গলাবাজ আর সত্যিকারের লেখক এই ব্লগে টিকে থাকে, আমি কোনটাই না
পর্ব ১ এখানে
পর্ব ২ এখানে
সময় হিসাব করলে ভার্সিটি লাইফের একটা বিশাল অংশ কাটিয়েছি ক্যাফেতে। প্রথম প্রথম র্যাগের ভয়টা কেটে যেতে যে কয়দিন, তারপর আমরা দল বেধে ক্যাফে যেতাম। কখনো বারান্দায়, কখনো ভিতরে বসে চলতো ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা। সিংগারা আরা আলুর চপ ছিলো আমাদের কমন আইটেম। আমাদের ঠিক পাশেই টিচার দের ক্যাফে, লাগোয়া।
মাঝে মাঝে আমাদের গলার আওয়াজ এতই বেশি হতো যে উনারা এসে আমাদের একটু ভলুম কমাতে বলে যেতেন। আমরা ছিলাম ফোর্থ ব্যাচ, একদিন ফার্স্ট ব্যাচের ভাইয়ারা আমাদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে কোক সিংগারা খেলেন। ওনাদের তখনও থিসিস হয়নাই তাই ওনারা ক্যাম্পাসে তখনও মহড়া দিতেন। পরে এই বড় ভাইয়াদের সাথেই আমাদের সবথেকে আন্তরিকতা হয়েছিলো। সেটা অন্য একটা ঘটনা, পরে লিখবো।
ক্যাফের মালিক সাগর ভাই ইয়াং মানুষ, আমাদের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক উনার। প্রথম দিকে ক্যাফেতে কাজ করতো সেলিম নামে একজন, পরে অন্য কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যায় সে। সেলিমের কথা মনে হলে সাদিয়া আপুর কথা মনে পড়ে। উনি ব্রেকের সময় ক্যাফেতে আসতেন, তারপর চেয়ারে বসে খুব আদুরে গলায় ঢং করে মধ্যমা আংগুল টা বাকিয়ে ডাক দিতেন- অ্যাই সেলিম একটা সিংগারা দাও তো। আরেকটা নেপালী মেয়ে ছিলো, তার প্রতিদিন একই রুটিন, একটা কোক সাথে একটা আলুর চপ, সেলিম জানতো যে আপু কি খায় তাই উনি ঢোকামাত্র কোক চপ হাজির।
সেলিম থাকতে থাকতেই কাজে যোগ দিলো ছগির। কিভাবে যেন এদের সবার সাথে একটা খুব কাছের সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেলো। মাঝে মাঝে আমরা দেরি করে ফেলতাম, সব আইটেম শেষ, কিন্তু সেলিম অথবা ছগির তাদের জন্য তুলে রাখা খাবার আমদের কে দিতো। কখনো একসাথে বসে ভাগ করে খেতাম আমরা।
এর কিছুদিন পর হঠাৎ করে একটা বাচ্চা ছেলে কাজে জয়েন করলো, কি মায়াময় তার চেহারা।
নাম তার রিয়াজ, আমরা কাছে ডেকে কথা বললে সে যেন খুশি ধরে রাখতে পারতোনা। তখন শীতকাল, কিন্তু রিয়াজকে দেখি পাতলা একটা জামা পরে সে ঘুরঘুর করে। খবর নিয়ে জানলাম অনেক অভাব ওদের, একটা সোয়েটার যে কেউ কিনে দেবে সে অবস্হা নাই। আমরা দুই তিন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম ওকে একটা নতুন সোয়েটারই কিনে দেবো। তারপর টাকা তুলে ওকে নিয়ে গেলাম দোকানে, ওর পছন্দ মতো সোয়েটার কেনা হলো।
কাউকে যে এত সহজে এতটা আনন্দ দেয়া যায় আগে কখনো বুঝিনি। রিয়াজের আরেক বিশাল গুনের কথা জানলাম কিছুদিন পরে। কোন একটা নবীন বরনে কারা যেন ওকে মন্চে গান গাওয়ালো, লোকগীতি টাইপের। রিয়াজ সেকি হিট, ও টুকটাক গাইতো কাজের ফাকে আমরাও শুনেছি কিন্তু এতো ভালো গায় কে জানতো। অডিটোরিয়াম ভরা লোকের সামনেও এতটুকু নার্ভাস না সে।
