আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্রমশ সংকোচিত হওয়া

তোমার অস্তিত্বে সন্দিহান, তবু্ও সদাই তোমায় খুঁজি

ঈদটা আগে দাদা বাড়িতেই করা হত। দাদার সাথে ঈদের নামাজ পড়তে ঈদগাহে যেতাম। বিশাল ঈদগাহ। বহু দূরের গ্রাম থেকে মানুষ আসত। দাদা সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন, বুকে জড়িয়ে ধরতেন।

অবাক হয়ে ভাবতাম, দাদা এতো মানুষ চিনেন কি করে! দাদা মারা গিয়েছেন বছর খানেক হল, দাদী তারও আগে। একটু বড় হওয়ার পর তাঁদের সাথে আর ঈদ করা হয়নি। গত পনের বছর এই শহরের বদ্ধগলিতেই ঈদের নামাজ পড়ছি। এখানে ঈদগাহ নেই। ছোট্ট কুঠোরির মত মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ি।

আগতদের বেশিরভাগকেই চিনি না। এখানেই নিকট প্রতিবেশীটির সাথে বছরে পথমবারের মত (শেষবারের মতোও) দেখা হয়। মুখে কষ্টের হাসি এনে তাঁকে স্বাগত জানাই, কুশল জিজ্ঞাসা করি। নামাজ শেষে প্রথা মাফিক অনেকের সাথে বুক মিলাই। বলাবাহুল্য, এই মিলানোটা শুধুই প্রথা, শুধুই বাহ্যিক।

বার্ষিক পরীক্ষাটা ছিল রোজার মতই কষ্টকর। ঠিক তেমনি পরীক্ষা পরবর্তী সময়টা ছিল ঈদের মতই আনন্দের। এই আনন্দের প্রধান কারণ ছিল ছুটির এই সময়টাতেই নানাবাড়িতে যেতাম। শুধু আমি একা নই, আমার অন্যান্য খালাত ভাইবোনেরাও খালাদের সাথে আসত। আমার নানা ছিল বয়সে তাঁর ভাইদের চেয়ে অনেক বড়।

সেকারণে নিজের মামারা বয়সে অনেক বড় হলেও চাচাত মামাদের অনেকেই আমার সমবয়স্ক ছিল। সম্পর্কটা ছিল তুই, তুক্কারি টাইপের। খালাত ভাই আর মামাদের সাথে সারাদিন মিলে ঘুরে বেড়াতাম, পুকুরে সাতার কাটতাম। দুপুরে খাওয়ার কথা প্রায়ই ভুলে যেতাম। বিকেলবেলা বিশাল প্রান্তরে দাড়িয়াবান্ধা, ঘোল্লাছুট, ফুটবল খেলতাম।

ক্রিকেটের প্রচলন তখনও তেমনটা ঘটেনি। রাত্রে খেতে খেতে নানার মুখ হতে রামায়ন আর কারবালার বিয়োগান্তক কাহিনীগুলো শুনতাম। গল্পগুলো বহুবার শুনেছি। তারপরেও নানা যখন বলতেন মনে হত এই প্রথমবারের মত শুনছি। স্থানের অভাবে খালাতো ভাইয়েরা গড়াগড়ি করে একই চকিতে চার পাঁচজন ঘুমাতাম।

তবুও কারো কোন অভিযোগ ছিল না। নানা মারা গিয়েছেন বছর চারেক হল। তাঁর জানাজায় অংশগ্রহণের জন্য শেষবার নানাবাড়িতে গিয়েছিলাম। আর হয়ত কোনদিনও যাওয়া হবে না। শূন্য ভিটায় কার কাছেইবা যাব! মামারা সবাই এখন শহরের বাসিন্দা।

নানী এই শহরেই এক মামার বাড়িতে থাকেন। মামারা এখন পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রী করার প্রতিযোগীতায় ব্যস্ত। বেচতে বেচতে হয়ত নানার ভিটাটাও একদিন শেষ করে ফেলবে। তারপরেও হতাশ হইনা, কষ্ট পাইনা। কারণ এটা ভেবে স্বস্তি পাই যে, আমার অন্তত একটা নানার বাড়ি ছিল।

নানার আদর পেয়েছি, অনেক স্মৃতি পেয়েছি। কিন্তু আমার সন্তানেরাতো এর কিছুই পাবে না। সেও হয়ত নানার বাড়িতে যাবে। তবে বিশাল কোন উম্মুক্ত ময়দান পাবে না, সঙ্গীও পাবে না। ছোট্ট খুঠুরীতে বসে তাঁর নানাও হয়ত তাঁকে গল্প বলবে।

তবে সেটা কারবালার কাহিনী হবে না। ডলারের বিপরীতে টাকার কেন পড়ে যাচ্ছে গম্ভীর মুখে তার কারণ ব্যাখ্যা করবেন। ফাল্গুনের শুরু থেকেই শহরের আকাশটা রংঙিন ঘুড়িতে ভরে যেত। আমি কখনও ঘুড়ি উড়াইনি, উড়াতে পারতামও না। তবে আমার এক খালাত ভাই ছিল এ কাজে সিদ্ধহস্ত।

