আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আফগান অভিনেত্রী বিবি হামিদার গোপন ডায়েরি



আমার জীবন কখনোই সুখের ছিল না। দরিদ্র পরিবারের জন্ম। জন্মের পর থেকেই অভাব-অনটনের মধ্যে বড় হয়েছি। নিজের খাদ্য জোটানোর জন্য অন্যের বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজও করেছি। আমার স্বামী ভ্যানগাড়িতে করে সবজি বিক্রি করতেন।

আজ তিনি বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে আমার বর্তমান তারকাখ্যাতি দেখে তিনিই বেশি খুশি হতেন। এখন আমার বয়স অনেক। প্রায় আশির কাছাকাছি। এ বয়সে এসে অভিনেত্রী হিসেবে আমি আফগানিস্তানে তারকাখ্যাতি পেয়েছি।

আমাকে এখন হয়তো অনেকে চেনেন। অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন। আবার কেউ হয়তো ভাবেন, এই বুড়ো বয়সেও আমি যেসব কাজ করছি (অর্থাৎ অভিনয়) তা বেলেল্লাপনার পর্যায়েই পড়ে। এমনটি ভাবলেও আমার কিছু যায় আসে না। তবে এটা মনে করলে ভুল হবে, নিছক টাকার লোভে আমি অভিনেত্রী হয়েছি।

আবার অভিনেত্রী হিসেবে আমার প্রাপ্য পারিশ্রমিক যখন না পাই তখন নিজেকে ভাগ্যহীনাই মনে হয়। আমাকে আমার ন্যায্য পারিশ্রমিক না দিয়ে কেন প্রতারিত করা হয়- জানি না। তবে আমি এখনও ঋণী সিদ্দিক বারমাকের কাছে। সিদ্দিক বারমাক আফগান চলচ্চিত্র নির্মাতা। পাঁচ ছয় বছর আগে রাজধানী কাবুলের একটি শরণার্থী শিবিরে তিনি আমাকে আবিষ্কার করেন।

তখন তার 'ওসামা' চলচ্চিত্রের একটি চরিত্রের জন্য একজন অভিনেত্রী খুঁজছিলেন। সিদ্দিক বারবাক আমার কাছে এসে জানতে চেয়েছিলেন, আমি অভিনয় করতে আগ্রহী কি-না? পরে বুঝতে পারি ঠাট্টা নয়। তিনি আমাকে প্রথম সুযোগ দেন 'ওসামা' ছবিতে। 'ওসামা' ছবিটি ওসামা বিন লাদেনের ওপর নির্মিত। ওসামাতে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই আমার অভিনয় জীবনের শুরু।

এরপর থেকে আমি চলচ্চিত্র, নাটকসহ ৪০টিরও বেশি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। বেশির ভাগ সিনেমা নাটকে দাদি ও নানির চরিত্রে অভিনয় করেছি। আজ আমাকে আফগানিস্তানে 'বিবি হামিদা' বলে সবাই চেনেন। 'বিবি হমিদা'র নাম-খ্যাতিতে হারিয়ে গেছে আমার পিতৃপ্রদত্ত নাম। আমার আব্বা খুব শখ করে নাম রেখেছিলেন 'হামিদা আলামি'।

কিন্তু এখন চেনেন বিবি হামিদা নামে। বিবি হামিদা হয়েছি। অভিনেত্রী হয়েছি। বিদেশ-বিভুঁইয়ে যাচ্ছি। তার মানে এই নয় যে, আমি অন্য দেশের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মতো বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারছি।

বিশ্বাস করেন, সপ্তাহে আমার আয় মাত্র ১০ ডলার। এই টাকা দিয়ে শহরে বাড়িভাড়া করে থাকা অসম্ভব। আট সান ও ২৪ জন নাতি-নাতনি নিয়ে আমার সংসার। সংসারের কেন্দ্রবিন্দু আমি। এ টাকা দিয়ে নিশ্চয়ই সংসার চলার কথা নয়।

আগে রাজধানী কাবুলের একটা সরকারি পরিত্যক্ত ভবনে থাকতাম। গহযুদ্ধের সময় ওই বাড়িটি ক্ষতি হয়েছিল। তাই পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়েছিল। অথচ ওই পরিত্যক্ত বাড়িতেই আমরা থাকতাম। চতুর্থ তলার এটি মাত্র কক্ষে গাদাগাদি করে থেকেছি।

না ছিল বিদ্যুৎ, না ছিল পানি। তবু থেকেছি। কারণ, আমরা পরিবারের কেউ কারও কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইনি। এখন আগের চেয়ে তুলনামৃলক ভালো আছি। কিন্তু তার মনে এই নয় যে, আমার একটা বাড়ি হয়েছে, গাড়ি হয়েছে কিংবা ব্যাংক ব্যালেন্স আছে।

