আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অভিশপ্ত (৮ম পর্ব)



৫. চেয়ারম্যান কাশেম এখন মহা ব্যস্ত। তার দলের আমীর বদরপুর গ্রামে আসবে। রফিক আর মোনায়েম মাষ্টারকে নিয়া তার এখন মাথা ঘামানোর সময় নাই। তবে তিনি খুব বিচলিত ছিলেন। কারণ, মাষ্টার আর রফিক এখন প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে।

রফিক কিছুদিন আত্মগোপন করে ছিল কিন্তু এখন সে প্রকাশ্যে চলে এসেছে। সবচাইতে আশংকার বিষয়টি হচ্ছে মিঠুও তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। নতুন প্রজন্মদের সমর্থন তিনি আস্তে আস্তে হারাচ্ছেন এটা তিনি খুব ভালো ভাবেই অনুভব করছেন। কিন্তু এখন এগুলো নিয়ে ভাবার সময় কম। আমীর সাহেব আজকেই আসবেন।

তাকে অভ্যর্থনা জানানোর সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে। মেইন রাস্তা থেকে স্কুলের ছেলে পেলেরা রাস্তার দুধারে দাড়িয়ে তাকে স্বাগতম জানাবে। বদরপুর স্কুলের হেড-মাষ্টারকে এসব দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আর মাদ্রাসার ছেলেরা গাড়ি থেকে নামার পর ফুলেল সংবর্ধণা দিবেন। দুটা হাতিও আনা হয়েছে।

বদরপুর গ্রাম বলতে গেলে আজ নতুন সাজে সেজেছে। মনে হচ্ছে এক মহা উৎসব হবে এই গ্রামে। চেয়ারম্যানের সাঙ্গপাঙ্গরা কিছুক্ষণ পর পর মোটরসাইকেলের মহড়া দিচ্ছে। দুপুরের দিকে তার দলের আমির মোহাম্মদ মশাররফ বেগ তার বিশাল গাড়ি বহর নিয়ে প্রবেশ করলেন বদরপুর গ্রামে। রাস্তার দুধারে স্কুলের ছেলে-মেয়ে গুলো সেই সকাল থেকে না খেয়ে না দেয়ে দাড়িয়ে আছে।

সাই সাই করে তাদের সামনে দিয়ে ধুলা উড়িয়ে পাচ-ছটা গাড়ী চলে গেলো। তারা অযথা হাত নেড়ে স্বাগতম জানালো। এর মানে ওরা কেউ কিছু বোঝে না। শুধু শুধু পাচ-ছয় মিনিটের জন্য সকাল থেকে দাড়িয়ে থাকার কি মানে! বেগ সাহেবকে প্রথমে নেয়া হয়েছে চেয়ারম্যানের দুইতলা বাড়িটিতে। তিনি বসে আছেন তার ড্রয়িং রুমে।

আশেপাশে দলের সমস্ত আতি পাতি নেতারা ভিড় জমিয়েছে। তিনি খুব গম্ভির স্বরে বললেন, তোমরা এখানে ভীড় করতাছ কেনো? যাও বাইরে যাও। আমি কিছুক্ষণ কাশেম মিয়ার সাথে কথা বলি। কাশেম সাহেব তার খুব আপন লোক। তার সাথে প্রথম পরিচয় একাত্তর এর যুদ্ধে।

বদরপুরগ্রামে ইসলাম রক্ষার কাজে সেই সময়ে এই কাশেম সাহেবই তাকে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনিই বলেছিলেন, হুজুর কোনো চিন্তা করবেন না। আমি থাকতে আমার এলাকায় ইসলাম নষ্ট হইতে দিমু না। আপনে আমাগো পাকি ভাইগোরে বলেন আমার এলাকায় তাদের ক্যাম্প দিতে আমি তাগো সর্ব সহযোগিতা দিমু। সেই কাশেম অনেক চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে এখন এই বদরপুর গ্রামের চেয়ারম্যান।

