আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজনীতির দর্শন ও কর্মসূচি- ২



এটি 'রাজনীতির দর্শন ও কর্মসূচির' দ্বিতীয় কিস্তি । আপনাদের মন্তব্য আশা করছি। রাজনীতির দর্শন ও কর্মসূচি ৩. একটি দলের রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মসূচির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার বা একে প্রত্যাখান করার সম্পূর্ণ অধিকার জনগণের আছে, কিন্তু দর্শন না থাকলে জনগণ সেই দলকে গ্রহণই করে না। যেমনটি ঘটেছে জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রে। নয় বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেও দলটি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

কিন্তু সে প্রসঙ্গে যাবার আগে আরেকটি প্রধান দল বিএনপির কথা বলে নেয়া দরকার। 'বিএনপির জন্ম হয়েছিলো সামরিক শাসকের পকেট থেকে'- বিএনপি-বিরোধী বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিবিদদের মুখে এরকম কথা প্রায়ই শোনা যায়। কথাটি মিথ্যেও নয়। কিন্তু সামরিক শাসকের পকেট থেকে জন্ম নিলে কোনো দলের রাজনীতি করার অধিকার আছে কী না, থাকলে জনগণের কাছে সেই দলটির গ্রহণযোগ্যতা পাবার সম্ভাবনা আছে কী না- এ বিষয়ে তারা কিছু বলতে চান না! বিএনপির বিরুদ্ধে এই সমালোচনা- বলা যায় দূর্বল সমালোচনা- থাকলেও, দলটি যে বিপুল গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- ভোটসংখ্যার দিক থেকে (প্রাপ্ত আসনসংখ্যা নয়, প্রাপ্ত মোট ভোট) আওয়ামী লীগ ও বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা প্রায় সমান সমান।

এরকম গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার কারণটি কি? এর পেছনেও আছে ওই একই জিনিস- দলটির দর্শন ও কর্মসূচি। এই দর্শনের সঙ্গে আপনি সহমত পোষণ না-ও করতে পারেন, দেশের অধিকাংশ প্রগতিশীল মানুষ সেটা করেনও না, কিন্তু তাদের যে একটি দর্শন আছে সেটি এড়িয়ে গেলে বা অস্বীকার করা হলে তাদের গ্রহণযোগ্যতার কারণটি ব্যাখ্যা করা যাবে না। কোন সময়ে এবং কোন প্রেক্ষাপটে দলটির জন্ম হয়েছিলো সেটি মনে রাখলে এই দর্শনের স্বরূপ এবং এরকম একটি দর্শনের গ্রহণযোগ্যতার কারণও বোঝা যাবে। বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড, খুনিদের মাস তিনেকের পৈশাচিক উল্লাস ও কর্মকাণ্ড, সেনা অভু্ত্থান, পাল্টা সেনা অভু্ত্থান, কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে একটি সফল-সর্বাত্নক সিপাহী বিদ্রোহের ভেতর দিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কর্নেল তাহেরের পেছনে জাসদের রাজনৈতিক সমর্থন থাকলেও তাঁর বা জাসদ-নেতৃত্বের যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বলতে কিছু ছিলো না, সেটি জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় টেনে আনার সিদ্ধান্ত থেকেই বোঝা যায়।

কর্নেল তাহের হচ্ছেন বাঙালির ইতিহাসের সেই দুর্লভতম নেতা যিনি- 'দুদিনের মধ্যে বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারি'- ঘোষণা দিয়ে সত্যি সত্যি সেটি ঘটিয়ে দিয়েছিলেনও। তাঁর এই বিপ্লবী ক্ষমতা সম্বন্ধে আর কারো সম্যক উপলব্ধি ছিলো কী না জানা নেই, কিন্তু জিয়াউর রহমানের যে সেই উপলব্ধি ঘটেছিলো সেটি জীবন-রক্ষাকারী বন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর মধ্যে দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন। নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য জিয়ার সামনে এর কোনো বিকল্প খোলা ছিলো না। কেবলমাত্র এবং একমাত্র কর্নেল তাহেরই পারেন আরেকটি বিপ্লব সংঘটিত করে তাঁকে উৎখাত করতে, একথা জিয়া খুব পরিষ্কারভাবেই বুঝে নিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান ছিলেন কঠোর বাস্তববাদী, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ, অন্যদিকে কর্নেল তাহের ছিলেন আবেগপ্রবণ-রোমান্টিক বিপ্লবী।

