আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরবাসে মৃত্যু

রাজা

আবারো এয়ারবেইজের গপ্পো পরবাসে মৃত্যু সবার জন্য বেদনাদায়ক, মৃতের সব কলিগের, পরিচিত জনের জন্য আর দেশের পরিবার পরিজনের কথা আর কি বলবো। আচমকা মৃত্যু সংবাদ শোনা, মৃত দেহর জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করা, বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি এটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। একমাত্র ভুক্তভোগিরাই জানে। চাকুরীর সুবাদে আমার বিদেশ থেকে কয়েকটি মৃতদেহ মৃতের দেশে পাঠানো অভিজ্ঞতা হয়েছে। মোটেই সুখকর কোন অভিজ্ঞতা নয়।

তার থেকে একটি আজকে শেয়ার করার ইচ্ছা হইলো। একদিন রাতে কোম্পানীর এক বাংলাদেশী মারা গেল। কুমিল্লার লোক, বেশ অনেকদিন ধরে ( প্রায় ৯ বছরের মতো) কোম্পানীতে কাজ করে, কোন ছেলে পুলে হয় নাই, বাবা মা জীবিত আছে। সকালে অফিসে যাওয়ার সাথে সাথে ডিউটি ম্যানেজারে কাছ থেকে খবর পেলাম বসের "প্লিজ হ্যান্ডেল" কমেন্ট সহ। অন্য সব কাজ বাদ দিয়া এই কাজটা শুরু করে দিলাম উদ্দেশ্য ছিল যত তাড়াতাড়ি মৃতদেহ দেশে পাঠানো ব্যবস্থা করা যায়।

লাইফসাপোর্ট এর ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ করলাম উনি বললেন ক্যাম্পে চলে আসতে। গেলাম ক্যাম্পে গিয়ে দেখি তার সব রুমমেটরা চলে গেছে ডিউটিতে শুধুএকজন ছাড়া। মৃত দেহ নিয়ে একা বসে আছে। দেশের মৃতবাড়ীর ছবি ভেসে উঠলো সেখানে কত লোকজন আসা যাওয়া করে । মনটা খারাপ হলো দেশে থাকলে কি এই রকম হতো? যাই হোক পুলিশে খবর দেওয়া হলো।

এলো পুলিশ, এসে তার রুমমেট এর কাছ থেকে স্টেটমেন্ট নিলো এবং এম্বুলেন্স খবর দিল। এবং এম্বুলেন্স করে লাশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো । এইখানে লাশের সুরতহাল হবে। পুলিশ কে জিজ্ঞাসা করলাম আপনারা রিপোর্ট কবে দিবেন। তারা বললো তার অন্যান্য রুমমেট এবং ডাক্তারের রিপোর্ট পেলেই তারা তাদের রিপোর্ট দিবে।

আবার গিয়ে হাসপাতালে রিসিপশনে জিজ্ঞাসা করলাম রিপোর্ট কখন দিবেন আর লাশ কোথায় থাকবে। সে বললো পোষ্টমর্টেমের রিপোর্ট আপনি দুইদিন পরে পাবেন আর লাশ মর্গেই থাকবে। আমি ঠিক বলে অফিসে এলাম। আমি এম্বেসীতে একটা চিঠি লিখলাম মৃতের নামধাম পাসপোর্ট নম্বর জানিয়ে এবং করনীয় কি তার দিক নির্দেশনা চেয়ে। দুই দিন যায় উত্তর দেয় না অথচ পরে অন্য দেশের লোকের ক্ষেত্রে দেখেছি ৬ঘন্টার মধ্যে উত্তর আসতে।