একাত্তরে সে ইসলাম রক্ষায় সর্বাত্বক সহায়তা করেছেন দেখে আল্লাহ তাঁর উপর সদয় হয়েছেন। না হলে কি আর চেয়াম্যান হতে পারতো! এই গ্রামের মানুষের উপরও আল্লাহর বিশেষ রহমাত আছে। - কি কাশেম মিয়া কেমন আছেন? চেয়ারম্যান এই গ্রামের অনেক বড় কেউ হতে পারেন কিন্তু বেগ সাহেবের কাছে তিনি অতি তুচ্ছ একজন মানুষ। খুব কাচুমুচো করে জবার দিল, জ্বি হুজুর। আপনের দোয়ায় একরকম আছি আর কি।

- বাড়িটা তো সুন্দর বানিয়েছেন। বিরাট বাড়ি। আকর্ষণীয়। এ সবই আল্লাহর তরফ থেকে আপনি পুরুস্কার পাইছেন। বুঝলেন।

- জ্বি হুজুর, সব আল্লাহর মেহেরবাণি। আমীর একটু দাড়ালেন। ড্রয়িং রুমের চারিপাশ তিনি একবার চোখ বুলান। দেয়ালে একটি ছবি টাঙানো। ছবিটি একটি নারীর।

তিনি ছবিটিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেন, ছবিটি কার? - হুজুর, এইটা আমার একমাত্র মেয়ের ছবি। আমীর তাকালেন কাশেমের দিকে; তারপর আবার প্রশ্ন করলেন, আপনার মেয়ে তো শুনছিলাম ইন্তেকাল করেছেন। - জ্বি। আমীরের যেনো একটু ক্ষুব্ধ হলেন, বললেন, এগুলো কি যে করেন আপনারা। একে তো একটা মানুষের ছবি তার উপর একজন নারী.....তার উপর মৃত।

আল্লাহ তওবা তওবা........... - হুজুর। তিনি আমার একমাত্র মেয়ে। তিনাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি। মনে পড়লে তার দিকে কিছুক্ষণ চাইয়া থাকি। তাই ছবিটা ঝুলাইছি।

- না না......মাইয়ার কথা মনে পড়লে আল্লাহর কাছে তার জন্য দোয়া করবেন। ছবি কেন ঝুলাইবেন। যে কোনো মূর্তি কিংবা মানুষের স্থির চিত্র হারাম। গুনাহ। জাহান্নামে আপনেও পুড়বেন।

যারটা ঝুলাইবেন সেও পুড়বে। কাশেম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। জ্বি, হুজুর। আমি সরিয়ে ফেলবো। - তো বলেন, আজকে আমার কি কি করতে হবে।

- একটা মাদ্রাসা দিছি হুজুর। প্রায় ছয় বছর হইয়া গেছে। ঐখানে আপনে একটু পোলাপানের সাথে কথা কইবেন। ওগো কোরআন তেলোয়াত শুনবেন। আর এলাকার লোকজন আসবে তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বইলেন।

কাশেম সাহেবের মাদ্রাসায় গেছেন দলের আমীর বেগ সাহেব। মাদ্রাসা ভরতি ছাত্র। তাদের কোরআন তেলওয়াতের আওয়াজে মুখর পুরো কক্ষটি। এক হাফেজ তাদের পড়ার তদারকি করছেন। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন, কোণায় এক ছেলেকে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয়েছে।

তিনি কাশেম সাহেবকে ডেকে প্রশ্ন করলেন, কি... ঐ ছেলেরে আটকাইয়া রাখছে কেন? কাশেম বলল, হুজুর, পোলাডা বড্ড বদজাত। সুযোগ পাইলেই ঘরে পালায়া যায়। বেগ সাহেব ধীরে ধীরে ছেলেটার কাছে গেলেন। বললেন, এর শিকল খুলে দাও। ছেলেটার শিকল খুলে দেয়া হলো।