ছেলেটা তরতর করে বড় হতে লাগলো আমাদের সামনে, একসময় সেও চলে গেলো। অনেক দিন পর ক্যাম্পাসে আবার তাকে দেখলাম, বেড়াতে এসেছে, চেনাই যায়না, অনেক লম্বা হয়েছে, যেন পরিপূর্ণ যুবক।
আর্কির ছেলেপেলেরা বেশি আড্ডা মারার সময় পেতোনা, যেটুকু পেতো জমিয়ে মজা করতো ওরা। সবথেকে মজা লাগতো কাউকে পচানোর স্টাইল। হয়তো ক্যাফের ভিতরে এককোনায় ওরা বসে আছে, অন্যদিকে অন্য ছাত্ররা, দূর থেকে হয়তো পরিচিত কাউকে আসতে দেখা গেলো।
ক্যাফের ভিতর সে ঢোকা মাত্রই সবাই একসাথে হাততালি, সবাই ঘুরে তাকায় কি ব্যাপার দেখার জন্য। যে ঢুকলো তার তো তখন বেকুব হবার দশা, এতগুলো চোখ তার দিকে একসাথে তাকিয়ে।
ক্যাফের বারান্দায় শীতকালে একটু রোদ্দুর খোঁজার সেকি চেষ্টা আমাদের, আর গরম কালে কেউ বারান্দায় বসতে চাইতো না। তবু বারান্দাটা আমার বেশি প্রিয় ছিলো। একদিনের ঘটনা, তখন প্রেমের মিডল এজ, সকাল ৯ টার বাসে এসে শুনি কোন কারনে আজ কোন ক্লাস হবেনা, বাসায় ও যেতে ইচ্ছা করছেনা, দুজনে দুটো চেয়ার নিয়ে বসে পড়লাম বারান্দার এক কোনায়।
কয়েকবার হালকা নাস্তা, দুপুরের খাবার আর ছোটঘরে যাওয়া বাদ দিলে টানা বিকাল ৫ টা পর্যন্ত কাটিয়ে দিলাম ওখানে বসে। হায়! কি রঙিন সেই দিন গুলো।
এই ক্যাফের বারান্দায় আমার আরেকটা উল্লেখযোগ্য স্মৃতি আছে। জানিনা স্মৃতিটা যাকে নিয়ে তার আর আজ মনে আছে কিনা। তখন কেবল ক্লাস শুরু হয়েছে।
সবাই সবার সাথে পরিচিত হয়ে পারিনি। একদিন বারান্দায় বসে আছি, আমারই এক ক্লাসমেট এসে চেয়ার নিয়ে আমার সামনে বসলো। পরিচয় পর্বের কিছু কথা হলো, হঠাৎ কি মনে করে সে আমাকে বললো আমরা মনে হয় ভালো বন্ধু হতে পারি। একটু অবাকই হলাম, এত অল্প পরিচয়ে আমার বন্ধু হতে চাওয়ায়। যাইহোক তারপর শুরু হলো আমাদের বন্ধুত্বের পথচলা, আজও আমরা একই দেশে আছি।
বন্ধুটার নামটা বলেই দেই, সে হলো এই ব্লগেরই একজন-রেটিং ওরফে সোহাগ।
সরাসরি রাজনীতির চর্চা না থাকায় খুব একটা গোলযোগ হতে দেখিনি কোনদিন। তবে কোন কোন সময় চেয়ারে বসা নিয়ে ছোট খাটো ঘটনা ঘটতো। চেয়ারের সংখ্যা ছিলো কম, তাই সবাই নজর রাখতো কোন চেয়ারটা ফাঁকা হবে। সেটা দখলে নেয়া নিয়ে অনেক সময় টুকটাক কথা কাটাকাটি হতো কারৈ কারো ভিতর।
তবে আমরা যখন জুনিয়র ছিলাম প্রায় সব বড় ভাইবোনকেই আমরা চিনতাম এবং তাদের সাথে দারুণ সম্পর্ক ছিলো আমাদের। আস্তে আস্তে ডিপার্টমেন্ট বাড়লো, ছাত্রসংখ্যা বাড়লো। কেন যেন আগের সেই পারিবারিক ইমেজ টা নষ্ট হতে থাকলো। বেশিরভাগই যে যার মতো চলে, যার কারনে মাঝে মাঝে এ ধরনের টুকটাক মনোমালিন্যগুলো হতে থাকলো। জুনিয়রদের কাছে বড়ভাই মানেই যেনো শুধু র্যাগ দেয়া, এভাবেই শুরু হতে থাকে ছাত্রদের ভিতর মানসিক দূরত্ব।
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।