আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হৃদরোগ, পুলিশ এবং নন্দিত নরক -১



গতবছর কোরবানির ঈদের একদিন পর হঠাৎ ভোররাতে বুকে তীব্র ব্যথা। কোরবানি ঈদ মানেই আমার জীবনের একটা বিশেষ ঘটনা। সেই ছেলেবেলায় ঠিক কুরবানি ঈদের আগের দিন আমার নানু মারা যান। অনেক দিন আগের কথা। তখন এতোসব প্রাইভেট ক্লিনিক ফ্লিনিক ছিলনা।

তিনি ভর্তি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সেইসময় ডাক্তারদের ধর্মঘট চলছিল। আমার নানু জীবনে প্রথমবারের মত ঢাকায় এসেছেন, তাও এম্বুলেন্সে করে। ঢাকার ব্যাপারে তার তীব্র রকমের উচ্চ ধারণা । আমরা ছোটবেলায় দুষ্টমি করলে, তিনি বলতেন, তোরা না ঢাকায় থাকোস? মানে যারা ঢাকায় থাকে, তারা খুব ভদ্র হয়, শিক্ষিত হয়, এই ছিল তার বিশ্বাস।

কাজেই অসুস্থ হবার পর, মোটামুটি খুব নিশ্চিত মনেই তিনি ঢাকা এসেছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বড় বড় বিল্ডিং দেখেও তিনি মুগ্ধ। তার মুগ্ধতায় প্রথম ফাটল ধরলো , যখন তিনি দেখলেন, ডাক্তাররা তার চিকিৎসা করছে না, তাদের কী যেন একটা দাবী ছিল, সরকারের কাছে। সেই দাবী পূরণ না হওয়ায় তারা ধর্মঘট করছে। ডাক্তারদের এই অভিমানে আমার নানী নিশ্চিত কষ্ট পেয়েছিলেন, তার ক্ষমতা থাকলে তিনি অবশ্যই তাদের দাবী পূরণ করে দিতেন।

হাসপাতালে একদিন রাতে খাওয়ার সময়, হঠাৎ তার ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ার ইচ্ছা হল। তিনি আমার মাকে বললেন, কালকে অবশ্যই ডাল ভাত নিয়ে আসবি। এটাই ছিল তার শেষতম ইচ্ছা। ঐ রাত্রেই তার তীব্র শ্বাস কষ্ট শুরু হল, ঐ গভীর রাতে তার পাশে আমার এক খালু ছাড়া আর কেউ ছিল না। একজন সহৃদয় আয়া অবশ্য এগিয়ে এসেছিলেন।

তিনি আমার হতবুদ্ধি খালুকে পরামর্শ দিলেন আত্নীয়স্বজনকে দ্রুত খবর দিতে। ওটা মোবাইল ফোনের যুগ নয়। ল্যান্ড ফোনও মোটামুটি বেশ দুর্লভ। পাড়ায় একজনের থাকলে, সেটাই ছিল যথেষ্ট। গোটা পাড়ার লোকেদের যাবতীয় জরুরী সংবাদের একমাত্র অবলম্বন ঐ ফোন।

ঐসব ফোনওয়ালা পরিবারের পাড়ার বাড়তি কদর ছিল। আমাদেরও ফোন ছিল না, তবে আমাদের পাড়ার একজনের ছিল। ভাগ্যক্রমে তাদের বাসাটা আমার পাশেই থাকায় খবরটা -বলা চলে- খুব তাড়াতাড়িই পাওয়া গিয়েছিল । দিশেহারা খালু ঐ পাড়ার ফোনে খবর দিয়ে নানুর বেডে এসে দেখেন, তার পরনের শাড়িটা নেই, তার বদলে হাসপাতালের শাদা বেডশিট দিয়ে শরীরটা ঢাকা। ঐ উপকারী আয়াটা নানুকে খুব সম্ভবত: ঢাকা সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ও চূড়ান্ত ধারণা দেবার জন্য শাড়িটা নিয়ে কেটে পড়েছে।

আরেকবার কোরবানির ঈদের দিন পেটে তীব্র ব্যাথা শুরু হল। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সামনে মেডিকেল , ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা। এই জটিল সময়ে পেট ব্যাথা মোটেও কাজের কথা নয়। তারপর ঈদের দিন।