সাথে সাথে তার মুখে একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো। বেগ সাহেব তাকে প্রশ্ন করলেন, কি বাবা? আপনে নাকি খালি পালায়া চইলা যান। এইডা কি ঠিক? ছেলেটির মুখ থেকে হাসি তখনও যায় না। সেও বলে ওঠে, না ঠিক না তয় আমার এহানে থাকতে ভালা লাগে না। - কেন ভালো লাগে না? আল্লাহর রাস্তায় আইছেন.....আরো তো শান্তি লাগা উচিত।

- ছেলেটি একটু গম্ভীর হয়ে বলল, আমার এহানে শান্তি লাগে না। আমি স্কুলে যাইতাম। ঐডাই ভালা আছিল। স্কুলে পড়–ম আমি। বেগ সাহেবের মুখ সাথে সাথে গম্ভীর হয়ে যায়।

তিনি কিছুটা ক্ষুব্ধ হন। সাথে সাথে বলেন, এই মাগীর বাচ্চাটারে আবার শিকল দিয়া বানদো। তারপর পাছায় ১০০ বেতের বাড়ি। এমুন বেতের বাড়ি দাও যাতে তার স্কুলে যাওয়ার সখ পাছা দিয়া বাইর হইয়া যায়। সাথে সাথেই ছেলেটিকে আবার শিকল দিয়ে বাধা হলো।

বেগ সাহেবের সামনে মাদ্রাসার হাফেজ সাহেব অনেক আনন্দের সাথে ৮ বছরের বাচ্চাটির পাছায় বেতের আঘাত করতে শুরু করে। ছেলেটি চিৎকার করতে থাকে। তাও সে একবারের জন্যও বলছে না সে এখানে থাকবে। সে শুধু বলছে, আমি এহানে থাকুম না। আমারে মাইরা ফালাইলেও থাকুম না।

তার চিৎকারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। কারণ তখন কোরআন তেলোয়াতের আওয়াজে মুখর সেই কক্ষটি। কিছুক্ষণপর এলাকার লোকজন এসে ভীড় জমিয়েছে মাদ্রার সামনে খালী জায়গায়। সেখানে স্টেইজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবার বসার জন্য চেয়ার দেয়া হয়েছে।

বেগ সাহেব উঠলেন স্টেইজে; সামনে মাইক। দিলেন অতি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ, শ্রদ্ধেয় ভাইয়েরা, আসসালামু আলাইকুম। আমি জানি আল্লাহর অশেষ রহমাতে এই বদরপুর বাসি খুব ভালো আছেন। আমি এখানে আইসা অত্যন্ত আনন্দিত। কারণ আমি দেখলাম এই মাদ্রাসায় প্রায় একশর উপর ছাত্র।

আমি অত্যন্ত খুশী হয়েছি। আমি এও বলতে চাই আপনারা যারা আপনাদের ছেলে পেলেদের মাদ্রাসায় দেন নাই তাদের মাদ্রায় দেন। স্কুল শিক্ষা হলো হইকালের শিক্ষা। মনে রাখবেন, ইহকাল হইলো সাময়িক। এই সাময়িক জীবনে আলতু ফালতু শিক্ষা দিয়া সময় নষ্ট আর পাপী না বানায়া ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন।

তাগো ধর্ম কর্ম পালন করান। এই জাহেলীর যুগে জিহাদ না করলে ইসলাম ধ্বংস হইয়া যাইবো। আমাদের জিহাদ করতে হবে। ধর্ম রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে হইবো। তাই আপনাগো কাছে অনুরোধ আপনারা আপনাদের সন্তানদের আল্লাহর রাস্তায় পড়ান।

আমাগো নামে অনেকে কুপ্রচারণা চালায়। অনেকে বলে, আমরা নাকি যুদ্ধঅপরাধী। মনে রাখবেন, এই দেশ আগে ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তান পাকিস্তান ভাই ভাই। সেই ভাইদের মধ্যে একটু ঝামেলা হইছিল; আমরা চাইছিলাম সেই ঝামেলা মেটাইতে।

কিন্তু আমরা ঝামেলাটা মেটাইতে পারলাম না। এইটা ঠিক। পাকিস্তান ভাইঙ্গা দুই টুকরা হইয়া গেছে। হইলো বাংলাদেশ। যা হোক হইলো।

