আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিউম্যান ট্রাফিকিং ০৪



আমাদের দারিদ্র এবং আমাদের অসহায়ত্বের গল্পগুলো জুড়ে জুড়ে এক একটা মানুষ সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে অন্য কোনো দেশে গিয়ে স্বেচ্ছায় দাসত্ব শৃঙ্খল পড়ছে গলায়। মানুষ পাচারের প্রধান প্রধান কারণগুলো পূর্বেই বলা হয়ে গেছে- সস্তায় শ্রম কিনে নেওয়া- একজন মানুষ যে জেনে শুনে কিংবা প্রতারিত হয়ে অন্য কোনো দেশের মাটিতে পৌঁছেছে তাকে শোষণ করা সহজ। তার পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে তাকে মেরে ফেললেও আসলে কেউ কিছু বলতে আসবে না। মেক্সিকো- আমেরিকা সীমান্তে কিছু মানুষ সারা রাত রাইফেল হাতে পাহাড়া দেয়। সেখানের এক সীমান্তবর্তী নদী ডিঙিয়ে মেক্সিকোর দরিদ্র মানুষেরা আমেরিকা ভূখন্ডে প্রবেশ করে- তবে আইন পালনে এরা খুব সচেতন, একবার কেউ যদি এখানে আমেরিকার সীমান্তের কাঁটা তার ডিঙিয়ে ভেতরে চলে আসে তাহলে তাকে হত্যা করার উপায় নেই, তাই নদীর মাঝখানেই এইসব ভাগ্যান্বেষী মানুষদের পাখির মতো মেরে ফেলা হয়।

নদী দিয়ে লাশ ভেসে চলে যায় একটা স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে। আমাদের শ্রমিক কিংবা আমাদের যুবকেরাও একই ভাবে বিভিন্ন সীমান্ত পেরুতে চায়। ভারতের সীমান্তে নিয়মিত বিএসএফ এর গুলিতে মানুষ মরে, সীমান্তে বিডিআর শিশু আর মেয়েদের চালান আটক করে, ঢাকার হোটেলে মেয়ে শিশুর চালান আটক হয়, তবে এসবের বাইরেও ভ্রমন ভিসায় বিভিন্ন দেশে গিয়ে স্বচ্ছলতা কেনার নেশায় মরিয়া যুবকদের হারিয়ে যাওয়ার হার কমে না। ইতালি, স্পেন, লিথুনিয়া, মরোক্কো, কেনিয়া, উরুগুয়ে, লাটভিয়া, মালোয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশের উদ্যমী যুবকেরা কোথায় না ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ছুটে যাচ্ছে। এদের কতজন বৈধ বাগজ পেয়ে যাচ্ছে, আদম ব্যাপারী এদের প্রতারিত করতে পারছে কারণ এরা যেকোনো মূল্যেই প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাংলাদেশের সীমান্ত ডিঙিয়ে পালাতে চায়।

আমাদের দেশের বৈধ শ্রমিকেরা ঠিক একই কারণে বঞ্চিত হয়। আমাদের আন্তর্জাতিক সুনাম , আমাদের দেশ থেকে অধিকাংশ মানুষই অবৈধ ভাবে অন্য দেশে প্রবেশ করতে মরিয়া। আমাদের সাথে এইসব উন্নত দেশের অভিবাসন কর্মকর্তাদের অবজ্ঞা আর হেনেস্থার শিকার হচ্ছে সবুজ পাসপোর্টেধারী মানুষেরা কারণ ভাগ্যান্বেষনে মরিয়া আমাদের যুবকেরা। তারে যেকোনো উপায়েই সেখানে বসতি গড়তে তৎপর। আমার আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে এইসব যুবকেরা উন্নত দেশে গিয়া যেকোনো কাজ করতে আগ্রহী, ঘন্টা হিসেবে শ্রম বিকোতে আগ্রহী হলেও এইসব যুবকেরা দেশের মাটিতে একই কাজ করতে তেমন আগ্রহী না।

অবশ্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও বিবেচনা করতে হবে, এখানে অর্থনীতি মোটামুটি স্থবির, অনেক দিন ধরেই বেসরকারীকরণের ভুত, ব্যবসা সঙ্কোচন আর মূদ্রাপাচারের লোভে নতুন চাকুরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না তেমনভাবে। আমাদের ২০ হাজার লোকের জীবিকা ধবংস করে ১০০০ মানুষেরা চাকুরির সুযোগ উন্মুক্ত হয়, পাট কল বন্ধ হয়ে যায়, এক সাথে কয়েক হাজার পরিবার পথে বসে, এবং এইসব শ্রমিককে আত্তীকরণের কোনো উদ্যোগ থাকে না সরকারের, সরকার বেসরকারীকরণ করেন নিজের দায়মুক্তির আনন্দে উন্নয়নের গল্প শোনায় আমাদের। এইসব শ্রমিকেরা কি করবে, কোথায় নিজের শ্রম বিক্রী করবে এই বিষয়ে আদতে কোনো মাথা ব্যাথা নেই, অনেক কল কারখানা গ্যাসের অভাবে বন্ধ পড়ে আছে। অনেক বিনিয়োগকারী কল কারখানা তৈরি করে বসে আছে, এ গুলো শুরু হলেও কিছু মানুষ এখানে শ্রম বিক্রি করতে পারতো। সমন্বিত কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।

