আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে আলাপচারিতা

'... আমাদের আশার কোনো পরকাল নাই'

‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের জন্য আনন্দ পুরস্কার গ্রহণ করতে কলকাতায় যাত্রার আগের রাতে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে নিজ বাসা রাজশাহীর উজানে বসে দু’ঘন্টা ধরে নানা বিষয়ে কথা হয় সমকাল পত্রিকার তরফে যাওয়া আমার। আলাপচারিতার আংশিক সমকালে ছাপা হয়েছে। পুরো আলাপচারিতাটা এখানে তুলে দেয়া হলো। *প্রথমেই আনন্দ পুরস্কার পাবার জন্য আপনাকে অভিনন্দন। পুরস্কার নিয়ে কিছু বলুন।

** পুরস্কার পাবার পর থেকে আমাকে অজস্রবার প্রতিক্রিয়া বলতে বলা হচ্ছে। কিন' আমার তো মনে হয় না, পুরস্কারের প্রতিক্রিয়া হিসেবে কিছু বলার থাকে। কারণ আমি যে ক্রিয়াটা করেছি, পুরস্কারটা তো তারই প্রতিক্রিয়া। তবে পুরস্কার নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। পুরস্কার পেলে সাধারণভাবে ভালো লাগে, খুশি হই।

কিন' আমি সব সময় একটা বিষয় মনে রাখি। আমি যে কাজটা করি, লোকে বলে, সাহিত্যের কাজ করছি। সেই কাজের স্রষ্টা যিনি, তিনি কিন' কাজটা এককভাবেই করেন। স্রষ্টা খুব বড় শব্দ। আমি নিজের ব্যাপারে ওই শব্দটি ব্যবহার করতে সঙ্কোচ বোধ করি।

তবে এটা ঠিক যে সাহিত্যের কাজ যিনি করেন তিনি তো সৃষ্টিই করেন। তো সেই সৃষ্টির কাজটা কিন' তাকে কোনো সহযোগিতা ছাড়া একাকীই করতে হয়। কাজটা কখনো দায়িত্ব হিসেবে আসে, কখনো চ্যালেঞ্জ হিসেবে। আমি যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করি তখন অবশ্যই সেটা অসম্ভব রকম উদ্বেগ, আতঙ্ক ও আশঙ্কা তৈরি করে আমার ভেতরে। সেই কারণে যখন আমি লেখালেখির মধ্যে ঢুকে যাই তখন আমার মেজাজ খিঁচড়ে থাকে।

কারণ আমি বিশ্বাস করি যে, এটাই আমার কাজের জায়গা এবং এইখানটায় কারোর সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। সেই সহযোগিতা পুরস্কারেও মেলে না কোনোকিছুতেই মেলে না। কাজের সেই জায়গায় লেখককে একা সব যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। সফল হলে তার আনন্দটাও তাকে সহ্য করতে হয়। এরপরে পুরস্কারের বিষয়টা আসে।

পুরস্কার আসলে সেই কাজগুলোকে অনুসরণ করে। পুরস্কার পেলে তখন লেখক মনে করেন যে তিনি যে কাজ করেছেন, তার একটা স্বীকৃতি পাওয়া গেলো। সেই কাজ এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বলে মনে হয়। আমার সমস- অভিজ্ঞতার, সংগ্রামের, ভালোবাসার, প্রীতির, ক্রোধের, রাগের যা কিছু আছে সেটিকেই তো আমি লেখক হিসেবে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। সাহিত্য আর কী কাজ করে? কখনো ভালো সমাজের স্বপ্ন দেখে, রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে, রাষ্ট্রের ব্যাধিগুলো চেনার চেষ্টা করে।

নানাভাবে সাহিত্য তো এই কাজগুলোই করে। সেইটা যখন অন্যের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে পুরস্কার তখন তার এক ধরনের স্বীকৃতি জ্ঞাপন। পুরস্কার পেলে মনে হয়, কাজটা হয়তো ব্যর্থ হয়নি। কিন' তাতে আমার কাজের ভারটা যে কমে গেলো বা আমার কাজে যে সাহায্য করা হলো তা কিন' নয়। আবার যখন আমি লিখতে যাবো, তখন আমাকে একাকী সেই একই পরিসি'তির মুখোমুখি হতে হবে।