আমরা মানলাম। কিন্তু কি সব স্বাধীনতার যুদ্ধের নামে অন্য দলগুলো কি সব বইলা বেড়ায়। আপনেরাই বলে, একই ঘরে যুদ্ধ লাগছিল। সেইটা আমাগো গৃহযুদ্ধ। সেই গৃহযুদ্ধরে তারা বানায়া দিলো স্বাধীনতার যুদ্ধ।

এগুলো হইলো চক্রান্ত। সুক্ষ চক্রান্ত আমাদের বিরুদ্ধে। ওরা হইলো হিন্দুগো দালাল। ওরা এই দেশরে হিন্দুস্তান বানাইতে চায়। তবে আমরা দিবো না।

যে কোনো অপশক্তির বিরুদ্ধে আমরা ঝাপাইয়া পড়বো। বলেন, আল্লহু-আকবার.......... পুরো সমাবেশ জুড়ে ধ্বনিত হলো আল্লাহু আকবার.......একবার নয় বার বার। মানুষ তার ভাষনে মুগ্ধ। শুধু মুগ্ধ হতে পারে নি মরীয়ম পাগলী। সবার চিৎকার শেষ হলে সে চিৎকার করে ওঠে, ঐ হারাজাদা.....তোর ভাই আছিল? তোর ভাই তোর মা বোনরে চুইদা গেছে আর তুই কস ঐডা যুদ্ধ আছিল না।

শুয়োরের বাচ্চা, রাজাকার..........তোর ইসলামে কইছে মানুষ মারতে......জিহাদ করতে কইছে মানুষ জবাই কইরা। হারামজাদাগুলা। সবাই একটু বিব্রত হলেন। বেশী বিব্রত হলেন কাশেম সাহেব। তার এলাকায় আমীর সাহেব এসে এভাবে অপমান হবেন এটা তিনি মানতে পারছেন না।

এই পাগলীটার দিকে একটু নজর রাখা উচিত ছিল। রাতের খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। হরেক রকমের খাবার সাজানো হয়েছে বেগ সাহেবের সামনে। তিনি খেতে খেতে প্রশ্ন করলেন, ঐ মহিলাটা কে ছিল? - আরে বাদ দেন। পাগলী কি না কি কয়।

তার তিন ছেলে আর স্বামীরে আমি মাইরা ফালাইছিলাম। মুক্তিবাহিনীর চর দেইখা। পরে সে পাগল হইয়া গেছে। - আপনার ভুল ছিল। আপনে তারেও তহন মারেন নাই কেন।

পরিবারের একজনরে মারছেন আরেকজনরে ছাইরা দিছেন এইডা তো ঠিক হয় নাই। যখন মারবেন সবাইরে মারবেন। কান্দার মানুষ যাতে না থাকে। তারপর তারা আবার খাওয়ায় মনোযোগ দেন। খাওয়া শেষে বেগ সাহেব চলে যাবেন।

আজ রাতেই তাকে ঢাকায় পৌছাতে হবে। কালকে তিনি আমিরিকা যাবেন। তিনি বের হতে হতে কাশেম সাহেবকে বলছেন, কাশেম মিয়া থাকবার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু কি করার। কালকে আমি একটু আমেরিকা যামু।

আমার মাইয়াটারে অনেকদিন দেখি না। - হুজুরের মেয়ে কি ঐ খানে জামাই বাবাজির সাথে থাকে নাকি। - আরে ধুর মিয়া। মাত্র ওর বয়স ২২। সে ঐখানে পড়াশুনা করে।

বি.এস.সি ইন কম্পিউটার সাইন্স। আমার ছোট ছেলেটা এবার এ লেভেল দিলো। তারেও চিন্তা করতাছি আমার মেয়ের কাছে পাঠায়া দিবো। দোয়া কইরেন কাশেম মিয়া। ওরা যাতে মানুষ হয়।

