আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প: ডোনা ম্যাডোনা

সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার

পাগলই হয়ে গেল ডোনা ম্যাডোনা। ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারে নি কেউ। এই বস্তিতে থেকেও নানা ঘটনাপ্রবাহে এতেটা সুচারু নজর যার, অন্যের সমস্যা সমাধানে যার এতোটা ধৈর্য, সে মানুষটি এতো সহজে পাগল হয়ে যাবে, তা সহজে মেনে নিতে পারলো না বস্তির লোকজন। কেমন যেন এক হতাশার হাওয়া বইলেও, আশার সামান্য একটু অংশ খড়কুটোর মতো লেগেই রইলো সে হতাশার শরীরে। হয়তো খুব তাড়াতাড়িই আবার সুস্থ হয়ে উঠবে ডোনা ম্যাডোনা।

এর কারণও রয়েছে অনেক। বস্তির বাসিন্দাদের জন্যে কম করেছে নাকি ডোনা ম্যাডোনা! ইচ্ছে করলেই ভুড়ি ভুড়ি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। রিকার্ডোর ছেলেটা যখন কলেরায় পড়লো, ভয়ে ত্রিসীমানাও মাড়ায়নি কেউ। রিকার্ডো আর তার রক্তশূন্যতায় ভোগা বউ দাওয়ায় বসে হাঁউ হাঁউ কান্না ছাড়া আর কিছুই করতে পারে নি। একমাত্র ডোনা ম্যাডোনাই ছুটলো শহরে।

ফিরে এলো স্যালাইনের বহর নিয়ে। নাওয়া খাওয়া শিকেয় রেখে ছেলেটির পাশে ঠায় হয়ে বসে রইল স্যালাইনের মগ হাতে। তিনদিন পর ওঠে দাঁড়ালো ছেলেটি। এখন তো দিব্যি তাগড়া জোয়ান। পাসেকোর মেজো মেয়েটিকে নাকি বগলদাবা করে ঘুরে বেড়ায় এদিক সেদিক।

জিকো মাতাল হয়ে বাড়ী ফিরে পিটিয়ে বৌকে মেরেই ফেলছিল প্রায়। যে রকম দশাসই চেহারা তার, কার সাধ্যি বাঁধা দেয়! একমাত্র ডোনা ম্যাডোনাই এগিয়ে গেল। সার্টের পেছনের কলার ধরে ঠেলে ঘরের বাইরে এনে বসিয়ে দিল। জিকো একটি বারও ডোনা ম্যাডোনার চোখের দিকে তাকাতেও সাহস পেলো না। তার তিনকুলে কেউ আছে, নাকি নেই, সে কথা জানা নেই কারো।

এই বস্তির জন্মলগ্ন থেকেই এখানে তার বাস। আর এখন তো ষাট পেরিয়ে বয়েস! বিশাল পাহাড়ের মতো শরীর, অথচ চেহারায় শিশুর সারল্য। ধর্মগুরু সেইন্ট ক্রিষ্টোফারের প্রতি অপার বিশ্বাস! বস্তির নানা ঝঞ্ঝাটের মাঝে সময় পেলেই ধর্মগুরুর প্রতি প্রর্থনায় ডুবে যায়। সব ধরনের বিপদ আপদে তার এই ধর্মগুরুই নাকি রক্ষা করেন তাকে। এরকম একটি মানুষ সহজে পাগল হয়ে যাবে, তা কি সহজে মেনে নেয়া যায়? বিশেষ এই কঠিন বিপদের মুখোমুখি যার উপর ভরসা সবার, সে ই যদি পাগল হয়ে যায়, তাহলে চলবে কি করে? কিন্তু পরিস্থিতি অনেক কিছুই মেনে নিতে বাধ্য করে।

