আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"ইতিহাসের সবথেকে ভয়াবহ গনহত্যাগুলোর একটি মানবজাতির সামনে আসেনি এই সেদিনওঃ ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষের কবর ইন্দোনেশিয়া।"

যা বিশ্বাস করি না, তা লিখতে-বলতে চাই না, পারবোও না। কিন্তু যা বিশ্বাস করি, তা মুখ চেপে ধরলেও বলবো, কলম কেড়ে নিলেও লিখবো, মারলেও বলবো, কাটলেও বলবো, রক্তাক্ত করলেও বলবো। আমার রক্ত বরং ঝরিয়েই দাও, ওদের প্রতিটি বিন্দুর চিৎকার আরও প্রবল শূনতে পাবে। ইন্দোনেশিয়া, সাল ১৯৬৫-১৯৬৬: অন্তত, ত্রিশ লক্ষ মানুষ রাতারাতি মেরে ফেলা এবং তার পরে লাশ ও হত্যার ঘটনা লুকিয়ে ফেলা, কতটা অসম্ভব? একুশ শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ "লুকায়িত" হত্যাকান্ডের একটির কথা বলছি। তখন বিশ্বযুদ্ধের সময়, ব্রিটিশরা বেকায়দা অবস্থা দেখে সটকে পরে, নিরাপত্তাহীন রেখে যায় শাসনাধীন ইন্দোনেশিয়া সহ উক্ত অঞ্চল।

সেই সুযোগে ইন্দোনেশিয়া তথা তত্কালীন মালায়, সাবাহ, সারওয়াক সহ এই সংযুক্ত "রাজ্য" গুলোর দখল নেয় কমুনিস্টরা। তারা অত্যাচার করত ও যেকোনো ভাবে ক্ষমতা ও কর্তিত্ব নিজেদের হাতে নিতে চাইছিল, সেই ভয়, সমীহ বা সমর্থন, যাই হোক বেশ অনেক মানুষ এর জীবন এতে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তিতে PKI তথা সেই কমুনিস্ট দলের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে সমস্ত ইন্দোনেশিয়া থেকে মিশন করে কমুনিস্টদের খুঁজে বের করে চালানো হয় ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাকান্ডগুলোর একটি। এবং অতি সুকৌশলে কয়েক দশক এর জন্যে হত্যাকান্ডের রহস্য রেখে দেয়া হয় গোপন। এখন, হত্যাকারীরা সামনে এসে পড়ছে, তারা মিডিয়ার সামনে কথা বলেছে এই বিষয়ে।

ভয়ে, লোভে অনেক স্থানীয় মানুষ যুক্ত হয় কমুনিস্টদের সাথে। হত্যাকান্ডের সমর্থনে '৬৫ এর ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট থাকলেও পরিচালনা করে সামরিক বাহিনী ও বেশ কিছু তরুণ ইন্দোনেশিয়ান। এটি ইন্দোনেশিয়ার সবথেকে স্পর্শকাতর ইতিহাস যা আলোর মুখ দেখছে বেশি দিন হয়নি। কমুনিস্টরা ছিল অনাকাংখিত ও অত্যাচারী, ক্ষমতা দখলে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় ওরা এবং প্রশাসনের বড় বড় ব্যক্তিরা ছিল টার্গেট। কমুনিস্টদের সাথে হাত মিলিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে সাধারণ মানুষ এর একটি অংশ "হত্যাকারীতে" পরিনত হয়।

একসময় এই অত্যাচার তাদেরকে বিদ্রোহের দিকে ঠেলে দেয় এবং পাইকারী খুন করা হয় কমুনিস্টদের। "The Act of Killing" নামের ডকুমেনটরিতে যতটা বিস্তারিত বর্ণনার সাথে খুনিরা তাদের অপরাধের বর্ণনা দিয়েছে, এত বিস্তারিত আগে কখনই মিডিয়ার সামনে কোনো গণ-হত্যাযজ্ঞ নিয়ে বলা হয়নি। খুনিরা, এই ক্ষেত্রে সবসময় নিজেদেরকে "বীরের" মর্যাদা দিয়েছে। কারণ তত্কালীন সরকার ও মানুষ জন বিষয়টিকে সমর্থন করেছে। এই গণ হত্যার মোটিভ ছিল খুব সিম্পল, "কমুনিস্টদের সমর্থন কর এবং মরো।