রোমান্টিসিজম ছাড়া বিপ্লব হয়ও না, সেজন্যই বিপ্লবকে সংহত করার জন্য, তার ফসল ঘরে তুলবার জন্য একটি রাজনৈতিক সংগঠনের দরকার হয়, একা বিপ্লবীর পক্ষে বিপ্লব করে আবার ক্ষমতা সংহত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, তাহেরের মতো এমন একজন বিপ্লবী জন্মেছিলেন অথচ তাঁকে নির্ভর করতে হয়েছিলো জাসদের মতো একটি নপুংসক ও হটকারী রাজনৈতিক দলের ওপর, যার নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খানের মতো একজন আপাদমস্তক বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তি। বস্তুত তাহের হত্যাকাণ্ডের জন্য জিয়াউর রহমানের যতটুকু দায়, সিরাজুল আলম খানের দায় তার সমান (ইতিহাসের এই অজানা অধ্যায়টি নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি হয়নি। ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫-এর প্রথম প্রহরে সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা করার জন্য যিনি প্রথম 'ফায়ার ওপেন' করেছিলেন, সেই নায়েব সুবেদার মাহবুবুর রহমান সমপ্রতি তাঁর লেখা সৈনিকের হাতে কলম বইটিতে এসব অজানা অধ্যায়ের দ্বার উন্মোচন করেছেন। উল্লেখ্য, এই মাহবুবুর রহমানই পরে কর্নেল তাহেরের 'বিচারের' জন্য গঠিত কোর্টমার্শালে রাজসাক্ষী হন সিরাজুল আলম খানের প্ররোচনায়।

জনাব খান নাকি তাঁকে নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন যে, তিনি রাজসাক্ষী হলে কর্ণেল তাহেরকে মুক্ত করা সম্ভব হবে। কিন্তু বিচারের রায়ে কর্ণেল তাহেরের ফাঁসির ঘোষণা শুনে তিনি চিৎকার করে এর প্রতিবাদ করেন। পরে তাঁকে জার্মানিতে নির্বাসনে পাঠানো হয়। )। যাহোক, জিয়া যখন দল গঠন করলেন- তার সামনে আসলে প্রগতিপন্থী কোনো পথ খোলাই ছিলো না।

ওই সময় আওয়ামী লীগের মতো একই আদর্শের কোনো দল গঠন করার যে মানেই হয় না, সেটা তো পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়। আবার কর্নেল তাহেরের হত্যাকাণ্ড জাসদের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাছে জিয়াকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত করে তুলেছিলো, ফলে জাসদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সুযোগই ছিলো না। তাঁর নিজের কোনো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডও ছিলো না, ফলে তাকে একটি ঝুঁকি নিতে হলো এবং প্রগতিবিরোধী সমস্ত শক্তিগুলোকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসার কথা ভাবতে হলো। 'ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি আস্থা, সামাজিক ন্যায় বিচার, গণতন্ত্র, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ' এই চার মূলনীতিকে শুধু দলীয় নয়, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবেই ঘোষণা করলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে অর্জিত রাষ্ট্রীয়-সাংবিধানিক দর্শন 'ধর্মনিরপেক্ষতা' প্রতিস্থাপিত হলো 'ইসলামী মূল্যবোধের ওপর আস্থা' দিয়ে; 'সমাজতন্ত্র' নির্বাসিত হলো তথাকথিত 'সামাজিক ন্যায়বিচারের' কাছে; 'জাতীয়তাবাদ' চেহারা পেলো 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের'।

'গণতন্ত্র' রইলো ঠিকই- ওটা রাখতে হয়, বিশ্বাস না করলেও রাখতে হয়। আর তাছাড়া, সম্ভবত ওই শব্দটির বিকল্প কোনো শব্দ তিনি বা তাঁর পরামর্শকরা খুঁজে পাননি, পেলে সেটিই ব্যবহার করতেন। বোঝাই যাচ্ছে- বিএনপির দর্শনগুলো সর্বতোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের ফসল আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি তথা দর্শনের বিরুদ্ধে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়-সাংবিধানিক মূলনীতিগুলো যে কেবলমাত্র ঘোষণা দিয়ে পরিবর্তন করা যায় না, জনগণের মতামত নিতে হয়- এ কথাটিও তিনি ও তাঁর সহকর্মী-পরামর্শকরা উত্তেজনার বশে ভুলে গেলেন। যখন মনে পড়লো তখন আর ঘোষণাটি ফিরিয়ে নেয়ার মতো বাস্তবতা তাদের ছিলো না, নিলে তাদের অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়তো।