অগত্যা ফোন করলাম বাংলাদেশ এম্বেসীতে । ধরলো একজন তাকে বললাম ভাই একজন লোক মারা গেছে তার মৃতদেহ দেশে পাঠানো জন্য কার সাথে কথা বলবো? কতক্ষন পর একজন লাইনে এলো তাকে বললাম কি কি করতে হবে। তিনি একটা লিষ্ট দিল এইসব পেলেই এম্বেসী ক্লিয়ারেন্স দিবে। ১) ডেথ সার্টিফিকেট ২) পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ৩) ইনসুরেন্স ক্লিয়ারেন্স ৪) মৃতের সমস্ত জিনিস পত্রের তালিকা ৫)কোম্পানী পেমেন্ট স্লিপ (কোম্পানীর কাছে সমস্ত পাওনা পরিশোধের কাগজপত্র) ৬) লাশের পরিবারের লাশ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য একটা এপ্লিকেশন এবং উত্তরাধিকারীর কাগজ পত্র (উত্তরাধিকারী কে তা চিহ্নিত করে চেয়ারম্যান / নোটারী পাবলিক এর সার্টিফিকেট ) আমি তাকে বললাম যে আমি দুইদিন আগে এম্বেসীতে চিঠি দিয়েছি আপনি পাননি । তিনি বাংলাদেশ টাইপে বললেন আমি ছুটিতে ছিলাম।

আমি যথারীতি কাজ শুরু করলাম। তার আরও দুই রুমমেট কে পুলিশ ষ্টেশনে পাঠিয়ে দিলাম স্টেটমেন্ট দিয়ে আসার জন্য। ডেথ সার্টিফিকেট ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দুই তিন দিনের মধ্যে পাবে। লাইফসাপোর্ট এ ফোন করে বললাম মৃতের সব জিনিস পত্রের তালিকা সহ সব প‌্যাক করে রাখতে। এর যোগাযোগ করতে চেষ্টা করলাম তার রিক্রুটিং এজেন্ট এর সাথে সমস্যা হলো সেই রিক্রুটিং এজেন্সী আর অবশিষ্ট নেই তারা বহু আগেই ব্যবস্যা বন্ধ করে দিয়েছে।

অগ্যতা কল করলাম তার বাড়ীতে জানালাম মৃত্যু সংবাদ এবং আপনারা এখন কি চান লাশ কি দেশে নিয়ে যাবেন না এইখানেই কবর দিবেন, লাশ এইখানেও কবর দেওয়া যায়। তারা বললো না আমরা লাশ দেশে নিয়া আসতে চাই । আমি বললাম তাইলে একটা এপ্লিকশন লিখে এবং মৃতের উত্তরাধিকারী কে সনাক্ত করে ( চেয়ারম্যান এর সার্টিফিকেট) কাগজপত্র এখানে পাঠিয়ে দিন। (একটা কথা আমি আগে মনে করতাম যদি ছেলে মেয়ে না থাকে তাহলে বউ হবে স্বামীর উত্তরাধিকারী কিন্তু আসলে যদি বাবা বেচে থাকে তহলে বাবা হবে উত্তরাধিকারী) বিকেল বেলায় হাতে পেলাম মৃতের সব জিনিস পত্রের তালিকা। দুইদিন পড় পেলাম ডেট সার্টিফিকেট।

এখন পুলিশের ক্লিয়ারেন্স দরকার। একদিন যায় দুইদিন যায় ক্লিয়ারেন্স হয় না। লাশ এই দিকে মর্গ পড়ে আছে। তিন দিন পড় পাওয়া গেল বাংলাদেশ থেকে কাগজ পত্র। এদিকে (এক সপ্তাহের মধ্যে মনে হয়) ইন্সুরেন্স ক্লিয়ারেন্স এর জন্য আবেদন করা হলো কোম্পনীর যা পাওনা আছে তা ইন্সুরেন্স প্রদান করে একটা চেক দিয়ে দিলো।

অপেক্ষা ২ মাস পর মিললো পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। প্রতিটি পর্বের সাথে অনেকগুলো কাগজপত্র জমা দিতে হয়েছে বিস্তারিত লিখতে গেলে বড় হয়ে যাবে। সব কাগজ পত্র একসাথে করে চিঠি দেওয়া হলো এম্বেসীতে । কোন খবর নাই, দিন যায়... এম্বেসী উত্তর দেয় না। দুই তিন দফা চিঠি রিফ্যাক্স করা হলো ।

অবশেষে পেলাম এম্বেসীর ক্লিয়ারেন্স। ততদিনে ৯০ দিন পার হয়ে গেছে । দুইদিন পর কার্গোতে করে লাশ বাংলাদেশে পাঠানো হলো। আরেক দিন হয়তো মৃত্যু নিয়ে অন্য দেশের অভিজ্ঞতা বলবো তখন পার্থক্যটা ধরা পড়বে সুন্দর ভাবে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।