" সর্বত্র ছড়িয়ে থাকত গোয়েন্দা, সাধারণ মানুষও সরকারের চর ছিল, খুব সহজেই খবর পৌঁছে যেত, কারা কমুনিস্টদের পক্ষে রয়েছে। সেটাকে আন্দোলন হিসেবে গণনা করা হত, ও "আন্দোলন খতম করে দেওয়া হত। " খুনি আনোয়ার কঙ্গো ও Cover of the movie The Act of Killing. এলেমেন্টারি স্কুলে প্রতিবছর ৩০ সেপ্টেম্বর তিনঘন্টার একটি ফিল্মে দেখানো হয় কি করে কমুনিস্টদের দ্বারা সেনাবাহিনীর সাত প্রধান ব্যক্তিকে মধ্যরাতের ভেতরে স্ত্রী সন্তানের সামনে খুন করা হয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রনের জন্যে। এবং অন্য অনেক মানুষদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ও ঠান্ডা মাথার নৃসংশ খুন এর শিকার হতে হয়। অভিযুক্ত কমুনিস্টদের উপরে এটি ছিল একটি প্রতিশোধমূলক সহিংস আন্দোলন বা গৃহযুদ্ধ।

বিষয়টি সহিংসমূলক ও বাচ্চাদের উপযোগী না হওয়া সত্তেও সরকার কর্তৃক দেখানো হয়, যাতে তাদের মধ্যে ঘৃনা স্থায়ী হয় এবং ভবিষ্যত বিষয়ে তারা সচেতন হতে পরে। কিন্তু এভাবে লক্ষ মানুষের হত্যার যে নগ্ন ইতিহাস সামনে এসেছে তা সরকারকেও টালমাটাল করে দিয়েছে। হাজার হাজার পরিবার তাদের নিখোঁজ সদস্যটির শেষ ঠিকানা জানতে পারল চার দশক পরে! অনেক পরিবার নিশ্চিন্হ হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। জানা যায়নি ঠিক কতটি স্থানে এমনভাবে মানুষ মেরে রাখা হয়েছে, তবে প্রায় নিশ্চিতভাবেই প্রতিটি গ্রামে একটি করে এমন গণকবর রয়েছে। সবথেকে বড়টি পাওয়া গেছে সম্প্রতি, যেটি চল্লিশ মিটার গভীর একটি গুহা এবং মানব দেহে ঠাসা! সারা দেশের ছড়িয়ে আছে এমন KILLING FIELD যেখানে কমুনিস্টদের মেরে পুঁতে রাখা হয়েছে।

সবথেকে বড় কিলিং ফিল্ডগুলো, গর্তটি এখন পর্যন্ত পাওয়া সবথেকে বড় গনকবর, প্রায় চল্লিশ মিটার গভীর স্তুপকৃত লাশ। ডকুমেনটরি পরিচালক এর নিজের কথাটি ছিল এমন, "আমি যখন এমন দেখি ও জানতে পারি, আমি ছিলাম শকড, বিভ্রান্ত ও এমন মনে হচ্ছিল যেন আমি প্রচন্ড ধোঁকার মধ্যে রয়েছি। আমি জানিনা খুনি/জল্লাদ, যাদের সাথে আমি কথা বলেছি, কি বলব তাদের বিষয়ে। জানিনা কি বলব একজন আনোয়ার কঙ্গোর বিষয়ে, যে কিনা হাজার খুনের কাজটি নিজ হাতে করেছে। তবু আমি এমন মানুষদের ক্ষমা করতে পেরেছি, কারণ আমি দেখেছি কতটা মেনুপুলেট্যাড্ ও কতটা ব্রেন ওয়াশড ছিল এই মানুষগুলোর চিন্তাভাবনা।

তদুপরি, তারা ছিল শিক্ষার আলোহীন মানুষজন। " বৃদ্ধ ও জনৈক খুনি আনোয়ার কঙ্গোর প্রশ্নের জবাবগুলো, "কখনো ওদের বয়স ছিল ৫০, কখনো ২২, আমাদেরকে শুধু গণনায় নিতে হয়েছে কে বিরোধিতা করছে..... আমি নিজ হাতে প্রায় ৬০০ মানুষের গলা কেটেছি। দিনে দশ থেকে পঞ্চাশ জনকে পর্যন্ত হত্যা করেছি আমি। এটি আমার কাছে খুবই সাধারণ ছিল। আমি তলোয়ার দিয়েম কখনো বন্দুক দিয়ে মেরেছি।

আর্মি আমাকে লিস্ট দিত, বেশিরভাগ আমার এলাকার লোকজনের, আমি খুন করতাম ও লাশ লুকিয়ে ফেলতাম। আমি তাদের জন্যে মোটেও দুখ অনুভব করিনি, তখনকার অবস্থা আমি দেখেছিই, কমুনিস্টরা ছিল ভয়াবহ। এবং আমি সুখী অনুভব করি, সবাই আমাকে ভয় পায়, সমীহ করে। আমি মৃত ব্যক্তিদের চোখে ভয় দেখেছি, আমি গর্ব করি এই জন্যে। যেই তলোয়ার দিয়ে ওদের মস্তক বিচ্চিনের কাজ করতাম, এখনো সবসময় সাথে রাখি সেটি, গর্বের সাথে।