এর বাইরে পুরস্কারের অর্থমূল্য কিংবা যশখ্যাতি আছে। আমি কোনোদিনই সেসবের তোয়াক্কা করিনি। পুরস্কার আসলে মূল কাজটাকে অনুসরন করে- এর বেশি পুরস্কার নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। *আপনার আগে বাংলাদেশের যারা এই পুরস্কার পেয়েছেন তাদের কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? আপনার ‘আগুনপাখি’ পুরস্কৃত হবার মূল জায়গাটিকে কীভাবে চিহ্নিত করছেন? **সাহিত্যের পাঠক হিসেবে যদি বলি, তাহলে আমার শামসুর রাহমান-পাঠ, কি ইলিয়াস-পাঠ, কি তসলিমা-পাঠ ও তাদের সম্পর্কে আমার যে মূল্যায়ন তা কোনো ইতর বিশেষ পুরস্কার পাওয়ার ফলে হয়নি। পুরস্কারের ওপর নির্ভর করে যা পছন্দ করি না তা পছন্দ করতে শুরু করলাম, যেটাকে বড় সাহিত্য বলে মনে করি না, সেটাকে পুরস্কার পেয়েছে বলে বড় সাহিত্য বলে মনে করলাম- এ দশা আমার এখনো হয়নি।

আমার ক্ষেত্রেও একই কথা। আগুনপাখি আনন্দ পুরস্কার পেয়েছে বলে আগুনপাখি খুঁজে বের করে পড় কিংবা পুরস্কার পেয়েছে বলেই অসাধারণ সাহিত্য হয়েছে- তা আমি মানতে রাজি নই। যাচাইয়ের প্রশ্নটা সবক্ষেত্রে থেকেই যাবে। কারণ আমি সব সময় বলবো, একজন লেখক তার লেখার চেয়ে বড়, একজন মানুষ তার প্রতিভার চেয়ে বড়। পুরস্কারকে পুরস্কারের জায়গায় রেখে এটা আমাদের সব সময় মনে রাখা উচিত।

*মূলতঃ ছোটগল্প নিয়ে আপনি দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন? তারপর উপন্যাসের পথে এসেছেন। কিন' প্রথম যে উপন্যাস ‘বৃত্তায়ন’ তাকে কিন' আপনি লেখার পর একরকম খারিজ করে দিয়েছিলেন। এর কারণ কী ছিলো? ** ‘বৃত্তায়ন'কে মানতে চাইনি তার কারণ কিন' ভিন্ন। লেখক হিসেবে আমি যে রাস-াটা ধরেছি, সেখানে ওই লেখাটি যেনো ভিন্ন পথ ধরেছিলো। ‘বৃত্তায়ন’ রচনার পর আমি কখনো এই পথে হাঁটবো না বলে সিদ্ধান- নিই।

পরে আর হাঁটিও নি কোনোদিন। সে কারণে ওই লেখাটি একাকী পড়ে আছে। সে কারণে আমি আমার স্ট্যাম্পটা ওখানে দিতে চাইনি। কিন' আমি কখনো এই রচনাটিকে আমার লেখা হিসেবে অস্বীকার করিনি। *কিন' সেটিকে তো আপনি উপন্যাস হিসেবেই মানেননি... ** আমার কোনো লেখা সম্পর্কেই আমি কখনো অভিধা তো দিই না।

এইটা ছোট গল্প বা ওইটা উপন্যাস এমন তো আমি কখনো বলি না। আমি কেবল লিখি। যারা তা পড়েন তারা সচরাচর এইসব অভিধা দিয়ে দেন আর কী! কাজেই উপন্যাস হলো কি না তা ভেবে নয়, অন্য কারণে আমি বৃত্তায়ন প্রকাশ করতে চাইনি। কিন' আমি যে এটা সৃষ্টি করিনি তা তো বলতে পারবো না। আমার লেখার ইতিহাসের সঙ্গে যে তা জড়িয়ে গেছে।

কিন' পরে যখন একজন প্রকাশক আগ্রহ দেখালেন তখন সেটিও প্রকাশে আমি সম্মত হয়েছি। *পরের উপন্যাস ‘শিউলী’র ক্ষেত্রে কী হয়েছিলো? ** ‘শিউলী’র ব্যাপারে আমি সবার আগে যা বলতে চাই সেটি হলো, আমি খুব সিরিয়াসলি এই লেখাটি শুরু করেছিলাম... * তা করেছিলেন। কিন' আমরা যদ্দূর জানি, ষাটের দশকে আপনি ‘শিউলী’ লিখেছিলেন, আর আমরা তা পড়তে পেরেছি ২০০৬ সালে। ** হ্যাঁ, ষাটের দশকে আমি লেখাটা শুরু করেছিলাম। একজন নারীকে মূল চরিত্র করে আমি একটি বড় পরিবারকে দেখিয়েছি।