আর শুনেন, আপনার ড্রয়িং রুমে অনেক রাজনৈতিক মানুষ আসে সুতরাং ঐখানে আপনের আমাদের জোটের চেয়াপার্সনের ছবি টাঙানো উচিত। তাইলে ইমেজ বাড়বে। হাইকমান্ডের কানে এই খবর গেলে তারা খুব খুশী হবে। এগুলো বলেই গাড়ীতে উঠে চলে যায় আমীর মোহাম্মদ মোশাররফ বেগ। তারা অন্যকে মাদ্রাসা শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেন কিন্তু নিজের সন্তানকে পাঠায় বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য।

তারা স্থির ছবিকে পাপ বলেন কিন্তু নিজের স্বার্থে ছবি ঠিকই ঝোলান। এগুলো হচ্ছে এ দেশের অবস্থা। দেশের বোকা মানুষকে আরও বোকা বানানোই তাদের কাজ। আমীরকে বিদায় দিয়ে কাশেম চেয়ারম্যান তার ঘরে ঢোকে। মেয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস নেয়।

এই একমাত্র মেয়ে ফাতেমা। বড় আদরের বড় আল্লাদের মেয়ে। জন্মের কিছুদিন পরই মা মারা গিয়েছিল। এরপর থেকে এই মেয়েকে নিজের সঙ্গীর মতো তিনি রেখেছেন। সুখে দুখে মেয়েকে তিনি সাথে রেখেছেন।

অনেক সময় অনেক কষ্ট নিয়ে তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন। ফাতেমা যেনো তার শান্তির একমাত্র জায়গা ছিল। কি সুন্দর তার ডাক ছিল, আব্বাজি...... আহ অন্তরটা পুরাইয়া যাইতো! কি সুন্দর নূরানী চেহারা আছিল। রঙ আছিল অসাধারণ। একদম ধবধবা সাদা না আবার একদম কালো না আবার তাকে শ্যামলাও বলা যায় না।

কেমন যেনো একটা রঙ। হাসিটা কি মিষ্টি আছিল। আহ্...... কাশেমের চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। আম্মাজি......আপনে কি কইরা এই বুড়াটারে একা রাইখা গেলেন। আমি এমন কি করছিলাম।

মাষ্টার মনে মনে পুরনো ম্মৃতি আওড়ান। যুদ্ধের সেই সময়গুলোতে তিনি তখন ৩৫ বছরের এক শক্তিধর ক্ষমতাধর মানুষ। গ্রামের মাতব্বর ছিলেন তিনি। পাকিস্তান বাহিনী তার গ্রামে ঢুকে ভারতীয় দালালদের হত্যা করছে। তিনি সহযোগিতা করতেন।

মাঝে মাঝে তিনিও ভুমিকা পালন করতেন। একদিন ফাতেমা এসে বলল, আব্বাজি, আপনে যে ওগোরে দিয়া মানুষ মারাইতাছেন। এইডা কি ঠিক? তিনি তখন উত্তরে বলেছেন, আম্মাজি, ওরা তো ইসলাম রক্ষা করতে আইছে। আপনেই বলেন কেউ যদি ইসলামের উপর আঘাত করে তাইলে আমাগো তার বিরুদ্ধে থাকা উচিত না? -থাকা তো উচিত। কিন্তু এভাবে মানুষ মাইরা... - আম্মাজি আপনে ঐগুলো নিয়া চিন্তা নিবেন না।

মেয়ের সাথে যুদ্ধের বিষয়ে এই একবারই কথা হয়েছিল। কখনও সে এগুলো নিয়ে কথা বাড়ায়নি। ঝামেলা হয়েছিল গোপালের সুন্নাতে খাতনার দিন। গোপাল চেয়ারম্যানের কিংবা বলা যেতে পারে তৎকালীন কাশেম মাতাব্বরের চাকর ছিল। মাতাব্বর যেখানে যেতো সাথে ছাতি হাতে গোপাল থাকতো।