সবাই আমার উপরে খুব বিরক্ত, আমি নিজেও । সন্ধ্যার পর পেট ব্যাথা খুব মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে ( নাকি পেটচাড়া দিয়ে উঠলে) তড়িঘড়ি হলিফ্যামিলি গমন। চৌধুরী হাবিবুর রহমান, খুব নামকরা সার্জন। তিনি হাসপাতালের বিশেষ অনুরোধে ঈদের পাঞ্জাবি ( হাতার দিকে সামান্য মাংসের ঝোল লাগা ) পড়েই আমাকে দেখতে চলে এলেন। সাথে সাথেই কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করা হল।

অ্যাপেনডিক্স। পরদিন ভোরেই অপারেশন। অপারেশন শেষ করে ওটির সামনে দাঁড়ানো আমার উদ্বিগ্ন বাবাকে ডাক্তার বলেছিলেন , আরেকটু দেরী হলেই .... বাকী টুকু আর বলেন নি। খুব সম্ভবত: তিনি বলতে চেয়েছিলেন, আরেকটু দেরী হলেই, এই ছেলে আর ব্লগে লেখার সুযোগ পেত না। কাজেই এবারও যখন কোরবানি ঈদের পরদিন মাঝরাতে বুক ব্যাথা হল, আমি মোটামুটি বড় ধরণের একটা ঝামেলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্ততি নিয়ে ফেললাম।

বাসার কাছেই হার্ট ফাউন্ডেশন, সেখানে গেলাম। ডাক্তাররা আমার বয়স থেকে ধরে নিলেন গ্যাসট্রিকের সমস্যা। আমিও একটু স্বস্তি পেলাম, যাক বাবা বাঁচা গেল .. তবুও যেহেতু এটা একটা হার্টের হাসপাতাল এবং ব্যাথাটাও বুকের বাম দিকে, তারা ইসিজি করালেন। এবং ঐটি করে তাদের মুখ কালো হয়ে গেল। ইসিজি ঠিক আছে, কেবল হার্টরেট ভীষণ কম।

মাত্র ৫১। স্বাভাবিকটা বোধহয় ৭০-৮০। তারা আরও এক গাদা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দিলেন। কোন পরীক্ষা খালি পেটে করতে হবে, কোন পরীক্ষা ঠেসে খেয়ে করতে হবে, কোন পরীক্ষার জন্য জামাকাপড় খুলে ফেলতে হবে- বিতং যন্ত্রণা। এইসব যন্ত্রণা পার করতে গিয়ে মনে হল, কেবল হার্ট না, চোখেও আমি ঝাপসা দেখা শুরু করেছি।

এর পরের কাহিনী একটু সংক্ষেপ করি। এই হার্টের কাহিনী নিয়ে আমার মতো দরিদ্র মানুষও কলকাতায় ছুটলাম। ঐখানে আরও বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা করলো, তবে অসম্ভব যত্নে এবং কোন প্রকার মৃদুতম হয়রানি ছাড়া। ওখানে গিয়ে আমার হার্টবিট পাওয়া গেল আরও কম, ৪৭। ( যে মেয়েটা ইসিজি করাচ্ছিল, তাকে দেখেই কি হার্টবিট আরও কমে গেল? আর ঐ হাসপাতালের মেয়েগুলি এতো সুন্দর যে আমার সাথে এক বন্ধু গিয়েছিল, যার হার্ট পুরা সুস্থ , তার বুকেও চিন চিন ব্যাথা করছিল।

) । যাই হোক, ওখানকার ডাক্তাররা বুকে পেস মেকার লাগানোর ইঙ্গিত দিলেন। অন্যান্য পরীক্ষায়ও বেশ খানিকটা সমস্যা পাওয়া গেল। তারা আরও একটা হাইপ্রোফাইল পরীক্ষা করতে চাইলেন। সেটা করতে গেলে আরও বেশ কয়েকটা দিন কলকাতায় থাকতে হবে।

অফিসের ছুটি আর পকেটের টাকা দুটোই প্রায় শেষের দিকে। কাজেই এক মাসের একটা ডেট নিয়ে ধুমসে কিংফিশার খেয়ে আর দুই মেয়ের জন্য কেনাকাটার মধ্য দিয়ে বাকী টাকা শেষ করে দেশে ফিরলাম। ( চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.