ফলে, পঞ্চম সংশোধনীর সময় যখন এই ঘোষণাকে বৈধতা দেয়ার বিষয়টি সামনে চলে এলো তখন ভুলক্রমে খন্দকার মোশতাক সরকারের এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সমস্ত কার্যক্রমকেও তিনি বৈধ করে দিলেন। একটি ভুল অনেকগুলো ভুলের জন্ম দেয়। নইলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড, জাতীয় চারনেতার হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি জঘন্য অপরাধের দায় জিয়াউর রহমান এবং তাঁর দল বিএনপি যেচে পড়ে নিজের কাঁধে নিতে যাবে কেন? এসব অপরাধের কোনো দায়দায়িত্ব তো তাদের ছিলো না! জিয়াউর রহমান প্রত্যক্ষভাবে এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন- তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধুর হত্যা-পরিকল্পনার বিষয়টি তাঁর গোচরে ছিলো, সেটি তখনকার সমস্ত ঊধর্্বতন সামরিক কর্মকর্তারই গোচরে ছিলো। পরিকল্পনার বিষয়টি জানা সত্ত্বেও, ঘটনাটি ঘটার আগেই, তিনি কেন এইসব খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি এই প্রশ্ন করলে, সেই একই দায়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহকেও দায়ী করা যায়।

তিনি তো সেনাপ্রধান ছিলেন, এবং বিষয়টি তিনিও জানতেন, তিনি কেন তাঁর অধ্বস্তনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি? তাঁর জন্য তো সেটি অনেক সহজ ছিলো! যাহোক, বিএনপি কেন পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এর দায়দায়িত্ব নিয়েছে সেটি একটি জটিল প্রশ্ন। কোনো উন্মাদের পক্ষেও কোনো হত্যাকাণ্ডের দায়দায়িত্ব যেচে পড়ে নিজের কাঁধে নেয়া সম্ভব নয়। নিয়েছে, তারচেয়ে বলা ভালো, নিতে বাধ্য হয়েছে- কারণ, নতুন ধরনের একটি রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়া, তাকে জনগণের কাছে পরিচিত ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য যে প্রজ্ঞার প্রয়োজন, এই দলের নেতাকর্মীদের তা ছিলো না। ছিলো না বলেই তারা তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। অনেকেই হয়তো বলবেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার খাতিরেই মোশতাক সরকারের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়া হয়েছে।

ওই যুক্তিতে সেটা করা হলেও, মোশতাক সরকারের সবকিছুকেই বৈধতা দেয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা তো ছিলো না! বঙ্গবন্ধুর খুনিদেরকে রক্ষার জন্য যে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিলো সেটিকে অবৈধ ঘোষণা করেও তো ওই সরকারকে বৈধতা দেয়া যেত! সেক্ষেত্রে কি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ক্ষণ্ন হতো? হতো না, হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। নিজেদের ভুলত্রুটিগুলোর বৈধতা দিতে গিয়ে অন্যের ভুলত্রুটি-অপরাধ নিজের কাঁধে নেয়ার এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল। যাহোক, আগেই বলা হয়েছে_ সমস্ত প্রগতিবিরোধী শক্তিকে নিজের দিকে টানতে গিয়ে এমন এক দর্শনকে গ্রহণ করতে হয়েছিলো এই দলটিকে যা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বিরোধী। এর কারণ জিয়া এবং তাঁর পরামর্শক-সহকর্মীরা ভেবেছিলেন- যেহেতু আওয়ামী লীগ এই রাষ্ট্রীয় দর্শনের ঘোষণা দিয়েছিলো, এবং স্বাধীনতার পর যেসব দল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ পেয়েছিলো তারাও এই মূলনীতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেনি, অতএব রাষ্ট্রীয় মূলনীতি এবং এইসব দলের দর্শন একই ব্যাপার। এটি ছিলো একটি বিরাট ভুল।

রাষ্ট্রের দর্শন এবং দলের দর্শন যে আলাদা হতে পারে, আলাদা হলেও যে ক্ষমতায় আরোহন করা যায়, এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড চালানো যায়- এটা তারা ভাবেননি, ভাবার মতো দার্শনিক প্রজ্ঞাও তাদের ছিলো না। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে তারা তাই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভারতে বা পাকিস্তানে গত ৬০ বছরেও এমনটি ঘটেনি। আগেও বলেছি, ভারতের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সঙ্গে বিজেপির দলীয় মূলনীতির বড় ধরনের বিরোধ রয়েছে- তারা ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্রীয় বা দলীয় মূলনীতির কোনোটিতেই পরিবর্তন না এনেই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। পাকিস্তানেও এমনটি ঘটেছে।