ডোনা ম্যাডোনার পাগল হওয়া মেনে নিতে বাধ্য হলো সবাই। এতোদিনের এই বস্তি ছেড়ে যে অন্য কোথাও যেতে হবে, তাও মেনে নিতে হবে একদিন। অথচ সরকারপক্ষীয় লোকজন তো অন্য কথাই বলে এসেছে বারবার। বলেছে, নামমাত্র ভাড়ার বিনিময়ে সরকার তাদেরকে স্থায়ীভাবেই থাকার অনুমতি দেবে। ছোট ছোট পাকা বাসা, পানি আর গ্যসের বন্দোবস্ত, সবই নাকি করা হবে।

এমনকি ভাড়ার অংক নিয়েও হিসেব নিকেষ করা শুরু হয়েছিল। অবশ্য ভোটের আগে এ ধরনের কথা অনেকেই বলে। কিন্তু হঠাৎই পাল্টে গেলো সব। বস্তির পাশে বড় ডোবাটি পেরিয়েই বিশাল ধুধু মাঠ। মরুভূমির মতো শুকনো।

কিছু কিছু চাষী সেখানে গম চাষ করতো। ডোনা ম্যাডোনাদের বস্তিকে প্রায় মাড়িয়ে একদিন গোটা বিশেক ট্রাক্টর রওয়ানা হলো সেদিকে। মাটি চাষ করা হলো, চার কিলোমিটার দূরের নদীতে পাইপ বসিয়ে পানি এনে ভরাট করা হলো ডোবাটি। সেই পানি ব্যাবহার হলো সেচের জন্যে। বড়োবড়ো আখের চারায় সবুজ হয়ে উঠলো পুরো মাঠটি।

এত চিনি কে খাবে, এ নিয়ে উতাল পাতাল ভাবনা শুরু হরার আগেই আসল কারণটি জানতে পেলো সবাই। চিনির বদলে নাকি তেল বের করা হবে আখ থেকে। আর তেল বিক্রির পয়সায় ধনী হবে ব্রাজিল আর গাড়ী চলবে ইউরোপ, আমেরিকার রাস্তায়। প্রথমে খুশীই হয়েছিল বস্তির লোকজন। কিছু লোক সেখানে কাজও পেলো।

বুড়ো বয়েসে কাজ না পেলেও একটি কারণে ডোনা ম্যাডোনাও ধন্যবাদ জানালো সেইন্ট ক্রিষ্টোফারকে। আগে যে ডোবাটি বছরের বেশীরভাগ সময়েই শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে থাকতো, তলানীতে কালো নোংরা পানি, সেটি এখন সর্বক্ষণই ভরাট। খাওয়া, গোসল করার, কাপড় ধোয়ার সমস্যা এখন তো আর নেই বললেই চলে। সেইন্ট ক্রিষ্টোফারের কৃপা ছাড়া কার কপাল এত চওড়া হতে পারে? আখ মাড়াইএর কারখানা হবে, বস্তি এলাকা থেকে উচ্ছেদ করা হবে ওদেরকে, এটা যখন প্রথমবার গুজবের মতো ছড়ালো, তেমন একটা পাত্তা দিল না ডোনা ম্যাডোনা। সেইন্ট ক্রিষ্টোফার যেখানে দয়ার হাত তুলেছেন ওদের উপর, সেখানে এসব গুজব কতোটাই বা শক্তিশালী হতে পারে? তারপর যখন গুজবটি একটু পাকাপোক্ত আর সূত্রগুলো আরো নির্ভরযোগ্য হতে শুরু করলো, তখন কিছুটা চিন্তা হলো তার।

কিছুদিন পর একজন দু’জন সাংবাদিক এসে প্রশ্নও করলো, কোথায় যাবে, কি করবে, ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েও ডোনা ম্যাডোনা সেইন্ট ক্রিষ্টোফারের উপর ভরসার কথা বলে অটল হয়ে রইল। এই ভরসার প্রভাব বস্তির লোকদেরকেও ইতিবাচক হয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। কিন্তু একদিন সেই সরকারপক্ষের লোকদের সাথে করেই আরো গাট্টাগোট্টা কয়েকজন এলো বস্তিতে। জানিয়ে গেলো, একমাসের মাঝে বস্তি ছেড়ে যেতে হবে ওদেরকে।