তাই এইসব যুবকেরা ,যারা চুরি করতে পারে না, যারা ডাকাতি করতে পারে না, কোনো ছলচাতুরি করতে পারে না, তারা ছলনার শিকার হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে শ্রমের চাহিদা কমে নি, যদিও বিভিন্ন প্রযুক্তিসংস্থা বিকল্প শ্রমিক হিসেবে যন্ত্রচালিত উৎপাদন যন্ত্রে বিনিয়োগ করছে, কৃত্রিম কিংবা যান্ত্রিক শ্রমিক তৈরি করছে তবে এখনও এই রোবট শিল্প ঠিক শ্রমের চাহিদা পুরণে যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যে গৃহভৃত্যা সরবরাহ করবার উদ্যোগ নিয়েছে। তারা একটা চুক্ত সম্পাদিত করেছে যে চুক্তির বদৌলতে আমাদের দেশের শ্রমিকেরা ন্যুনতম ১৫০০০ হাজার টাকায় তাদের মূল্যবান শ্রম বিক্রী করবে মধ্যপ্রাচ্যে, ভারত কিংবা পাকিস্তান যখন নিজেদের দেশের নাগরিকদের শ্রমের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলো ন্যুনতম ২৫০০০ বাংলাদেশ কোনো এক অজানা কারণে এইসব দেশের সাথে সহমত হয় নি। বাংলাদেশ গৃহভৃত্য কিংবা গৃহভৃত্যা সরবরাহ করবে, আমাদের দরিদ্র মানুষেরা কখনও ওভেন ব্যবহার করে নি, তারা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করে নি, তারা ওয়াশিং ম্যাশিন ব্যবহার করে নি।

এ নিয়ে আমাদের কর্তাব্যক্তিদের মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে যায়, তাই তারা একটা স্কুল খুলেছেন , ট্রেনিং স্কুল যেখানে গিয়ে গৃহভৃত্যারা উন্নত দেশের গৃহের আভ্যন্তরীণ সহায়ক যন্ত্রগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে বাংলাদেশের মান উন্নত বিশ্বে সমুন্নত রাখতে পারে। অন্য চাহিদা হলো যৌনতার চাহিদা, যৌনতার ব্যবসা কয়েক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। যৌনতার ব্যবসায় যে পরিমাণ টাকা প্রতিবছর হাত বদল হয় তা আমাদের বাৎসরিক বাজেটের তুলনায় অনেক বেশী । এত টাকা বিনিয়োগ করছে কারা, কত প্রকারে? শুধুমাত্র পতিতালয়ের যৌনকর্মীর চাহিদা পূরণ নয় বরং বিকল্প নিরাপদ যৌনতার চাহিদাও তৈরি হয়েছে বিশ্বে। পর্ণো ছবি, ভিডিও কিংবা স্থির চিত্র, অন্য যৌন চাহিদা পুরণের জন্য মানুষ টাকা খরচ করছে।

এর সাথে আরও কিছু কুসংস্কার যুক্ত হয়েছে। একটা কুসংস্কার আছে অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক বালিকা যারা ঋতুমতি নয় এবং যাদের বয়ঃসন্ধিকাল এখনও আসে নি, তাদের সাথে শাররীক সম্পর্ক স্থাপন করলে অনেক যৌনরোগ সেরে যায়। তাই এইডসআক্রান্ত এবং যৌনহীনমন্যতা কিংবা অন্যসব যৌনদুর্বলতায় ভোগা মানুষেরা এইসব অক্ষতযোণী বালিকাভোগের জন্য হাজার ডলার খরচ করতেও রাজী। এই নিয়মিত অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং বয়ঃসন্ধিকাল না পেরোনো অক্ষত যোনি এবং অক্ষত পায়ু বালক বালিকার নিরবিচ্ছন্ন সরবারাহ আসবে কোথা থেকে? সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় অনুন্নত দেশ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এইসব দেশে যৌন পর্যটনে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এদের ভেতরে শুধুমাত্র শ্রীলঙ্কা এইসব মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

বাকি সব খানেই এখনও এই বাণিজ্য চলছে। জয় হোক মানুষের কুসংস্কারের। মানুষ জন বালক বালিকা ছিন্ন করে পরিণত সক্ষম পুরুষ হয়ে উঠুক। আমাদের দরিদ্র দেশ অবিরত অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের সরবারহ করে যাবে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.