আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অতীত গৌরব ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যয়

হেমন্তের মাঝামাঝি সময়। কিন্তু আকাশের আচরণ ফেলে আসা সেই বর্ষার মতো। হুট-হাট বৃষ্টি নামছে। কেউ কাক্কুর ক্যান্টিনে ঢুকছে, কেউবা দৌড়ে কলা ভবনে ঢুকছে। কাক্কুর ক্যান্টিনে ভাজা হচ্ছে গরম গরম সিঙ্গারা ও ছমুচা।

কাক ভেজা হয়ে অনেকে মুখ পুড়িয়ে গরম সিঙ্গারা গিলছে। দৃশ্যটি দক্ষিণ পূর্ব-বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ডিগ্রি শাখার। বেরসিক বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে কাক্কুর ক্যান্টিনে শিক্ষার্থীদের আড্ডা জমলেও খালি পড়ে আছে ক্যাম্পাসের নারকেল তলা ও বাদাম তলা। বৃষ্টি থামায় যারা কাক্কুর ক্যান্টিনে আটকা পড়েছে তারা প্রধান ফটক দিয়ে কলেজে প্রবেশ করে। কলা ভবন পার হতেই কানে এসে লাগল, নূপুর পায়ে রিনিক-ঝিনিক ... গানটি।

গণিত ভবনে গানটি চর্চা করছে কিছু শিক্ষার্থী।

কলেজ সূত্রে জানা যায়, ১৮৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তৎকালীন জমিদার রায় বাহাদুর আনন্দ চন্দ্র রায় কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। সর্বপ্রথম ১৮৮৬ সালে আনন্দ চন্দ্র রায় এন্ট্রাস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর ১৮৮৮ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়া এটি ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে রূপান্তরিত করেন। পরবর্তী ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে তা পূর্ণাঙ্গ কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

১১৩ বছরের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ দেশের স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

প্রতিষ্ঠালগ্নে কলেজটি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠদানের মধ্য দিয়ে ১০৭ জন ছাত্র এবং ৭ জন শিক্ষক নিয়ে যাত্রা করে। ১৯১৮ সালে চালু হয় অনার্স কোর্স। বিএসসি এবং বিকম কোর্স শুরু হয় পর্যায়ক্রমে ১৯৪২ এবং ১৯৫৬ সালে। নৈশকালীন পাঠদান কর্মসূচি চালু হয় ১৯৫৮ সালে।

১৯৬২ সালে কলেজটি উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি শাখায় বিভক্ত হয়। ১৯৭১ সালে ৫টি বিভাগ চালু করা হয়। বাংলা বিভাগ চালু হয় ১৯৭৩ সালে। আইসিএমএ প্রোগ্রাম শুরু হয় ১৯৮২ সালে। ১৯৮৪-৮৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মর্যাদা লাভ করে।

অনার্স এবং উচ্চ মাধ্যমিক শাখা ২৯ একর ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে কলেজটি প্রায় বিশ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। এখানে কর্মরত রয়েছেন ১৫৯ জন শিক্ষক। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সীমিত সংখ্যক আসন নিয়ে অনার্স কোর্স চালু হলেও বর্তমান কোনো কোনো বিভাগে ২৭০ এর অধিক আসনে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি রয়েছে। তারপরও ড্রপ আউট সমস্যা মোকাবিলার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত ২০% অতিরিক্ত ভর্তির সুযোগও রয়েছে কলেজে।

এখানে ২০টি বিষয়ে অনার্স এবং ১৭টি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স রয়েছে। একমাত্র পরিসংখ্যান বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স খোলা হয়নি। অন্যদিকে পাস কোর্সে মানবিক, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিভাগ রয়েছে।

অনার্স কোর্সের বিষয়গুলো হলো হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, গণিত, পরিসংখ্যান, বাংলা, ইংরেজি, সামাজিক বিজ্ঞান, সমাজকল্যাণ, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ইসলাম শিক্ষা, দর্শন, মার্কেটিং ও ফিন্যান্স। কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে এ কলেজ শীর্ষ তালিকার অনেকবার প্রথম স্থান লাভ করে।

একাডেমিক কাজের গতি পরিসর বৃদ্ধি হওয়া এবং কাজের গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২টি শাখায় রূপান্তরিত করা হয়। একটি উচ্চ মাধ্যমিক এবং অপরটি ডিগ্রি শাখা। কুমিল্লা মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত উচ্চ মাধ্যমিক শাখাটি রাণীর দিঘীর পশ্চিমপাড়ে প্রায় ৭ একর জমির উপর দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে ডিগ্রি শাখাটি স্থানান্তর করা হয়েছে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে ধর্মপুর নামক স্থানে। যা ২২ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত।

উচ্চ মাধ্যমিকে রয়েছে কয়েকটি টিনশেড, অধ্যক্ষের চেম্বার, দুটো নতুন ভবন, পরিত্যক্ত ছাত্র সংসদ, মসজিদ, স্মৃতিসৌধ প্রভৃতি। ডিগ্রি শাখায় রয়েছে, কলা ভবন নামে বৃহত্তর ভবন, বাণিজ্য অনুষদ, অর্থনীতি ভবন, বিজ্ঞান ভবন, গণিত ভবন, মোতাহার হোসেন লাইব্রেরি, মসজিদ, শহীদ মিনার ও প্রশাসনিক ভবনসহ বেশ কয়েকটি ভবন।

