আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাটি ও মানুষের কবি: ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে!

শ্রদ্ধা আর মমতাই তোমাকে জয়ী করতে পারে; তুমি তোমার জ্ঞান প্রয়োগ কর।
১৯২৭ সাল। প্রবেশিকা বাংলার নতুন বছরের পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করা হবে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচকমন্ডলীর সভা বসল। গভীর পর্যবেক্ষণ চলছে গল্প, কবিতার উপর।

সভার একজন সদস্য হঠাৎ অদ্ভুত এক প্রস্তাব করে বসলেন: পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের আই.এ. ক্লাসের এক ছাত্রের কবিতা সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। হেসেই ফেলার কথা অন্য সদস্যদের, কিন্তু সভাটি নেহায়েৎ আনুষ্ঠানিক এবং প্রস্তাবকারী সদস্য একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিও বটে। হাসি চেপে, প্রতিবাদের ঝড়টি তাই বড় করে তুললেন তারা। সদস্যটি তখন বললেন, "ঠিক আছে, আমি কবিতাটি পড়ছি, আপনারা একটু ধৈর্য্য ধরে শুনুন। " আবৃত্তি শুরু হতেই নড়ে চড়ে বসলেন সবাই।

তারপর একেবারে স্থির সমাহিত হয়ে গেলেন, মন্ত্রমুগ্ধের মত, কিন্তু হৃদয়ে উঠল গভীর ঝড়। বড় মানুষদের কাঁদতে নেই, কবিতার প্রবাহের সাথে কথাটি ভুলে গেলেন তারা। কবিতা শেষ হলে দেখা গেল অত বড় বড় মানুষের চোখ জলে চিকচিক করছে। সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল সাদামাটা, কিন্তু অসাধারণ, মর্মস্পর্শী কবিতাটি: নাম কবর। আবৃত্তিকারী দীনেশ চন্দ্র সেন, পূর্ববঙ্গ গীতিকা বা ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক ও সম্পাদক হিসেবেই আমরা তাঁকে বেশি চিনি।

আর তরুণ কবির নাম জসীমউদদীন, তিনিও ময়মনসিংহ গীতিকার উল্লেখযোগ্য অংশের সংগ্রাহক। এবং তিনি আমাদের পল্লীকবি, আমাদের সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রত্রয়ীর একজন। বিশ্ব কবির ধ্রুপদী সঙ্গীত এবং বিদ্রোহী কবির খেয়াল সঙ্গীতের সমান্তরালে, তিনিও, তাঁর সাহিত্য রত্নগুলির পাশাপাশি, সঙ্গীতের একটি স্বতন্ত্র ধারা বয়ে নিয়ে যান: লোকসঙ্গীত--মাটি ও মানুষের চিত্র, কথা ও সুর দিয়ে। তাঁর কিছু বিখ্যাত পল্লীগীতি হল: *নিশীথে যাইও ফুলবনে *আমায় এত রাতে ডাক দিলি *ও সই কদম তলে *তোরা কে কে যাইবি লো জল আনতে *আমার গলার হার *বন্ধু রঙ্গীলা *ও আমার দরদি *নদীর কূল নাই *আমায় ভাসাইলিরে *আমি বাইয়া যাই কোন ঘাটে *উজান গাঙের নাইয়া *বৈদেশি কন্যা *কেমন তোমার মাতা-পিতা *আমার বন্ধু বিনোদিয়া *আমার সোনার ময়না পাখি *রাসুল নামে পল্লীকবির প্রধান কিছু কাব্য গ্রন্থ রাখালী, নকশী কাঁথার মাঠ, বালুচর, ধানখেত, সোজন বাদিয়ার ঘাট, রঙিলা নায়ের মাঝি, মাটির কান্না, সুচয়নী, হাসু। পদ্মাপার, বেদের মেয়ে, মধুমালা তাঁর কতিপয় নাট্যগ্রন্থ এবং বোবাকাহিনী মর্মস্পর্শী উপন্যাস।

শিশুদের জন্য লিখেছেন হলদে পরীর দেশে, ডালিমকুমার, এক পয়সার বাঁশি সহ আরো কিছু গ্রন্থ। ১৯০৩ সালের ১লা জানুয়ারি, ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে কবি জন্মগ্রহণ করেন; শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৭৬ সালের ১৩ই মার্চ, ঢাকায়। নিজ গ্রাম বিমলগুহে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত। নীচে পল্লীকবির কবর কবিতাটি তুলে দিলাম: এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছে তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে। এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ, পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।

এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা, সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা! সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি লাঙল লইয়া খেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি। যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত। এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে। বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা "আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ। " শাপলার হাটে তরমুজ বেচি ছ পয়সা করি দেড়ী, পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।

দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে, সন্ধ্যাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে! হেস না-হেস না-শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে, দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে! নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, "এতদিন পরে এলে, পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেদে মরি আঁখিজলে। " আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়, কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝ্‌ঝুম নিরালায়। হাত জোড় করে দোয়া মাঙ্ দাদু, "আয় খোদা! দয়াময়, আমার দাদির তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়। " তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি। শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি, গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।

এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে, গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখে জলে। মাটিরে আমি যে বড় ভালোবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক, আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ। এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা, কাঁদ্‌ছিস্‌ তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না। সেই ফাল্‌গুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি, "বা-জান, আমার শরীর আজিকে কী যে করে থাকি থাকি। " ঘরের মেঝেতে সপ্‌টি বিছায়ে কহিলাম বাছা শোও, সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কি জানিত কেউ? গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে, তুমি যে কহিলা, "বা-জানরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?" তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে, সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে! তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দুহাতে জড়ায়ে ধরি, তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিত সারা দিনমান ভরি।

গাছের পাতারা সেই বেদনায় বুনো পথে যেত ঝরে, ফাল্‌গুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে। পথ দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ, চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক। আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি, হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি। গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা, চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ। উদাসিনী সেই পল্লী-বালার নয়নের জল বুঝি, কবর দেশের আন্ধার ঘরে পথ পেয়েছিল খুঁজি।

তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ, হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বিষের তাজ। মরিবার কলে তোরে কাছে ডেকে কহিল, "বাছারে যাই, বড় ব্যথা র'ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই; দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষ্মী আমার ওরে, কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে। " ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গণ্ড ভিজায়ে নয়ন-জলে, কী জানি আশিস করে গেল তোরে মরণ-ব্যথার ছলে। ক্ষণপরে মোরে ডাকিয়া কহিল--"আমার কবর গায় স্বামীর মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়। " সেই সে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে, পরাণের ব্যথা মরে নাকো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।

জোড়া-মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু-ছায়, গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়। জোনাকি-মেয়েরা সারারাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো, ঝিঁঝিঁরা বাজায় ঘুমের নূপুর কত যেন বেসে ভালো। হাত জোড় করে দোয়া মাঙ্ দাদু, "রহমান খোদা! আয়; ভেস্ত নসিব করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়!" এইখানে তোর বুজির কবর, পরীর মতন মেয়ে, বিয়ে দিয়েছিনু কাজিদের বাড়ি বনিয়াদি ঘর পেয়ে। এত আদরের বুজিরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে, হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে। খবরের পর খবর পাঠাত, "দাদু যেন কাল এসে দুদিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে।

" শ্বশুর তাহার কসাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে, অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে। সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে ফোটে না সেথায় হাসি, কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিছে ভাসি। বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন, কে জানিত হায়, তাহারও পরাণে বাজিবে মরণ-বীণ! কী জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে, এইখানে তারে কবর দিয়েছি দেখে যাও দাদু! ধীরে। ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেহ ভালো, কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো। বনের ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন, পাতায় পাতায় কেঁপে উঠে যেন তারি বেদনার বীণ।

হাত জোড় করে দোয়া মাঙ্ দাদু, "আয় খোদা! দয়াময়। আমার বু-জীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়। " হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু, সাত বছরের মেয়ে, রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে। ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কী জানি ভাবিত সদা, অতটুকু বুকে লুকাইয়া ছিল কে জানিত কত ব্যথা! ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে, তোমার দাদির ছবিখানি মোর হৃদয়ে উঠিত ছেয়ে। বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা, রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।

একদিন গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে, ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে। সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে, কী জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে। আপন হস্তে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি, দাদু! ধর-ধর-বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি। এইখানে এই কবরের পাশে আরও কাছে আয় দাদু, কথা কস নাকো, জাগিয়া উঠিবে ঘুম-ভোলা মোর যাদু। আস্তে আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে, দীনদুনিয়ার ভেস্ত আমার ঘুমায় কিসের ছলে! ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে, অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।

মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর, মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূর। জোড়হাতে দাদু মোনাজাত কর, "আয় খোদা! রহমান। ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত-প্রাণ। " মাটি ও মানুষের কবির আরো জীবনকণিকা জানতে: http://sos-arsenic.net/lovingbengal/visit.html http://www.jasimuddin.org একটি অনুরোধ: কারো একটু সময় হলে এবং পারলে, দয়া করে http://bn.wikipedia.org/wiki/Jasimuddin এই অসম্পূর্ণ নিবন্ধটিতে পল্লীকবির তথ্য যোগ করবেন।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।