যেই পরিবারে পুরুষ মানুষ বলতে মূলতঃ কেউ নেই। বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে গেছে। সেই পুরো পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ওই নারীর দেশত্যাগকে ঘিরে আমি বিষয়টিকে আনতে চেয়েছিলাম। আমার যদ্দূর মনে পড়ে, এটা ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে আমি শুরু করেছিলাম। যখন লিখছিলাম, তখন আমার মনে হতো, লেখাটি বোধহয় ভালোই হচ্ছে।

অনেক ক্ষেত্রে আমার লেখা খানিকদূর এগিয়ে তা বন্ধ হয়ে গেছে। ‘শিউলি’র আগেও এমন হয়েছে। ‘শিউলি’ও খানিকদূর এগিয়ে আমি ছেড়ে দিলাম। সেই লেখাটা আর ধরা হয়নি। পরবর্তীতে ৩৫ থেকে ৩৮ বছর পরে আবার আমি ওই লেখাটা যখন বের করলাম, তখন মনে হলো, অনেক কাঁচা ছিলাম আমি।

ঔপন্যাসিক হিসেবে যে জায়গা থেকে আমার দেখা দরকার, যে বিশ্লেষণ ও যুক্তি কাজ করা দরকার, তা থেকে সরে গিয়ে আমি একটু বেশি ভাবপ্রবণ হয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম। কাজেই আমি ঠিক করেছিলাম, ওই লেখাটা আর ধরবো না। কিন' তারপর হলো কী, জনকণ্ঠ থেকে এখলাসউদ্দিন আহমদ আমাকে বললেন, ঈদ সংখ্যায় একটা লেখা আমায় দিতে হবেই হবে। এখলাস আমার খুব ঘনিষ্ঠ একজন মানুষ, নাছোরবান্দা। ও যেমন করে মানুষের ঘাড় মুচড়ে লেখা আদায় করতে পারে, তা খুব কম জনই পারেন।

তো সেই নাছোরবান্দার চাপাচাপিতে আমি এক প্রকার বিপদে পড়েই ওই লেখাটাকে আর বের করলাম। আর সেই একই আপত্তি আমার থেকে গেলো, লেখাটা তো খুব কাঁচা। এখন এতোদিন পরে এই কাঁচা লেখাটা বের করবো? অনেককে জিজ্ঞাসা করলাম। অনেকে বললেন, কাঁচা হলেও নতুন লেখকদের লেখার যে সজীবতা, তা ‘শিউলি'তে আছে। তখন আমি মূল লেখাটিকে হাত না দিয়েই শুধু বললাম, লেখাটা বড় একটি উপন্যাসের অংশ হিসেবে শুরু হয়েছিলো।

এখন যে বয়সে পৌঁছেছি তাতে ওই লেখায় ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয়। এই অবস'াতেই লেখাটা প্রকাশিত হয়। * ‘শিউলী'তে আপনি যে মূলসুর আনতে চেয়েছিলেন, সেই সুরটিই কি আপনি ‘আগুনপাখি'তে তুলে আনেননি? ** বিষয়টা তো খানিকটা ঠিক বটেই। অন্য ফর্মে, অন্য ভাষায়, নতুন আঙ্গিকে- যা বাংলা উপন্যাসে আগে কখনো হয়নি ‘আগুনপাখি’ সেভাবেই এগিয়েছে। ঠিক কীভাবে বললে আমার বলাটা ঠিক ঠাক মতো হয়, আমি সেভাবেই সচরাচর বলে থাকি।

এতেও তাই করেছি। আমি দেশভাগের বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখতে চেয়েছি। রাজনৈতিক দল, নেতৃত্ব বা ওই সময়কার আন-র্জাতিক দৃশ্যপট সেসব অনেক বড় ব্যাপার। কে দায়ী, কার দোষ- দেশভাগ নিয়ে এমন অনেক আলোচনাই চলে। কিন' যে একেবারে সাধারণ মানুষ, যার এই পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো অংশীদারিত্ব ছিলো না, তার ঘাড়ে এই দায় চাপবে কেন? তাকে দেশত্যাগ করতে হবে কেন? অন্যসব হিসাব বাদ দিই, ‘আগুনপাখি’র সেই নারীকে দেশত্যাগ করতে হবে কেন? এবং বিষয়টা যে তাকে কোনোভাবেই বোঝানো সম্ভব হয় না।