কাশেমকে সে গুরু বলে ডাকতো। আর ফাতেমাকে ডাকতো বুবু। ফাতেমাও গোপালকে খুব সম্মান করতো। ফাতেমা ডাকতো গোপালদা বলে। সেই গোপালকে জেনারেল দেখে বলে ওঠে, ইস হারামকি জাত ধুতি কিউ পেহনতা হেয়.... ও কেয়া মুসলমান নেহি হ্যায়...... কাশেম একটু বিব্রত হয়ে বলেন, জ্বি নেহি হুজুর.... ও হিন্দু হেয় লেকিন হামহারা আদমি হ্যায়...... জেনারেল একটু গম্ভীর হয়ে বলেন, নেহি.....হিন্দু হামহারা আদমী নেহি হো সাকতা......উসকো হাম মার ডালেঙ্গে।

কাশেম সাথে সাথে তোড় জোড় করে গোপালকে বাচানোর জন্য। কারণ গোপালকে তিনি খুব পছন্দ করেন। এবং গোপাল ছোটকাল থেকেই কাশেমের সাথে থাকে। বলল, নেহি হুজুর, দয়া কিজ্বে....... মেরা খাস আদমি হেয়। - ঠিক হ্যায়.. তো ফির উসকো মুসলমান হোনা পড়েগা।

এরপর গোপালকে তিনি রাজি করান মুসলমান হওয়ার জন্য। বলেন, আরে হারামজাদা, রাজি হ.... নাইলে তোরে মাইরা ফালাইবো...আমি তো তোরে বাচাইতে চাই। তুই রাজি হইয়া যা.... গন্ডগোল শেষ হইলে তুই তোর ধর্ম পালন করিস। গোপাল শেষে রাজি হলো। গোপাল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো জেনারেলের সামনে।

দোয়া দুরুদ পড়ার পর জেলারেল বলল, আব ইয়ে হামআরা খাস মুসলিম ভাই হ্যা। লেকিন ইসকো সুন্নেতা খাতনা করনে পাড়েগা। কাশেম এরপরই ভড়কে যায়। এমনতো কথা ছিল না। হাজম ডাকা হলো তার মুলসমানী করানোর জন্য।

তবে জেনারেল বলল, উসকো হাম মুসলমানী কারেঙ্গে। তিনি একটি খুর নিলেন, কোনো ঔষুধ ব্যবহার করলেন না। গোপালের লুঙ্গি খুলা হলো। পুরুষাঙ্গটিকে জেনারেল ধরলেন শক্ত করে। তারপর পাতলা চামড়াটিকে খুর দিয়ে একটানে কেটে ফেললেন।

গোপালের চিৎকার। যন্ত্রণার আর্তনাদ। সাথে সাথে জবাই করা মুরগীর মতো লাফাতে থাকে গোপাল। কোনো বারই সে বলছে না হে আল্লাহ.....সে বার বার বলছে হে ভগবান... হে ভগবান...... জেনারেল আরও ক্ষুদ্ধ হলেন, তার সদ্য কাটা পুরুষাঙ্গটি বরাবর লাথি লাগিয়ে দিলো। কুত্তে কে অওলাদ।

বল আল্লাহ.. গোপাল লাথি খাওয়ার সাথে সাথে মাটিতে লুটে পড়ে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সারারাত গোপাল কাতরাতে থাকে যন্ত্রণায়। পাশে গোপালের স্ত্রী লক্ষী ও ফাতেমা নিস্তব্ধ হয়ে গোপালের কান্না শুনতে থাকে। কোনো ঔষধ কাজে আসছে না।

বিছানা রক্তে লাল হয়ে গেছে। গোপাল কখনও চিৎকার করছে। কখনও গোঙাচ্ছে। বুবু...ও বুবু.....পাপ.....এ পাপ বুবু.......অভিশাপে সব শেষ হইয়া যাইবো বুবু.......ওহ.....ভগবান বাচা মানুষগুলারে বাচা...... একসময় গোপাল মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। ভোর বেলা আযানের ধ্বনি যখন শুনা যাচ্ছিল তখন গোপালের ব্যাথা কমে আসে।