ডিগ্রি শাখায় দুটি ছাত্রাবাস রয়েছে। ছাত্রদের জন্য কবি নজরুল ইসলাম হল, আসন সংখ্যা ২০০, ছাত্রীদের জন্য নবাব ফয়জুন্নেছা হল, আসন সংখ্যা ৪০০। উচ্চ মাধ্যমিক শাখার জন্য টমছম ব্রিজে নিউ হোস্টেল নামে পরিচিত শেরেবাংলা ও রবীন্দ্রনাথ ছাত্রাবাস রয়েছে, আসন সংখ্যা ২৫০।

এছাড়া দুটি অডিটরিয়াম রয়েছে_ উচ্চ মাধ্যমিক শাখায় একটি, জিয়া অডিটরিয়াম নামে ডিগ্রি শাখায় একটি। ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য ৬টি বাস চলাচল করে।

সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাজের চর্চায় বিএনসিসি (সেনা), বিএনসিসি (বিমান), মুভ রেড ক্রিসেন্ট, বিতর্ক পরিষদ, ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটার ও রোভার স্কাউটস নিয়োজিত রয়েছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩৩৪ জন ছাত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ৩৫ জন ছাত্র প্রাণ বিসর্জন দেন।

খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন_ মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম), লে. কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন (বীর প্রতীক), শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন (বীর উত্তম) ও আবদুল মমিন (বীর প্রতীক)। এ কলেজের অনেক শিক্ষার্থী দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনামের সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক সভাপতি আ হ ম মোস্তফা কামাল, কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার, কুমিল্লা জেলা পরিষদ প্রশাসক ওমর ফারুক, টিভি উপস্থাপক হানিফ সংকেত, প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসা ও বিজ্ঞানী আবদুল জলিল।

কলেজের মোতাহার হোসেন লাইব্রেরি ভবনের সামনে দেখা গেল কিছু শিক্ষার্থীর আড্ডা। সেখানে কথা হয় কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র ওয়ালী উল্লাহ হৃদয়ের সঙ্গে।

হৃদয় জানায়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়ে গৌরব বোধ করছি। কারণ কলেজের রয়েছে গৌরবময় অতীত। এখানে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মানবসেবায় নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন বিভিন্ন গুণীজন। আড্ডার বিষয়ে বলেন, এখানের আড্ডা অনেক প্রাণবন্ত। যেখানে একের সঙ্গে অন্যের চিন্তা শেয়ার করার সুযোগ রয়েছে।

আড্ডায় পড়ার বিষয়, রাজনীতি ওঠে আসছে। সঙ্গে কবিতা ও গান স্থান করে নিয়েছে। হৃদয় আরও জানায়, এখানে সংস্কৃতি চর্চার যে ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার তা আমরা পাচ্ছি না। ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মাহবুবুর রহমান ও প্রাণী বিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র আলাউদ্দিন আজাদ জানায়, ভাঙা সড়ক, ক্যাম্পাসে জলাবদ্ধতা, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব লেগে আছে। এছাড়া অনেকগুলো শৌচাগারের দরজা নেই।

জলাবদ্ধতার কারণে আড্ডার স্থল নারকেল তলা আর বাদাম তলা এখন এতিম অবস্থায় পড়ে আছে!

সমাজকর্ম ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী মারজান আক্তার জানায়, আড্ডা আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমকে আনন্দমুখর করে তুলেছে। এখানে জানার অনেক সুযোগ রয়েছে। সমস্যার বিষয়ে মারজান জানায়, নবাব ফয়জুন্নেছা ছাত্রী হলের নিচতলার টয়লেটের অবস্থা বেহাল। এছাড়া একটু বৃষ্টিতে ছাত্রী হল জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। নানা সমস্যার মাঝেও শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে শোনা গেল, অতীতের গৌরবকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যয়।

ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ড.একে এম আছাদুজ্জামান বলেন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের রয়েছে গৌরব উজ্জ্বল অধ্যায়। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনসহ দেশের ক্রান্তিকালে এ কলেজের বহু অবদান রয়েছে। এছাড়া প্রতিবছর উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি শাখার ফলাফলে এ কলেজের শিক্ষার্থীরা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করছে। সফলতার ধারা অব্যাহত রাখতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। তিনি কলেজের ডিগ্রি শাখার সামনের সড়ক এবং কলেজ ক্যাম্পাসে জলাবদ্ধতার বিষয়ে বলেন, সড়কের বেহাল দশার বিষয়ে স্থানীয় এমপি মহোদয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে।

তিনি সড়ক সংস্কারের বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন। জলাবদ্ধতার বিষয়ে ঊধর্্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সামগ্রিক সংস্কার করা না গেলেও আপাতত ক্যাম্পাসে উঁচু পথ তৈরির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

*মহিউদ্দিন মোল্লা, কুমিল্লা

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।