আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মধ্যাহ্ন

© ২০০৬ - ২০১১ ত্রিভুজ

সেদিন তাড়াহুরা করে সার্ভার রুম থেকে ফিরছিলাম। রুমে ফিরে দেখি ব্লু-টুথ কার্ডটা ব্যাগে নেই। যদিও নেটে কানেক্ট করে বেশীর ভাগ সময়ই নেট ব্যবহার না করে প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে থাকি, কিন্তু নেট না থাকলে কেমন যেন অসহায় লাগে। অনেকটা মোবাইল ভুলে ফেলে আসলে যেমনটা লাগে...। এই অবস্থায় কোন কাজও করা হয় না.. অনেক সময় নেট ডাউন থাকলে বসে বসে গেম খেলি বা বই পড়ি.. অথবা লেখালেখি করি।

তো সেদিন কি করা যায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো আগের রাতে হুমায়ূন আহমেদের 'মধ্যাহৃ ' ডাউনলোড করেছিলাম। বসে গেলাম পড়তে.... 'মধ্যাহ্ন' আমার দেখা হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম একটি বই সন্দেহ নেই। বেশ কিছুদিন পর সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদ তাঁর অসাধারণ লেখনির পরিচয় দিলেন... দুই খন্ডের বই। ব্যাস্ততার কারণে পুরোটা এখনো শেষ করা হয়নি। ১৯০৫ সালের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস।

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর চমৎকার লেখনীতে বিভিন্ন উল্লেখ যোগ্য ঘটনা তুলে ধরছেন... কিশোর নজরুলের হোটেলে রুটি বানাতে বানাতে গান লেখা থেকে শুরু করে বঙ্গভঙ্গে হিন্দুদের ভূমিকা পর্যন্ত অনেক ঘটনা তুলে ধরেছেন। ভাল লাগলো যে আমাদের এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে হিন্দুদের বিরোধীতার ঘটনাকে অনেক গোঁয়ার গবিন্দের মত চোখ কান বন্ধ করে অস্বীকার করেননি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধীদের আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথা কোন এক বিচিত্র কারণে এড়িয়ে গিয়েছেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে যে রাখি বন্ধনের প্রচলন করা হয়েছিলো সেটার বিষয়েও দেয়া তথ্যটা নিয়ে একটু সন্দেহ আছে.. (রাখি বিষয়ক তথ্যটার বিষয়ে অবশ্য আমি নিজেও নিশ্চিত নই.. তাই এটা নিয়ে আপাতত আর কিছু বলা গেল না)। ভাল লেগেছে তৎকালীন মুসলিম সমাজের উপরে হিন্দু সমাজের নির্মম অত্যাচারের কিছু কিছু চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন দেখে।

হিন্দুরা মুসলমানদের খুব নিকৃষ্ট মনে করতো তখনকার সময়ে। মুসলমানরা তাদের দৃষ্টিতে ছিলো 'অস্পৃশ্য'। আমার মা'য়ের মুখে এধরনের বেশ কিছু গল্প শুনেছিলাম। যেমন কোন ঘাট হতে হিন্দুরা কলসি ভরে পানি নিয়ে যাচ্ছে.. কোন মুসলমান যদি ভুলেও ঐ পানির কোথাও স্পর্শ করতো তাহলে তারা সব পানি ফেলে দিয়ে নতুন করে পানি ভরে নিতো। বই থেকে একটা লাইন কোট করি- "তিনি এক মুসলমান কাঠমিস্ত্রির ছেলে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন- এ দৃশ্য হাস্যকর।

যবনপুত্র অস্পৃশ্য হওয়ার কথা। ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। শূদ্রের নিচে যবনের অবস্থান। " উপন্যাসের এক চরিত্র 'হরিচরণ'। এটা ছিল মুসলিম কাঠমিস্ত্রির ছেলে 'জহির'কে কোলে নেয়ার বিষয়ক ভাবনাটা।

মুসলিম কাঠমিস্ত্রির ছেলের জীবন বাঁচানো এবং নিজের ঘরে প্রবেশ করানোর অপরাধে হরিচরণকে সমাজচ্যুত করা হয়েছিলো। বিধান মতে যবনপুত্রকে কোলে নেয়া এবং তাকে ঘরে নেয়া নিষিদ্ধ। ধর্ম থেকে পতিত হওয়ার মতত অপরাধ। ধর্ম থেকে যে পতিত তার স্থান রসাতলে। পাতালের সাত স্তরের ষষ্ঠ তল হচ্ছে রসাতল।

এই তলে যে পতিত, তার গতি নাই। এগুলো যদি তাদের বিধানে লেখা থেকে থাকে তাহলে বিষয়টা নিয়ে আমার ভাবাবার অবকাশ রয়েছে। আমার বেশ কিছু হিন্দু বন্ধু রয়েছে। তাদের বাড়ি গিয়ে আমি খেয়েছি তারাও আমার বাড়ি এসে খেয়ে গিয়েছে। বিধান মতে তাদের জাত যাওয়ার কথা।