কাজেই এক অর্থে কথাটা ঠিকই আছে, ‘শিউলি’তে যা আনতে চেয়েছিলাম, অন্যভাবে ‘আগুনপাখি'তে আমি সেই জায়গাকেই ধরতে চেয়েছি। আমি যদি সময় করে উঠতে পারতাম, তাহলে এই পুরো ইতিহাসটাই বড় পরিসরে ভলিউম আকারে লিখে হাজির করতাম। জানি না, সেই কাজটা হবে কি না। তবে করার তাগিদ ও ইচ্ছে দু'টোই আছে। * ‘আগুনপাখি’তে আপনার কেন্দ্রীয় চরিত্রটি শেষ পর্যন- একা হয়ে যায়।

সামাজিক ইতিহাসের যে অংশের বয়ান আপনি তুলে ধরতে চেয়েছেন, সেখানে কি সবাইকে আপনি একা-ই দেখেছেন? ** হ্যাঁ, একাই তো। শেষ পর্যন- সেই মানুষগুলো একাই তো রয়ে যায়। বিশেষ করে ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে একথা তো বেশি প্রযোজ্য। আসলে এ নিয়ে অনেক বলার আছে। অনেক হিসাব আছে, শুনি, সেগুলো পণ্ডিতি হিসাব।

সেগুলো আসলে বাস-বে খাটে না। দেশভাগ নিয়ে বড় বড় কথা হয়: বাংলা ভাগটা শেষ পর্যন- কংগ্রেসই করলো, মুসলিম লীগের একাংশ বিরোধিতা করেছিলো, শরৎ বোস বিরোধিতা করেছিলেন, নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হয়েছিলো- এরকম অনেক কথা। কিন' একটা কথা ছেড়ে যাওয়া হয়, যে জীবনটা মানুষ যাপন করে, সেখানে এর প্রতিক্রিয়াটা কী? কাজেই একাকীত্ব তো প্রায় অবশ্যম্ভাবী। দেশভাগের সময় যারা এদেশ থেকে ওদেশ, ওদেশ থেকে এদেশ করেছে, তাদেরকে আমি একা-ই দেখেছি। এক দেশ থেকে আরেক দেশে এলেই যে সঙ্গী সাথী জুটে যায় এমন মনে করার কোনো কারণ নেই।

গ্রামের ৭০ বছরের একটা মানুষের কথা যদি চিন-া করি, সে যদি হঠাৎ এসে রাজশাহী শহরে বসবাস শুরু করে, তাহলে সে একা নয় তো কে একা? একাকীত্ব কি শুধু নির্জনতা? তা নয়, সহস্রের মাঝেও মানুষ সম্পূর্ণ একা থাকতে পারে। আমি তো সেটাকেই ধরবার চেষ্টা করেছি। * আপনার লেখাগুলোতে দেশভাগের প্রসঙ্গ এভাবে উঠে আসে কেন? ** আমার সমস- অসি-ত্বে দেশভাগ, দেশত্যাগ, এদেশ থেকে ওদেশ, ওদেশ থেকে এদেশ এই পুরো ব্যাপারটা এমন ক্ষত সৃষ্টি করেছে যে, কোনোভাবেই তা সারবে না। কোনো মলমেই তা সারানো সম্ভব নয়। আমার লেখায় জ্ঞানতঃ বা অজ্ঞানতঃ সেই বিষয়টিই ফিরে ফিরে আসে।

*এই দেশভাগ সাংস্কৃতিক বিভাজনের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রেখেছে বলে আপনি মনে করেন। ** আমরা অনেক সময় বলি যে, সাংস্কৃতিক বিভাজন ঘটানো যায় না। কিংবা আমরা বলে থাকি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজন এক কথা নয়। তবে আমার মনে হয়, কথাটা বলার আগে কী ধরনের রাষ্ট্রীয় বিভাজন আসছে তা বিবেচনায় নেয়া জরুরি। একটা বিষয় ঠিক যে, সাংস্কৃতিক বিভাজন সব সময় এক রকম হয় না।