২০০৭ সালের মে মাসে আফগান সরকার আরও অনেকের সঙ্গে আমাদেরও ওই পরিত্যক্ত ভবন থেকে সরিয়ে কাবুলের কাছেই কারিকো নামক স্থানে জমি বরাদ্দ দিয়েছে। এই জমিতে তাঁবু টাঙিয়ে থকি। এখানে মাইলের পর মাইল ধূ ধূ ভূমি। রাখাল ও তাদের ভেড়ার পালছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। বিদ্যুৎ নেই।

পানি নেই। আশপাশে কোনও স্কুল নেই যে নাতি-নাতনিরা পড়াশুনা করবে। সরকারের প থেকে প্রতিদিন একটি পানির ট্যাংক সমেত গাড়ি আসে। ওই পানির ট্যাংকে যা পানি থাকে তা এই এলাকার ৩২০টি পরিবারের জন্য যথেষ্ট নয়। তবু আমরা পানির অপোয় থাকি- কখন পানির গাড়ি আসবে।

২০০৭ সালের একদিন আমরা দাওয়ায় বসেছিলাম পানির গাড়ির অপোয়। হঠাৎ দেখি একটা অন্যরকম (নতুন মডেলের গাড়ি) দামি গাড়ি আসছে আমাদের বস্তির দিকে। অবাক হই। ভাবি, কী ব্যাপার? সেই গাড়ি থেকে নামেন এক মার্কিন ভদ্রলোক। নাম মার্ক ফরেস্টার।

তিনি আমারই খোঁজ করছিলেন। এগিয়ে যাই। পরিচিত হই। জানতে পারি আফগান বংশোদ্‌ভৃত মার্কিন লেখক খালেদ হোসাইনির 'দ্য কাইট রানার' উপন্যাস অবলম্বনে তিনি সিনেমা বানাবেন। এ সিনেমায় আমাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন।

আমি এক কথায় রাজি। তারপর তিনি আমাকে চীন নিয়ে গিয়েছিলেন। চীনে এ ছবির বেশকিছু শুটিং হয়। এ ছবিটি তৈরি করেছে হলিউডের প্রযোজনা সংস্থা ড্রিম ওয়ার্কস। চীনে যে ক’দিন ছিলাম, ভালো ছিলাম।

ছিলাম যেন মায়ের গর্ভে। আয়েশে ছিলাম। যেন কোনও চিন্তা ছিল না। ভালো খাবার দিয়েছে। যত্ন নিয়েছে।

যে বাথরুম ব্যবহার করতে দিয়েছে তা খুবই সুন্দর। সাবান, শ্যাম্পু, নীল তোয়াল সবই ছিল। সেখানে থাকার সময়ই উপলব্ধি করতে পেরেছি· বড়লোকদের জীবন কত সুন্দর। কত আয়েশের। কত নিরাপদ।

ছবির পরিচালক মার্ক ফরেস্টারকে বলেছি, আমা কত কষ্টে থাকি। একটু ভালো পারিশ্রমিক দিতে। তিনি সে সময় আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন ১০ হাজার ডলার দেবেন। আমি তো এমন প্রস্তাবে স্বপ্ন বুনতে থাকি। এ পরিমাণ টাকা আমার জন্য বিশাল।

আমার জন্য অতিকল্প হলেও শুনেছি হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এ পরিমাণের দশগুণ বিশগুণ টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন। সেখানে আমাকে ১০ হাজার ডলার দেবেন এটা বিশ্বাস করা দোষের কিছু নয়। কিন্তু চীনে শুটিং শেষ হবার পর আফগানিস্তানে ফেরার সময় মার্ট ফরেস্টার আমার হাতে যে টাকা তুলে দিলেন তার পরিমাণ মাত্র ১ হাজার ডলার। আমি তাকে র্পূর্বের প্রতিশ্রুতির কথা শোনাই। তিনি হেসে বলেন, এতেই আপাতত সন্তুষ্ট থাকুন।

পরে দেখা যাবে। ভাবি, আমাকে তারা হয়তো অভিনেত্রী না ভেবে সস্তা শ্রমিক ভেবে থাকতে পারেন। 'দ্য কাইট রানার' মুভিটি যখন মুক্তি পেয়েছে, ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ শীতাতপ নিয়িন্তিত সিনেমা হলে বসে সিনেমাটি দেখেছেন, তখন আমি আফগানিস্তানের পশ্চাদপদ একটি এলাকায় তাঁবু'র নিচে শুয়ে শীতের সঙ্গে লড়াই করছিলাম। একজন অভিনেত্রীর ন্যায্য পারিশ্রমিকটা দিতে নির্মাতাদের এত কার্পণ্য সত্যি আমাকে ভীষণ আহত করে।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।