পিপিপি'র দর্শন রাষ্ট্রীয় দর্শনের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ ছিলো না। কিন্তু দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও তারা রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোতে হাত দেয়নি। বিএনপি যে হাত দিয়েছিলো তার কারণ- তারা বুঝতেই পারেনি, রাষ্ট্র কতোগুলো মৌলিক মূলনীতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, সেগুলো অক্ষুণ্ন রাখাটা রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের অন্যতম শর্ত। জিয়াউর রহমান নিজে তাঁর দলের দর্শনের সঙ্গে একমত ছিলেন বলেও মনে হয় না। বাংলাদেশী জাতীয়বাদের কথা বললেও বাঙালী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ তাঁকে নিতে দেখা যায়নি, বরং অনেকক্ষেত্রেই পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।

ধর্মনিরেপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে সরিয়ে দিলেও তিনি নিজে সামপ্রদায়িক ছিলেন এমন কোনো আচরণ করেননি। বোঝাই যায়_ আওয়ামী বিরোধী সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে একটি জনগোষ্ঠীর সমর্থন পেতে চেয়েছিলেন তিনি, এবং সেটি পেয়েছিলেনও। অচিরেই আওয়ামী বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এবং চিন্তাশীল অংশটিকে আকর্ষণ করতে সক্ষমও হয়েছিলো দলটি। ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী একটি গোষ্ঠী, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে যারা স্রেফ পাকিস্তানের ভাঙন হিসেবে ভাবতো, মুক্তিযুদ্ধ যাদের কাছে কোনো আলাদা মহিমা নিয়ে হাজির হয়নি কখনো, এমনকি স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী ব্যক্তিবর্গ ও গোষ্ঠীসমূহ জড়ো হলো বিএনপির পতাকাতলে। শুধু তাই নয়, বিস্ময়কর হলো_ বামপন্থীদের একটি বিরাট অংশও এলো বিএনপির সঙ্গে।

বিএনপির দর্শন যে কোনোভাবেই তাদের দর্শনের সঙ্গে যায় না, এটা তাদের বিবেচনাতেই এলো না। তারা বরং আওয়ামী বিরোধী সেন্টিমেন্ট এবং ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করার জন্যই গেলেন। কিন্তু এই শ্রেণীর ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোন দলে এলো বা কোন দল থেকে বেরিয়ে গেলো তাতে জনগণের কিছু যায় আসে না। নেতার দল ও আদর্শ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমর্থকরাও সেটি পরিত্যাগ করেন সেটাও বলা যায় না। অতএব, তারা যে বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠী র সমর্থন সঙ্গে করে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন সেটি একেবারেই সত্য নয়।

তাদের কারণে বিএনপি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তা-ও সত্য নয়। তাহলে প্রশ্ন তো ওঠেই যে, বিএনপির দর্শন যদি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হয়ে থাকে তাহলে এত বিপুল জনসমর্থন পেলো কিভাবে? এদেশের ৯৯ ভাগ মানুষই তো মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক, অধিকাংশ লোক সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করেছে, তারা কিভাবে বিএনপির সমর্থকে পরিণত হলো? এর কারণ একাধিক। প্রথমত: দর্শন না থাকলে জনগণ একটি দলকে আদৌ গ্রহণ করে না এটি যেমন সত্যি, তেমনই সত্য হলো এই যে_ একটি দলের দর্শন প্রাথমিক অবস্থায় জনগণের কাছে বিমূর্ত রূপে হাজির হয়। এইসব দার্শনিক কথাবার্তা তাদের কাছে কেতাবি কথাবার্তার অধিক মর্যাদা পায় না বা তাদের বোধগম্যতায় প্রবেশ করে না, এর কোনো প্রত্যক্ষ রূপও তারা দেখতে পায় না। দর্শনগুলো জনগণের কাছে বোধগম্য হতে বা পরিস্ফূট হতে অন্তত ২৫/৩০ বছর সময় লাগে।