যেমন জার্মানির কথা যদি ধরি। যুক্ত হবার আগে সেখানে প্রুশিয়া বলে একটি দেশ ছিলো। অনেক মানুষ ছিলেন প্রুশিয়ান, কিন' পরিচিত হতেন জার্মান বলে। যেমন দার্শনিক কান্ট কিন' জার্মান ছিলেন না। ছিলেন প্রুশিয়ান।

কিন' তাতে কিছু আসে যায়নি। বিনা আপত্তিতে কান্টকে জার্মান বলে আমরা জেনেছি। কারণ ওই রাষ্ট্রীয় বিভাজনটি এমন এক ধরনের বিভাজন ছিলো যে তা কাজ করেনি। কিন' আমাদের অবস'াটা কিন' ঠিক তা নয়। কিন' আমাদের এখানে যেহেতু রাষ্ট্র কাঠামোটাই আলাদা, সে কারণে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা তো হবেই।

আর কতগুলো বাস-ব বিভাজন আলাদা আলাদা জায়গার প্রেক্ষিতে তো থাকেই। আমাদের রংপুরের সাংস্কৃতিক জগত আর চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক জগত মোটেই এক নয়। এক দেশের মধ্যে হলেও এক নয়। কাজেই এ সমস- পার্থক্য তো আছেই। এই পার্থক্যগুলো আরো বেশি প্রকাশিত হয়েছে দেশভাগের কারণে।

এপারে কে কী করছে, ওপারে তা জানছে না; ওপারের চিন-া আমরা বুঝছি না। বিষয়টাকে যদি অখণ্ডতার নিরিখে বিবেচনা করা হয় তাহলে তা তো খণ্ডিত হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে আমরা আংশিক পাচ্ছি, সমগ্র নয়। এটা এপারের মানুষদের জন্য যেমন সত্য, তেমনি ওপারের মানুষের জন্যও। এ কারণেই কিন' রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে নিয়ে অনেক কথা বলতে হচ্ছে।

তাদের পরিচয় নির্ধারণে ‘আমাদের’ ‘আমাদের’ রব তুলতে হয়েছে। তো এভাবে সেই মহাপ্রতিভাদের কাটছাট করার প্রয়াস তৈরি হয়েছে। * আপনার সব লেখার উপজীব্য যে সাধারণ মানুষ, বর্তমান সময়ে সেই মানুষগুলো কেমন সময় অতিক্রম করছে? ** ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে সাধারণ মানুষ। গোটা দেশ সংকটে, এর সব মানুষ সংকটে। সমস- জায়গায় আমরা শুধু ব্যর্থতা দেখতে পাচ্ছি।

সবকিছু এমন মুখ থুবড়ে পড়েছে যে আমি কিন' অসম্ভব ভীত হয়ে পড়েছি। বিশ্বটাও যেন কেমন হয়ে উঠেছে- আমি বহু চেষ্টায়ও তা বুঝতে পারি না। যেমন খাদ্যের দাম। সারা জীবন ধরেই বিশ্বে খাদ্যের দাম ওঠানামা আছে। লোক তো আর হুট করে বাড়েনি।

তাহলে বিশ্বজোড়া কোনো একটি বিশেষ সময়ে খাদ্যের দাম এমন ধারা বাড়লো কী কারণে? কোন অর্থনৈতিক অপনীতি এখানে চলেছে? তথাকথিত অর্থনীতিবীদদের কথাবার্তাও আমি ঠিক ভালোমতো বুঝতে পারি না। খাদ্যের দাম যে বাড়লো, তাতে বাজারের বিচিত্র গতিটা কী? বিশ্বব্যাপী সেখানে কাদের স্বার্থ কাজ করছে? স্পষ্ট বলে দেয়া হচ্ছে, সস-ায় খাবার কেনার দিন শেষ। তো এমন হলো কেন? বলা যেতে পারে, মানুষ বেড়েছে, উৎপাদন কমেছে। কিন' মানুষ তো এক লাফে দ্বিগুণ হয়নি, খাদ্যও তো এক লাফে অর্ধেক কমে যায়নি। তাহলে তার জন্য এই মহাসংকট কেন আর কী কারণেই বা একেবারে বলে দেয়া হচ্ছে, সস-ার দিন আর নেই? আগে বিশ্বে অস্ত্র নিয়ে, এটা সেটা নিয়ে শোষণের জায়গা তৈরি হয়েছিলো।

