাথে ধর্ম-সমাজ নিয়ে আলোচনা করতেন। আমার মনে হয়েছে - বেশ ধার্মিক ছিলেন তিনি। তবে গোঁড়া বলা যাবে না। আমার নাম দেখে মাঝে মাঝে আফসোস করতেন, বলতেন - তার নামটা আরবিতে না হয়ে আমার মত বাংলায় হলে ভাল হত! তার ইচ্ছে ছিল নিজের বাচ্চাদের নাম বাংলায় রাখবেন।

আমি জানি না পরে তিনি বিয়ে করেছিলেন কি না, বাচ্চা ছিল কি না। আমাদের পড়ানোর শেষ দিকে তার পাগলামি কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল। আমরা নিজেদের মত অঙ্ক করে যেতাম, তিনি ঘুমাতেন কিংবা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতেন। কথা বলতেন খুব কম। গাল বেয়ে চুলের তেল গড়িয়ে পড়ত।

ভয় পেতাম আমরা। কোর্স শেষের দিকে ছিল, আর আমার অন্য বন্ধুর সাথে সময়ে না মেলায় ভাইয়ার কাছে পড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। পরেও দু-একদিন তিনি এসেছিলেন বাসায়। বুয়েটে পড়ার সময় শুনেছিলাম তিনি বেশ ভাল একটা স্কুলে ম্যাথ টিচার হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এখানেও নাকি তার প্রিয় স্টুডেন্টদের চকলেট খাওয়াতেন! রাস্তায় একদিন আমার বন্ধুর সাথেও নাকি দেখা হয়েছিল - দু টাকা চেয়ে নিয়ে পাশের দোকান থেকে চা খেয়েছিলেন।

এরপর অনেকটা সময় চলে গেছে। তার কোন খোঁজ নেইনি - স্বীকার করছি। কিন্তু হঠাৎ করে খবরের কাগজে এতটা মর্মান্তিকভাবে তাকে আবিষ্কার করতে হবে - এটা ভাবতে পারিনি। ট্রেনের ধাক্কায় নাকি এই পরিণতি। তিন দিন পর তার ভাই তাকে সনাক্ত করেছিলেন।

ভাইয়া একটু বেখেয়ালি ছিলেন। দশ বছর আগের চেনা মানুষটা শেষ পর্যন্ত কেমন হয়েছিলেন জানিনা। তবে তাকে জীবন সম্পর্কে সন্তুষ্ট ভাবতে পারিনি। তাই suicidal attempt শব্দটা মাথা থেকে তাড়িয়ে দিতে পারছি না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।