বিএনপির দর্শনগুলো এখন পর্যন্ত জনগণের কাছে ধোঁয়াটে রূপে অবস্থান করছে। 'ইসলামী মূল্যবোধের ওপর আস্থা' না হয় বোঝা যায়, 'গণতন্ত্র' ব্যাপারটা বোঝা না গেলেও এর সঙ্গে নির্বাচন ইত্যাদি জড়িত সেটুকু অনুভব করা যায়, কিন্তু 'সামাজিক ন্যায়বিচার' কি জিনিস? জনগণ মোটাদাগেও হলেও সমাজতন্ত্র ব্যাপারটা বোঝে, কিন্তু 'সামাজিক ন্যায়বিচার' বিষয়টি বিএনপির কর্মী-সমর্থক তো দূরের কথা, স্বয়ং নেতারা বোঝেন কীনা সন্দেহ আছে। সম্ভবত বিএনপি-পন্থী বুদ্ধিজীবীরাও বোঝেন না। এমনকি দলটি গত ৩০ বছরে এর কোনো প্রত্যক্ষ রূপ প্রদর্শন করতেও ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশী জাতীয়াবাদও বিতর্কের বেড়াজাল কেটে বের হতে পারেনি।

জিয়াউর রহমানের লেখালেখি-বক্তৃতা ইত্যাদি থেকে মনে হয় জাতীয়তাবাদ বলতে তিনি ভৌগলিক পরিচয় অর্থাৎ নাগরিকত্বকে বুঝিয়েছেন। অন্যদিকে এর সমালোচকরা একে পাকিস্তানপন্থী মুসলিম জাতীয়তাবাদের সমার্থক বলে উল্লেখ করে থাকেন। বিষয়টি আসলে কী, সেটা এখন পর্যন্ত জনগণ বুঝেই উঠতে পারেনি। (এমনই আরেকটি না-বোঝা বা ভুল-বোঝা শব্দ 'ধর্মনিরপেক্ষতা'। ইসলামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা বলে প্রচার করে মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করেছেন।

এই প্রচার যে আদৌ সত্য নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে যে ধর্মহীনতা নয়_ সেটি জনগণকে বোঝাতেও নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে এর পক্ষের শক্তি। ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকবে, কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাত দেখাবে না- মোটাদাগে এই হলো ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ, এটুকু বুঝিয়ে বলা গেলেও বিরুদ্ধবাদীরা অপপ্রচারে জয়ী হতে পারতো না। ) অতএব বলা যায়, প্রাথমিক অবস্থায় বিএনপির দর্শনগুলো সাধারণ মানুষের কাছে দলটির গ্রহণযোগ্যতা তৈরির ব্যাপারে বড় কোনো ভূমিকা বা প্রভাব রাখতে পারেনি। বরং এই গ্রহণযোগ্যতা সীমাবদ্ধ ছিলো আওয়ামী-বিরোধী শিক্ষিত-সচেতন-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে। তবে মোটাদাগে এই দলটি যে দার্শনিকভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধী সেটি বুঝিয়ে দিয়েছিলো ওই দর্শনগুলোই।

আর তাই, স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় আসীন দলটির সীমাহীন ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ জনগণ প্রাথমিকভাবে বিএনপিকে গ্রহণ করেছিলো। সিপাহী বিদ্রোহের পর জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় না এনে জাসদ যদি নিজেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতো, জনগণ সেটিও একইভাবে গ্রহণ করতো ওই আওয়ামী লীগের প্রতি বিরক্তি এবং ক্ষোভ থেকেই। তবে যে কথাটি না বললেই নয় সেটি হলো, বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার পেছনে মূল চালিকাশক্তি এবং দ্বিতীয় কারণ হিসেবে কাজ করেছে দলটির কর্মসূচি। আগেও বলেছি_ শুধু দর্শন দিয়ে জনগণের কাছে পৌঁছানো যায় না, পৌঁছাতে হয় কর্মসূচি দিয়েও। জিয়াউর রহমানের অসংখ্য ত্রুটি যেমন ছিলো, তেমনি দুর্লভ কিছু গুণও ছিলো।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই প্রথম রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা এনেছিলেন, জনগণকে সরকারী কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ন করে তাদের মধ্যে উদ্দীপনা জাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন, অভিনব সব কর্মসূচির উদ্ভাবন করে চমক সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিশেষ করে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন-ব্যবস্থাপনা-ব্যবহার ও বাজারজাতকরণে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে জনগণের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের গত '৩৭ বছরের ইতিহাসে আর কোনো রাষ্ট্রনায়ক সশরীরে জনগণের এত কাছাকাছি যেতে সক্ষম হননি। কৃষকের কাঁধে বন্ধুর মতো হাত রেখে বৃক্ষ রোপণ, মৎস চাষ, অধিক ফসল উৎপাদনের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করার দুর্লভ দৃশ্য তিনিই এদেশের রাজনীতিতে প্রবর্তন করেছিলেন। অবশ্য এরশাদও জনগণের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাঁর কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা ছিলো না বলেই এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