এখন তো দেখছি, খাদ্য নিয়ে সেই শোষণের জায়গা তৈরি করা হয়েছে। কাজেই সারাবিশ্বেই মানব অসি-ত্ব এখন নিদারূণ হুমকির মুখে। আর আমাদের দেশের কথা যদি বলি তো যে রাষ্ট্র কাঠামো দেখছি, তাতে সাধারণ মানুষের প্রতি যে উদাসীনতা দেখানো হচ্ছে, তা অমার্জনীয়। * দীর্ঘ সময় ধরে দেশে মৌলবাদী ও জঙ্গিদের নানা তৎপরতা চলেছে। বাঙালির উৎসব আয়োজনগুলোও নানাভাবে বিঘ্নিত হয়েছে।

এবার আমরা পহেলা বৈশাখে সবকিছু উপেক্ষা করে যে প্রাণের জোয়ার দেখলাম, তা আগে কখনো আসেনি বলেই মনে হয়। এ বিষয়ে কি কিছু বলবেন? ** এমন হতেই পারে। নিজের সংস্কৃতি তো মানুষ কোনো না কোনোভাবে ধারন করে। হয়তো তারই বহিঃপ্রকাশ কোনো একটি সময়ে এমন ব্যাপকভাবে হয়। তবে বিষয়টি নিয়ে তোমরা যেভাবে আশাবাদী হচ্ছো, আমি কিন' ততোটা নই।

কারণ এই উৎসবে প্রাণের যে মিলন হয়, তা আসলে শক্তি। সেই শক্তি জন্ম নেয় এইরকম মিলন থেকে ঠিক আছে, কিন' শক্তিটাকে তো অশুভ’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কাজে লাগাতে হবে। তা না হলে তো এমন শক্তির জন্ম হবে, ক’দিন পরেই আবার সেই শক্তির নীরবতার সুযোগে অশুভ দখল করে নেবে। কাজেই তখনই আশাবাদী হওয়া যায়, যখন সঞ্চিত শক্তি সব অর্থেই অশুভ’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কাজে লাগানো যাবে। *অন্য প্রসঙ্গে যাই।

আপনি তো ‘প্রাকৃত’ নামের একটি কাগজ সম্পাদনা করতেন। হঠাৎ করে তা বন্ধ করে দিলেন। এ ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না? ** বাংলায় একটা কথা আছে-‘যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ’। যতোক্ষণ নিঃশ্বাস ফেলছি, ততক্ষণ একটা আশা আছে। কাজে এখনই পরিকল্পনা না থাকলেও ছেড়ে দেব কী করে? যদি কখনো পারা যায়, তখন তো করবোই।

* শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারে আপনার অংশগ্রহণ তো একেবারেই কম... ** নিশ্চয়ই। অস্বীকারের উপায় নেই, আগ্রহ থাকার পরেও শিশুসাহিত্যে আমি আলাদা করে কিছু করতে পারিনি। এরকম অনেক ব্যর্থতা তো আছেই। আর এর কারণটা বিশেষ কিছু নয়। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, লেখার চেয়ে আমি গল্প করায় সময় দিই বেশি।

অবশ্য এই গল্পও আমায় রসদ জোগায়। * শিল্প-সাহিত্যের যে চর্চা চলছে তা গতি-প্রকৃতি কোন পথে বলে আপনার মনে হয়। ** পরিসি'তি বিশেষ ভালো নয়। শিল্প-সংস্কৃতি আর সৃষ্টির জগতে দৈনদশা চলছে। কতোরকম আক্রমন যে চারপাশ থেকে আসছে।

আকাশ সংস্কৃতি, বিশ্ব সংস্কৃতি, পণ্য সংস্কৃতি- এগুলো তো আছেই। চারপাশে এগুলোর এমন ঝাপটাঝাপটি যে মানুষ নিবেদিত হয়ে কিছু সৃষ্টি করতে পারছে না। সেই কারণেই আজকে পরিসি'তিটা সন'ষ্ট হবার মতো নয়। তারপরেও তো সৃষ্টি থেমে থাকে না। সৃষ্টি তার নিজের গতিতেই এগিয়ে যায়, তার পথ করে নেয়।

শিল্প-সংস্কৃতিও এভাবেই পথ করে নেবে। # ছবি কৃতজ্ঞতা: জাবীদ অপু


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.