" ভিডিওতে খুনিদের অনেকেই আসে, ACT OF KILLING মুভিতে। তারা দেখায় কিভাবে ধারালো রশি পেচিয়ে টান দিয়ে মস্তক বিচ্ছিন করে মেরে ফেলা হতো। অথবা টেবিল বা চেয়ারের উপরে রেখে জল্লাদেরা কিভাবে মস্তক বিচ্ছিন করে হত্যা করত। একেকজনের হিসেব করা হাজারের অধিক খুনের রেকর্ড রয়েছে! একজন ইন্দোনেশিয়ান এর মুখেই শুনুন, "আমরা অনেক সমৃদ্ধ একটি সংস্কৃতি সম্পন্ন জাতি, আমাদের আদি অনেক পুরাতন, শেকড় অনেক গভীর। কিন্তু আমি শিউরে উঠি যখন ভেতরে এতবড় কলংকের কথা জানতে পারি! মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয়না, মনে হয় এমন কোনো কালো অতীত আসলে ছিলনা।

" একজন তরুণী বলছেন, "আমরা সত্যি এখনো জানিনা আসলে কত জনকে এভাবে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয়েছে, অনেক বিশাল গুহাতে তাদের ঢিল দিয়ে ফেলা হয়েছে, এমন দুর্গম গুহা যেখানে আজও পৌছানো অনেক কঠিন। আমরা নতুন নতুন শরীর এর অংশ পাচ্ছি, ত্রিশ লক্ষের বেশি ছাড়া কম নয়, কারণ আমরা সেই সংখ্যা আক্ষরিক অর্থেই পেরিয়ে গেছি। " সেই সময়ের একজন বলছেন, "আমি একজন ইন্দোনেশিয়ান হিসেবে বেড়ে উঠি যার রাষ্ট্রপতি ছিলেন সুহার্থ (Suharto) এবং 'New Order' এর শাসন আমলে। আমাকে শেখানো হয়েছিল, Indonesian Communist Party (PKI), যেটি কিনা ১৯৬৫ সালে এখানে সবথেকে বড় রাজনৈতিক দল ছিল, তারা আগ্রাসী ও তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করত না। বিষয়টি এতই মাথার মধ্যে ঢুকে পড়েছিলো, যে যখন ছোট ছিলাম, কাউকে ঘৃনা করলে তাকে কমুনিস্ট বলে ডাকতাম! এতটাই ব্রেইন ওয়াশ হয়ে পড়েছিলাম ওদেরকে নিয়ে।

" এখনও অনেক এমন কিলিং ফিল্ড উন্মোচিত হচ্ছে যা আগে মানুষ ধারনাও করত না। হয় পরিবার সহ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে অথবা তারা টু শব্দ করেনি কম্যুনিস্ট লেবেল লেগে যাবে এই ভয়ে। ২০০০ সালে ধীরে ধীরে বিষয়গুলো সামনে আসতে শুরু করে। কিন্তু তখনও ধারণা করা যায়নি যে এটি আসলে কত বিশাল! হত্যাকারি কম্যুনিস্টদের গনহত্যার যে লোমহর্ষক নজির ইন্দনেশিয়াতে স্থাপিত হয়েছে, কোন শব্দে এর ভয়াবহতা তুলে ধরা সম্ভব নয়। কে ন্যায় করেছে কে অন্যায়, প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া খুবই কঠিন এখানে।

কারন কম্যুনিস্টরা দেশের ক্ষতি করছিল, কিন্তু যেভাবে পাইকারি হত্যা করা হয়েছে, তা আসলেই ভয়াবহ। খুনিরা কথা বলতে শুরু করলে অ দেখিয়ে দিতে থাকলে আস্তে আস্তে উন্মোচিত হয় ইদানীং কালের সবথেকে ভয়াবহ সাইলেন্ট হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি। ___________________________________________________ তথ্য সূত্রঃ মুভিঃ The Act of Killing, ডকুমেন্টরি, উক্ত বিষয়ে লেখা ব্লগ, উইকিপিডিয়া, সাক্ষাতকার, Bloody and hidden: Indonesia এবং আরও কিছু লেখার প্রতি কৃতজ্ঞতা। ছবিসূত্রঃ ইন্টারনেট।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।