তাঁর চেষ্টাটিকে জনগণ বিবেচনা করেছে জিয়ার অনুকরণ হিসেবে, কিন্তু জিয়ার সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে মানুষের মনে কোনো প্রশ্ন ছিলো না, এরশাদের ব্যাপারে তা প্রবলভাবেই ছিলো। জিয়ার ব্যক্তিচরিত্রের এই দৃঢ়তা, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বীরোচিত ভূমিকা, জনগণের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টির ক্ষমতা এবং তাদেরকে ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্ন দেখাবার প্রবণতাও বিএনপিকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। যাহোক, তাঁর শাসনামল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, ক্ষমতাও তাঁর জন্য স্বস্তিকর হয়নি। শক্তিশালী বিরোধী দল তখন ছিলো না বটে_ তাঁকে তাই বিরাট কোনো রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়নি_ কিন্তু সামরিক বাহিনীর মধ্যে ঘটে যাওয়া অসংখ্য বিদ্রোহ তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিলো, এবং এগুলো তাঁকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে হয়েছে। বিদ্রোহ দমনে যে নির্মমতার পরিচয় তিনি দিয়েছেন সেটি যে কোনো কল্প-কাহিনীকেও হার মানাবে।

একটি সর্বক্ষণিক অস্থিতিশীলতায় তাঁর সরকার টলমল করেছে যদিও অভ্যন্তরিণ এইসব বিদ্রোহ বাইরে তেমন একটা প্রকাশিত হয়নি। বরং জাতীয় জীবনে একটি আপাত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিলো। তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সেটিকে নষ্ট করে দেয়। জিয়ার জীবদ্দশায় বিএনপি কোনো রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করে উঠতে পারেনি, কোনো শক্তিশালী ভিত এবং সাংগাঠনিক কাঠামোও তৈরি করতে পারেনি। ক্ষমতার মধ্যে জন্ম নেয়া কোনো দলের পক্ষে সেটি কঠিনও বটে।

ফলে এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর এই দলের ছোটবড় নেতারা ঝাঁকের কৈ-এর মতো নতুন সামরিক শাসকের পদতলে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। বিএনপির দর্শন নয়, ক্ষমতা এবং কেবলমাত্র ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করার জন্যই যে এরা জিয়ার সঙ্গে ভিড়েছিলেন সেটিও এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়ে যায়। আর ওই সময়টিই ছিলো বিএনপির জন্য এক অগি্নপরীক্ষার কাল। দলটির বৃহত্তম অংশ এরশাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার পরও বিএনপি আদৌ টিকে থাকবে কী না তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ঠ কারণ ছিলো। দলে রয়ে যাওয়া ক্ষুদ্র অংশটি তাই গৃহবধু খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বা দূরদর্শিতা ছিলো এমন কোনো প্রমাণ তিনি দেখাতে না পারলেও ব্যক্তিগত আবেগে তাড়িত হয়েই হয়তো তিনি এরশাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এর দুটো কারণ ছিলো। প্রথমটি_ এরশাদই বিএনপিকে ক্ষমতাচু্যত করেছিলেন, দ্বিতীয়টি_ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জিয়া হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এরশাদের সংশ্লিষ্টতা ছিলো। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে প্রকাশ্য জনসভায় তিনি এরশাদকে জিয়া হত্যার জন্য অভিযুক্তও করেছিলেন। এরশাদ প্রশ্নে তাঁর এই আপোসহীন অবস্থানটি ব্যক্তিগত আবেগ থেকে উদ্ভুত হলেও জনগণের কাছে সেটি পরিষ্কার না হওয়ার তিনি পরিণত হন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের আস্থা ও আপোসহীনতার প্রতীকে।