তাদের পুরো পরিবারকেই সমাজচ্যুত করার কথা... তেমনটি হতে শুনিনি। এর কারণ কি হতে পারে যে তারা বিধান মানে না বা মানার উপায় নেই!? ভারতের হিন্দৃ অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে কি হিন্দুরা এগুলো এখনো মানে? তাহলে সেখানের মুসলমানদেরও কি সেই ১৯০৫ সালের মত পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে? তৎকালীন মুসলিম সমাজের কিছু অন্ধত্বও বেশ চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে এখানে একটা বিষয়ে খুব সরলীকরণ করে ফেলেছেন। কিছু সুবিধাবাদী মুসলিম চরিত্র যারা না বুঝে দাসীদের সাথে অবৈধ সম্পর্ককে সঠিক মনে করে উলটা-পালটা কাজ কর্ম করে বেড়াতো তাদের রেফারেন্স দিয়ে পুরো বিষয়টা মুসলিম সমাজের উপরে চাপিয়ে দিয়েছেন। এধরনের সরলীকরণ দু:খজনক! তবে কিছু অন্ধত্ব (যা এখন অনেকটা কেটে গিয়েছে বলেই ধারণা করি) খুব ভয়াভয় ছিলো।

ওগুলো ছিলো মূলত ধর্ম সম্পর্কে কম জানার ফল। মুসলিম সমাজের নামে এপর্যন্ত যত অপবাদ এসেছে তার বেশীর ভাগই এইসবআধা ধার্মিকদের কারণে হয়েছে। আমাদের মুসলমানদেরই উচিত এসব আধাধার্মিকদের সঠিক ধর্ম শিক্ষা দিয়ে এদের অন্ধত্ব দূর করা। তবে একটা বিষয় সত্যি খারাপ লেগেছে। যেমন লেখক তার উপন্যাসে ইসলাম বিষয়ে বেশ কিছু ভুল বিষয় উপস্থাপণ করেছেন।

তার ভেতরে একটি এরকম যে, তৎকালীন সময়ে মসজিদের ইমাম'রা ঢোল বাদ্য নিয়ে নিত্য করলে মানুষ কিছু মনে করতো না। কারণ হিসেবে বলেছেন তখনকার মুসলমানরা উগ্র ছিলো না.. তাই এগুলো সমস্যা সৃষ্টি করেনি। তার মানে আমাদের এখন উগ্রতা ছেড়ে মসজিদের ঈমামদের ঢোল-বাদ্য নিয়ে রাস্তায় নাচতে পাঠানো উচিত!!?!! উপন্যাসে 'ধনু শেখ' নামে নাম মাত্র মুসলিম এক ধূর্ত চরিত্র রয়েছে যার একটা ধূর্তামির শিকার হয়ে 'অম্বিকা ভট্টাচার্য' নামের এক হিন্দু ঠাকুর কে গো-মাংস ভক্ষন করতে হয়েছিলো। সাধারন বিধান মতে এটা মহাপাত। তবুও বিধানের ফাঁক ফোকর গলে ঠাকুরকে রক্ষার চেষ্টা করা হলো, কিন্তু কাজ হলো না।

সমাজচ্যুত হয়ে ঠাকুর পরিবার অবশেষে মুসলিম হওয়ার সিন্ধান্ত নিলেন। অনিচ্ছাস্বত্বেও হিন্দু ধর্মের একজন সম্মানীত ঠাকুরকে এভাবে মুসলিম বানানো আমার কাছে খারাপ লেগেছে। তবে সেই ঠাকুর পরিবারের নিশ্চয় আরো বেশী খারাপ লেগেছে। যদিও অম্বিকা ভট্টাচার্যের প্রতি এই আচরণ করার পেছনে ধনু শেখের কিছু মটিভ রয়েছে। উপন্যাসের চরিত্র হরিচরণ ছিলো ধনু শেখের প্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব।

এই হরিচরণকে সমাজচ্যুত করার বিষয়টি নিয়ে হরিচরণ একদা জাত বিষয়ক কিছু প্রশ্ন তুলেছিলো যা হিন্দু সমাজের অপছন্দের কারণ হওয়া ধনু শেখের চাকুরী চলে যায় এবং গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে পথে নামতে হয়। হরিচরণকে সমাজচ্যুত করার পেছনে অম্বিকা ভট্টাচার্যের বিশেষ ভূমিকা থাকার কারণেই ধনু শেখ এই হঠকারিতার আশ্রয় নিয়েছিলো। একধরনের প্রতিশোধ বলা যায়। এ উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের মত অম্বিকা ভট্টাচার্যও শুধু উপন্যাসের একটি চরিত্র নয়। 'অম্বিকা ভট্টাচার্য' একজন বাস্তবের মানুষ।

তাঁর পরিবারের সদস্যরা এখনো আমাদের দেশে বাস করছে। 'ধনু শেখের' হঠকারিতায় মুসলিমদের উপর এই পরিবারের আজন্ম আক্রোশ থাকার কথা। আমার মনে হয় তেমনটিই রয়েছে... অম্বিকা ভট্টাচার্যের এক বংশধর আমাদের দেশে বেশ পরিচিত একটি ফ্যামিলি। সেই ফ্যামিলির এক সদস্য যদি চরম মুসলিম বিদ্বেষী হয়, তাহলে সম্ভবত এরজন্য তাঁকে খুব বেশী দোষ দেয়া যায় না... (চলবে)


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।