সে তখন ফাতেমাকে বলে, বুবু, আমার লক্ষীরে বাচাইয়েন। নাইলে ওরেও..... কথাটা আর শেষ করতে পারে নি গোপাল। কেমন যেনো ফেকাশে হয়ে গেলো। দুইবার জোরে জোরে নিশ্বাস নিলো। তারপর সব নিশ্চুপ।

গোপালকে মাটি দেয়া হয়েছে। লক্ষী এর জোর প্রতিবাদ করে। কিন্তু কাশেম বলেছে, গোপাল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে তাই তারে কবর দিতে হইবো। ফাতেমা সব শুনেছে শুধু। কোনো প্রতিবাদ করেনি।

একবার খালি বলেছে, গোপালদারে মাটি দিয়েন না আব্বাজ্বি। কাশেম তখন শুধু শুনে ছিল। আর কিছুই বলে নি। সেইদিন বিকেলেই গোপালের বউ লক্ষীকে কাশেম পাকি বাহিনীর ক্যাম্পে দিয়ে এসেছে। স্বন্ধ্যায় তিনি ঘরে ফেরেন।

কিন্তু এসে ফাতেমাকে আর পান না। সারারাত তিনি পুরো গ্রামে তার একমাত্র মেয়েকে খুজে বেড়িয়েছেন কিন্তু পান নি। সবার ঘরে ঘরে গিয়ে আর্তনাদ করে বলেছেন, আমার মাইটারে পাইতাছি না। তোমরা কেউ ওরে আইনা দাও। গোপাল থাকলে এতক্ষণে খোজ খবর কিছু একটা পাওয়া যেতো কিন্তু গোপালটাও তো নেই।

এক বিভীশিকাময় রাত গিয়েছিল। সকাল হতেই এক পাকি সৈন্য তার বাসায় এসে হাজির হয়। জেনারেল তাকে ক্যাম্পে যেতে বলেছে । - এ্যক লারকি আজ সুইসাইড কিয়া হামহারা ক্যাম্পমে। মাষ্টারের ভাবছে হয়তো গোপালের বউ আত্মহত্যা করেছে।

এক সৈন্য পাশে থেকে বাংলায় বলল, ঐ মেয়েটার হাতে একটা চিঠি পাওয়া গেছে। আপনাকে উদ্দেশ্য করে লিখা। মাষ্টারের বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো। সারা শরীর কাপা শুরু করলো। চিঠিটি তিনি পড়লেন, আব্বাজ্বি, মুসলমান রক্ষার নাম দিয়া যা হইতাছে তা আমি মানতে পারলাম না।

গোপালদার মতো অসহায় একটা মানুষরে ইসলাম রক্ষার নামে মেরে ফেলা আমি মানতে পারলাম না। আপনার কাছে এটা ইসলাম রক্ষা হতে পারে কিন্তু আমার কাছে এগুলো পাপ। আমারে গোপালদা মারা যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, লক্ষী বউদির দিকে খেয়াল রাখতে। কিন্তু আপনে তারে এই পশুগুলার হাতে তুলে দিলেন! আমি তাও মানতে পারলাম না। আমি কোনো পাপীর সন্তান হয়ে থাকতে পারবো না।

আব্বাজ্বি, মরলে গোপাল দা রে কি জবাব দিমু। তাই আমিও সেই শাস্তিই গ্রহণ করলাম যা আপনি লক্ষী বউদিরে দিলেন। সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়ে সব কিছু। ৩৭ বছরেও সেই কান্নার আওয়াজ পরিবর্তীত হয়নি। আজও ঠিক একই রকম কান্না।

অসহায়...........একা..........মেয়ের উলঙ্গ লাশ দেখার ভয়বহতা চোখের সামনে ভেসে ওঠা......কিছুই বদলায় নি। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটে পড়েন অসহায় চেয়ারম্যান আবুল কাশেম। চলবে...... ১ম - ৩য়পর্ব: Click This Link ৪র্থ পর্ব: Click This Link ৫ম পর্ব: Click This Link ৬ষ্ঠ পর্ব: Click This Link ৭ম পর্ব: Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।