এই সময়টাতে আমি তার পিছন পিছন ঘুরতাম। সুতাতে মাঞ্জা দেওয়া, রঙিন করা, ঘুড়ি কেনা প্রতিটা কাজেই আমি তাঁর সাগরেদ হিসেবে কাজ করেছি। ফলশ্রুতিতে মা, খালার অনেক বকাও খেয়েছি। খালাত ভাই দেশ ছেড়েছে দশ বছর হল। মাঝে মাঝে দেশে আসলেও আমার সাথে দেখা হয় না।

তেমনি দেখা হয় না এই শহরের আকাশের ঘুড়িগুলোর সাথেও। এই শহরের আকাশ এখন সম্পূর্ণ ঘুড়িমুক্ত। নতুন প্রজন্ম এখন মায়েদের একান্ত বাধ্য। বইয়ের পাতা ছাড়া তাঁরা কিছু বুঝে না। শবে বরাতের রাতে পুরো আকাশটা তারা বাতি , মরিচাবাতিতে ভরে যেত।

বলাবাহুল্য, এগুলো সবই ছিল নিজেদের তৈরি (Home Made)। শবে বরাতের অনেক আগে থেকেই এর জন্য প্রস্তুতি নিতে হত। আমার খালাত ভাই এ কাজেও ছিল পটু। যথারীতিআমি ছিলাম তাঁর সাগরেদ। এখন আর শবেবরাতে মরিচা বাতি, তাঁরা বাতি দেখিনা।

ব্যাপক প্রচার, সচেতনতা ও জাগরণের মাধ্যমে আমরা মহিমান্বিত রাতটির মর্যাদা রক্ষা করতে আমরা পুরোপুরি সফল হয়েছি। আমাদের সন্তানেরা এখন আর কেউ হৈ-হুল্লোর করেনা, মরিচা বাতি জ্বালায় না। তাঁরা আশাতীত সুবোধ হয়ে গেছে। পনের বছর আগে যখন বাবার হাত ধরে পুরনো নিবাস ছেড়ে এখানে এসেছিলাম তখন এ স্থান ছিল বিশাল পৃথিবীর মতোই এক উম্মুক্ত জায়গা। সে আমাকে আপন করেছিল অপার মমতায়।

তখন এখানে ধানক্ষেত ছিল, ক্যানেল ছিল, হিন্দু বাড়িগুলোতে পুকুরও ছিল। একটা শ্মশানও ছিল যেখানে মৃত হিন্দুদের দাহ করা হত। বছর দশেক পরে হঠাৎ একদিন দেখলাম শক্তিমান ও দানবীর এম.পি মহোদয় কলেজের মাঠ বানানোর কথা বলে এই শ্মশানটি দখল করে নিয়েছেন। তারপরে একদিন দেখলাম সেই মাঠ দোকান, গ্যারেজ, বাশের আড়ত হয়ে গেছে। ধানক্ষেতগুলো ধীরে ধীরে বিশালকায় অট্টলিকাতে পরিনত হল।

ক্যানেল, পকুর, আর হিন্দুবাড়িগুলো শক্তিমান ও দানবীর এমপি ও তার সহযোগীরা করায়ত্ত্ব করেছেন বিভিন্ন সেবামূলক কাজ সম্পাদনের মহৎ উদ্দেশ্যে। শক্তিমান, দানবীর এম.পি মহোদয় এখন কারাগারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। জনগণের জন্য কাজ করলে একটু, আধটু ওখানে যেতেই হয়। তবে আশা করা যায় খুব শীঘ্রই জনতার ভালবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি পুনরায় আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন।

আবার মহৎ কাজের উদ্দেশ্যে পুরণো কর্মকান্ড শুরু করে দেবেন। ক্যানেল, পুকুর, আর হিন্দুবাড়িগুলোতো আগেই দখল করে নিয়েছেন। এবার হয়ত পরম ভালবাসা দিয়ে আমাদের এই নশ্বর দেহটাকে দখল করে নিবেন। হাড় আর পাজরগুলোকে একাকার করে একান্তই নিজের করে নিবেন। এভাবে বারবার ক্রমশ দলিত, সংকোচিত, ক্ষুদ্র হওয়া অবশ্য কাছের নতুন কিছু না।

এটা কষ্ট বা অপমানেরও কিছু না। অনাদিকাল কাল হতেই বংশানুক্রমে আমরা ও আমাদের পুর্ব পুরুষরা বিশেষ পারদর্শীতার সাথে এই সংকোচন প্রকিয়াটিকে শুধু রপ্তই করেনি যথার্থ যোগ্যতার সাথে প্রয়োগও করেছি। আশা করি, আমাদের সন্তানেরা এ কাজে আরও পারদর্শী হবে, নতুন কলাকৌশল প্রয়োগ করবে। ঈশ্বর তাদের সহায় হোন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।