আর বিএনপি পায় আপোসহীন দলের ইমেজ। আর এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই বিএনপি রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করে এবং রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। বলা প্রয়োজন, সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী ওই আন্দোলনটির সঙ্গে জনগণের, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্ত জনগণের সম্পর্কটি ছিলো আবেগতাড়িত- আর এ কথা তো সবাই জানেন ও মানেন যে, এ দেশের সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্রে সবসময়ই অবস্থান করেছে মধ্যবিত্তরা। বিএনপি সেই আবেগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হয়েছিলো। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে দলটির শীর্ষ নেত্রীর বিরুদ্ধে আন্দোলনের নানা পর্যায়ে এরশাদ সরকারের সঙ্গে আঁতাত ও আপোসের অভিযোগ ওঠে এবং দলটি এই অভিযোগের সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হয়।

বরং '৮৬-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ এই অভিযোগের তীব্রতাকে বাড়িয়ে দেয়। এমন একটি আত্নঘাতি সিদ্ধান্ত দলটি কেন নিয়েছিলো সেটি এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। শুধু তাই নয়, এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার আগ বাড়িয়ে 'আমি অখুশি নই' জাতীয় মন্তব্য জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। এরশাদের সঙ্গে লং ড্রাইভে গিয়ে আন্দোলনকে ছুরিকাঘাত করার অভিযোগও তাঁর ও দলের জন্য বিব্রতকর অবস্থার তৈরি করে (অভিযোগটি আবার তুলেছিলেন এরশাদ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি ডিগবাজি-বিশারদ মওদুদ আহমদ!)। এসবের প্রতিফলন দেখা যায় '৯১-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।

ওই নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে_ এ কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। কারণ, তিনশ' আসনে প্রার্থী দেবার মতো যোগ্য লোকও তাদের ছিলো না। সাংগাঠনিক অবস্থাও ছিলো করুণ। গ্রাম পর্যায়ে তো দূরের কথা, থানা পর্যায়ে_ এমনকি কোনো কোনো জেলায়ও তাদের সাংগাঠনিক কর্মকাণ্ড ছিলো না। অন্যদিকে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ এমন আচরণ শুরু করে যেন তারা ক্ষমতায় এসেই পড়েছে! 'বিএনপি ১০টির বেশি আসন পাবেনা' আওয়ামী-নেত্রীর এই জাতীয় মন্তব্য, নির্বাচনের দু-তিনদিন আগে জাতির উদ্দেশ্যে বেতার-টেলিভিশন ভাষণে জিয়া ও এরশাদকে এক কাতারে ফেলে তীব্র সমালোচনা করার মধ্যে দিয়ে সেইসব আচরণ প্রকাশিত করেছিলো।

সাংগাঠনিক দিক দিয়েও আওয়ামী লীগ ছিলো শত মাইল এগিয়ে। যোগ্য-অভিজ্ঞ প্রার্থীর অভাবও তাদের হয়নি_ তবু নির্বাচনে জয়লাভ করলো বিএনপি। এটি ছিলো স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির ভূমিকার প্রতি জনগণের আস্থার প্রতিফলন এবং আওয়ামী লীগের প্রতি অনাস্থার জবাব। এ ঘটনা থেকেও বোঝা যায়_ জনগণের মনমতো কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে গেলে জনগণ তার পুরস্কার দেয়। '৬০ দশকে আওয়ামী লীগ যেমন বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতিটি আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বুকে ধারণ করে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় জনগণকে জাগ্রত করে আন্দোলনকে একটি গণঅভু্যত্থানের দিকে নিয়ে গিয়েছিলো এবং এর পুরস্কার পেয়েছিলো '৭০-এর নির্বাচনে, ঠিক ওই মাত্রার না হলেও '৮০-এর দশকে বিএনপির আপোসহীন ইমেজ ও কর্মকাণ্ড দলটিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছিলো।

৪. এতক্ষণ ধরে যা যা বলা হলো তাতে মনে হতে পারে- রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি বলতে শুধুমাত্র আন্দোলন-সংগ্রামকেই বোঝায়, এবং এই ধরনের কর্মসূচি দিলেই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়! বিষয়টি আদৌ সেরকম নয়। মূল বিষয় হচ্ছে- রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই হোক বা ক্ষমতার বাইরে থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম-দাবিদাওয়া আদায়ের ব্যাপারেই হোক, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন-প্রত্যাশা ইত্যাদি উপলব্ধি করে কর্মসূচি নির্ধারণ করলেই কেবল গ্রহণযোগ্যতা মেলে। আন্দোলনের প্রশ্নে, আন্দোলনটি কার বিরুদ্ধে করা হচ্ছে, কেন করা হচ্ছে, এর ফলাফল কী, আন্দোলনরত দলটি ক্ষমতায় গেলে জনগণের কল্যাণে কী কী কর্মসূচি গ্রহণ করবে- সেই বিষয়গুলো জনগণ অবশ্যই বিবেচনায় রাখে। আওয়ামী লীগের জন্মের পর থেকে অন্তত এক যুগের মধ্যে দলটির তেমন কোনো প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে ছিলো না। '৬০-এর দশকে সেটি তারা অর্জন করে নেয় মূলত ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে।