তখনও ডোনা ম্যাডোনার অপার ভরসা সেইন্ট ক্রিষ্টোফারের উপর! বস্তির লোকদের নিয়ে সভা করলো, মিছিল করলো শহরে, কিছু মাঝারি ছোট রাজনীতিবিদ আর আমলার সাথে দেনদরবারও হলো । কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হলো না। পৃথিবীব্যাপী পরিবেশদূষণকে কমিয়ে আনা, আর সেই সুযোগে নিজেদের ব্রাজিলকে ধনী করে তোলার পাশাপাশি কয়েকজন বস্তিবাসীর আর্জি ধর্তব্যের মাঝেও আনলোনা কেউ। একমাস সময়ের কুড়িদিন পেরোনোর পরই সেই গাট্টাগোট্টা লোকগুলো এলো আবার। সরকার পক্ষের লোকগুলোর বদলে এবার গুন্ডাগোছের আরো কিছু লোক এলো সাথে।

তাদের সর্দারের সাথে কিছু তর্কাতর্কি হলো ডোনা ম্যাডোনার। সর্দার তাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে তার ঘরের সামনে লাগানো সিমগাছকে মাড়িয়ে এগিয়ে যায়। ডোনা ম্যাডোনা পেছন থেকে কেঁদে কেঁদে বললো, - ধাক্কা দিলে তুমি! পবিত্র ক্রিষ্টোফার বিচার করবেন তোমার এই অভদ্রতার। সর্দার চলে যাচ্ছিল। ডোনা ম্যাডোনার দিকে পেছন ফিরে তাকিয়ে বললো, - তোমার ক্রিষ্টোফার আবার কি বিচার করবে আমার? ওকে তো পাছার ভেতরে লুকিয়ে রাখি আমি! বলেই নিজের বিশাল নিতম্বে একটি চাপড় মেরে দেখিয়ে দিল।

তখনই নাকি সর্দারের পাছায় সেইন্ট ক্রিষ্টোফারকে দেখে আধপাগল হয়ে যায় সে। যারা সেইন্ট ক্রিষ্টোফারকে পাছার ভেতরে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তারা কতো ক্ষমতাধর হতে পারে, তা ভেবেই প্রথম ধাক্কাটি খেলো। আবোল তাবোল বকতে শুরু করলে একজন এসে নিয়ে যায় তার ডেরায়। সেখানে একটি পুরোনো খবরের কাগজে জর্জ বুশের পাছায় দেখে যীশুকে। টেলিভিশনে বিন লাদেনের একটি ভিডিও চলার সময় তার পাছায় দেখে মুহম্মদকে।

এভাবে বিভিন্ন মনীষী মহামনীষীদের নানা প্রভাবশালী লোকের পাছার ভেতরে দেখে দেখে এখন বদ্ধ পাগল ডোনা ম্যাডোনা। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে আর নিজের মাথার চুল ছেড়ে। বস্তির লোকরা বেশ বিপদেই পড়েছে। একদিকে বস্তি ছেড়ে দেয়ার এই ভয়াবহ বিপদ, অন্যদিকে ডোনা ম্যাডোনার পাগল হয়ে যাওয়া। ডোনা ম্যাডোনাকে ওরা ভালোবাসতো, ওর উপর ভরসাও করতো।

এখন এই পাগলীকে নিয়ে কোথায় যাবে, কি করবে, ভেবে কূলকিনারা পায়না কেউ। আশায় আছে, একদিন পাছায় অন্য কোন মনীষী নিয়ে কেউ একজন সদয় হবে ডোনা ম্যাডোনার প্রতি, বস্তিবাসীর প্রতি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।