আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চুম্বন - পত্রিকার পাতা থেকে থেকে ঢাকার রাস্তায়

পরে

১৯৯১-৯২ এর দিকে সাপ্তাহিক 'খবরের কাগজ' বেরুতো। 'খবরের কাগজ'-এ দুই বাংলার তাবৎ বুদ্ধিজীবী কলাম লিখতেন। আমি তখন ক্লাস থ্রি-ফোরের ছাত্র। আমার বাবা নিয়মিত 'খবরের কাগজ' রাখতেন। অকালপক্ক্ব আমি সে কলামগুলো গলাধঃকরণ করতাম।

অনেক কিছুই অবশ্য হজম হতো না। তো, এদেশের কোনো এক ইন্টেলেচুয়াল 'খবরের কাগজ'-এ একবার একটা কলাম লিখেছিলেন। সেটার কথা আমার এখনো মনে আছে। কলামটা ছিল একটি কাপল'কে নিয়ে। লেখক সাহেব একদিন ঢাকার রাস্তায় বেবিট্যাক্সি করে যাচ্ছিলেন।

তার সামনের আরেকটি ট্যাক্সিতে সেই কাপল বসে ছিল। ভীষণ জ্যাম। হঠাৎ করে জ্যাম ছাড়ল। কাপলদের ট্যক্সির পেছন পেছন লেখকের ট্যাক্সি। কাপলরা হঠাৎ ঘনিষ্ঠ হওয়া শুরু করল।

এক পর্যায়ে শুরু করল চুমু খাওয়া। লেখকের মতো আশপাশের সব যাত্রীই নাকি ভীষণ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলেন। কোনো এক দৈব কারণে পুরো রাস্তা লেখকের ট্যাক্সিটি সেই কাপলদের ট্যাক্সির পেছন পেছনই গেছিল এবং লেখককে এই 'বিব্রতকর' দৃশ্যটি হজম করতে হয়েছিল। এরপর কলামের শেষদিকে লেখক সামাজিক মুল্যবোধ এবং তার অবক্ষয় সংক্রান্ত বুদ্ধিজীবীয় খোলোশে ঢুকে গিয়েছিলেন। সেটুকু আমার আর পড়া হয়নি।

এই কলাম পড়ে আমি হাজারো প্রশ্নের উত্তর খুঁযে পাচ্ছিলাম না। পরে, ৯৪-৯৫ এর দিকে, বাংলাদেশ টেলিভিশন দিনে দুই দুই চার ঘণ্টা করে সিএন এন আর বিবিসির প্রোগ্রাম দেখাতো। সেসব প্রোগ্রাম নিয়ে মা-খালাদের ফিসফাস শুনেছি। সিএনএন-এ হঠাৎ হঠাৎ ইউরোপ আমেরিকার রাস্তাঘাট দেখায়, সেখানে ছেলে মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনকে চুমু খায়। এ নিয়েই এত ফিসফাস।

চুমু খাওয়ার ব্যাপারটা আমি চাক্ষুষ প্রথম ওখানেই দেখি। তবে এ নিয়ে এত ফিসফাসের কী আছে বুঝে উঠতে পারিনি। আমদের মফস্বল শহর রংপুরে ছেলে আর মেয়ে হাত ধরাধরি করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে - এ দৃশ্য সম্ভব ছিল না। অমুক মেয়েকে আজ কারমাইকেল কলেজের সামনে অমুক ছেলের সঙ্গে এক রিকশায় দেখা গেছে - এ নিয়ে খালাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতে শুনেছি। চুম্বন নিশ্চয়ই সে মফস্বলে মহাবিপর্যয় ঘটাতো।

এর পরে, অনেক পরে, মৈত্রয়ী দেবীর 'ন হন্যতে' ততদিনে আমার পড়া, সে সুত্রে 'ফ্রেঞ্চ কিস' নিয়েও যথেষ্ট শিক্ষিত হয়ে গেছি, শুনেছিলাম যে রংপুরের উদ্যানগুলোয় 'লাভার'-রা কিস করে। কোনোদিন নিজে গিয়ে 'যাচাই' করার সৌভাগ্য অবশ্য হয় নি! সময় এগোচ্ছিল। প্রেমিকরাও এগোচ্ছিলো প্রেমিকাদের দিকে। এর মধ্যে ঢাকায় চলে এসেছি। এখানে এসে দেখি রিকশায় ঘন হয়ে বসা কাপলদের।

ফার্স্ট কি সেকেন্ড ইয়ার তখন। সন্ধ্যায় বুয়েটের সামনের রাস্তায় বন্ধুদের সঙ্গে উদ্দেশ্যহীন হাঁটাচলা করি। হুডতোলা রিকশা দেখলেই তা অনুসরণ করে আমাদের কৌতুহলী চোখ। হঠাৎ হঠাৎ কোনো বন্ধু বলে ওঠে, দেখ দেখ কী করে...! আস্তে আস্তে আমার মফস্বলে চোখ শহুরে হয়ে ওঠে। টিএসসির সামনে দিয়ে রিকশা করে যাবার সময় দুপাশের ফুটপাথে আর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি না।

হুডতোলা রিকশার কৌতুহলও কমে আসতে থাকে। কিন্তু প্রেমিকরা প্রেমিকাদের চুম্বন করেই যয়। রিকশায়, উদ্যানের ছায়ায়, সোডিয়াম আলোর নিচে, হঠাৎ অন্ধকারে। আমাদের সবার চোখই কি আসলে সয়ে যায়? দুজন ফ্রেঞ্চ তরুণ-তরুণীকে প্যারিসের রাস্তায় চুম্বনরত দেখলে আমরা খুব সহজেই পাশ কাটিয়ে যেতে পারি। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় হুডতোলা ছেলেমেয়েদের দিকে আমরা দ্বিতীয়বার তাকাই কেন? ভালোবাসার মধ্যে শরীর থাকবেই।

কিন্তু রাস্তায়, গলিতে মেয়েটার মুখ টেনে ধরে ছেলেটা যখন চুমু খায় - ব্যাপারটা শিল্পিত লাগে না কেন? বাধাটা কি ঐতিহ্যে? আমাদের সংস্কৃতিতে? আমাদের রক্তে? একটা সময় রাস্তায় কেউ চুমু খেলে তা নিয়ে পত্রিকায় কলাম লেখা হয়ে যেতো। খুব বেশিদিন মনে হয় লাগবে না, কাপলদের যখন আর কষ্ট করে রিকশার হুড তুলতে হবে না!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।