'৬৯-এর গণঅভূ্যত্থান এবং '৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব জয়লাভের মূলভিত্তিও ছিলো ওই ছয় দফা কর্মসূচি। সবাই জানেন যে, এই ছয় দফায় ছিলো পূর্ণমাত্রার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি বা প্রস্তাব। কেতাবি ভাষায় এই দাবিগুলো লিখিত হলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সহজ ভাষায় জনগণকে একথা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ছয় দফা বাস্তবায়িত হলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের রাজনৈতিক নিপীড়ন থেকে যেমন মুক্তি মিলবে, তেমনি নিজেদের সম্পদ নিজ দেশে রেখে তার সর্বোত্তম ব্যবহার করে উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনা করা যাবে যার ফলে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হবে। জনগণ চায়ও ওই দুটো জিনিসই- আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা এবং জীবন-যাপনে অবাধ স্বাধীনতা। '৭০-এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে সক্ষম হলে, এই কর্মসূচি আদৌ বাস্তবায়ন করতে পারতো কী না সেটি নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

অর্থাৎ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আদৌ তা বাস্তবায়ন করতে দিতো কী না সেটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা চলে। কিন্তু যেহেতু তারা ক্ষমতায় যেতে পারেনি, তাদের বিরুদ্ধে তাই ব্যর্থতার অভিযোগ বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ তোলাও অবান্তর বলে মনে হয়েছে জনগণের কাছে। আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের সমর্থন ও আস্থা তাই অব্যাহতই ছিলো। ফলে, যুদ্ধ শুরু হলে দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মেনে নিতে আপত্তি করেনি, যদিও তখন আরও অনেকগুলো দল সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মওলানা ভাসানীর মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতাও উপস্থিত ছিলেন। এমনকি যুদ্ধের পর সদ্য-স্বাধীন দেশে এককভাবে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের অধিকার আছে কী না সেটি নিয়েও কেউ প্রশ্ন তোলেনি।

দেশ স্বাধীন হবার পরে পাকিস্তান আমলের নির্বাচনী ফলাফল তো বাতিলই হয়ে যাবার কথা, সেক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও নির্বাচনে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ তো নিজেদেরকে নির্বাচিত সরকার দাবি করতে পারে না! আওয়ামী লীগের সরকার '৭৩-এর জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তা ছিলোও না, ছিলো বিপ্লবী সরকার। কিন্তু বিপ্লবী সরকারই বা কেন একদলীয় হবে_ যুদ্ধ তো তারা একা করেনি, এই প্রশ্নও কেউ উত্থাপন করেনি। এসবই ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা এবং আওয়ামী লীগের প্রশ্নাতীত গ্রহণযোগ্যতার জন্য। ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং জনগণ তাদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো। যদিও বঙ্গবন্ধুর কোনো বিকল্প ছিলো না, কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

জনগণ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বেদনায়, স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কাতরাতে থাকে। অন্যদিকে বিএনপির জন্মই ক্ষমতা কাঠামোর ভেতর থেকে, ফলে ক্ষমতায় যাওয়ার আগে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়নি তাদের, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের প্রশ্নও ওঠেনি তাই। তাছাড়া বিএনপির সরকার তুলনামূলকভাবে আওয়ামী লীগের চেয়ে সফল সরকার বলেই বিবেচিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ অল্পতেই খুশি হয় বলে এই সফলতাকেই বিপুলভাবে সম্বর্ধিত করেছিলো। যাহোক_ কর্মসূচি যেমনই হোক না কেন জনগণ সেগুলোর মধ্যে নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে চায়, তাদের সংকট-সমস্যার সমাধান দেখতে চায়।

সেটা পেলে সেই কর্মসূচিকে তারা সমর্থন করে, নিজেরা তাতে অংশগ্রহণও করে। আর জনকল্যাণমুখী কর্মসূচির গুরুত্বই এখানে। (চলবে...)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.