আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সোহেল হাসান গালিব কর্তৃক সম্পাদিত শূন্য দশকের কবিতা সংকলনের ভূমিকা

কবি

'' বাংলায়ন'' প্রকাশনী থেকে সোহেল হাসান গালিবের সম্পাদনায় শূন্য দশকের একটি কবিতা সংকলন বের হয়েছে। শূন্য দশকের ১১৯ জন কবির কবিতা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে সংকলনটি। সেই ভূমিকাটিই এখানে প্রকাশ করা হলো। এই সংকলন নিয়ে মেলায় বিস্তর হৈ হাট্টা হয়েছে শুনেছি। সকলের সাথে শেয়ার করলাম ভূমিকাটি।

ভূমিকা একটি শতাব্দীর শুরু হলো। পেরিয়ে এলাম তার প্রায় একটি দশক। তবু এখনই সময় নয় পিছনে ফিরে তাকাবার। তারপরও বিচার করে দেখা যেতে পারে নিজেদের হালহকিকত। আধুনিক কালপর্বে এসে আর কিছু না হোক, অন্তত পশ্চিমের একটা শিক্ষা বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলাম আমরা।

এ হলো তার বিভাজন-নীতি। জগদ্ব্যাপার খণ্ড, ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন করে দেখা। সে বিচ্ছিন্নতা এতদূর প্রসারিত যে, কখনোবা মূলের সঙ্গে শাখা সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে। তখন মূল ও শাখা উভয়েই দাবি করে বসে বৃরে উপর কর্তৃত্বের। এই কর্তৃত্বের ফয়সালায় পশ্চিমি ভাব-বলয়ের মধ্যে অনিবার্যভাবে আজ দানা বেঁধে উঠেছে এক বুদ্ধিবৃত্তিক হাঙ্গামা।

তাদের ভেতরকার সেই দাঙ্গার নামই উত্তরাধুনিকতা, বললে অত্যুক্তি হবে না। অথচ আমাদের এই ভূখণ্ডে ছিলো খণ্ডকে অখণ্ডে, ক্ষুদ্রকে বৃহতে, সীমাকে অসীমে টেনে নেবার প্রয়াস। ছিলো একের অনলে বহুকে আহুতি দেবার মন্ত্র। অর্থাৎ সমন্বয় ও সংশ্লেষের সাধনা। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের লড়াই তাই ঐতিহাসিকভাবে নির্ণীত।

এ কারণে, পশ্চিমের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও, আধুনিকতার পরিমণ্ডলে পুরোপুরি প্রবেশ না করেই, উত্তরাধুনিকতার প্রশ্নে ও মীমাংসায় আলোড়িত বিলোড়িত হয়ে চলেছি। আর সে কারণেই, এই বিশ্বভূগোলের একেক এলাকায় উত্তরাধুনিকতার এত পাঠ, পাঠান্তর। কিন্তু আধুনিকতাবাদের সার্বজনীনতা নামক ভণ্ডামি, আন্তর্জাতিকতার আড়ালে আগ্রাসনের পাঁয়তারা ও ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রে উৎপাদিত ধর্মনিরপে উদার মানবিকতার ছদ্মাবরণে উত্তর-ঔপনিবেশিক কালের সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম, সর্বোপরি ব্যক্তি-বিচ্ছিন্নতার আঁচড় কিছু মাত্রায় হলেও আমাদের উপর এসে পড়েছে। জ্ঞান ও শ্রমের বিভাজন তাই বাস্তবতা। নগরও ক্রমবর্ধমান।

শিল্পায়ন হয়তো বেঁচে থাকারই তাগিদ। আজ অরণ্যের জন্যে, নদীর উচ্ছল স্রোতের জন্যে, স্বভাবত হাহাকার করা যেতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্মৃতি-কাতরতাই সত্য। কেননা, সম্ভব নয় অরণ্যে ফিরে যাওয়া, পর্ণকুটিরে প্রিয়ার বাহুপাশে রাত্রির প্রয়াণ। অথবা অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে তার চারপাশে যৌথ পরিবারের মায়ানাচ।

স্বাতন্ত্র্যের অন্বেষণে, কিছুদূর অগ্রসর হয়ে আমাদেরও মেনে নিতে হলো বিভাজন, দশকের দায়। এই ছোট্ট পরিসর। খণ্ডাকাশ। যাত্রা শুরু হয়েছিলো যার গত শতকের তিরিশে। আজ তিরিশের দশক বললেই একগুচ্ছ নাম চলে আসে আমাদের সামনে।

এটাই এর বড়ো প্রাপ্তি। কিন্তু ‘তিরিশের কবি’ উপাধি বুদ্ধদেব বসুকে, কবিতায়, বাঁচাতে পারলো কই ! আর প্রতিভাবান বালক ব’লে দূরে ঠেলে দেয়া, দশক-পরিচয়হীন, গোত্রশূন্য কবি নজরুলকে মহাকাল সত্যিই ছুড়ে ফেলেছে কিনা এই প্রশ্নে বড়োই দ্বিধান্বিত আমি। কবিতার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু গানগুলো ? ওগুলো তো কবিতাই। আর ওসব কি মুছে গেছে আমাদের মন থেকে ! আমাদের সময়ের তিনশোর অধিক কবিনামের তালিকা থেকে একশ উনিশ জন কবিকে নির্বাচন করা হয়েছে এ গ্রন্থে। এরও মধ্যে ঝরে যাবে ষাট জন কবি, বিশ জন মারা পড়বে জীবিকার চাপে, দশ জন লিখে যাবে ধুঁকে ধুঁকে, পাঁচ জন লাপাত্তা হবেজ্জএমন ভাবা অন্যায়, নৃশংস ; তবু অমূলক হয়তো নয়।

নানা যুক্তি, সীমাবদ্ধতা ও বিচারের মানদণ্ডে যারা রয়ে গেলেন এ সংকলনের বাইরে, তাদের মধ্যে দুএকজন সবাইকে তাক লাগিয়ে দশকের শ্রেষ্ঠ কবির তালিকায় উঠে আসবেন। এ শুধু প্রত্যাশা নয়, বিশ্বাস। সেই সঙ্গে সম্পাদকীয় শঙ্কাও বটে। ইতিহাস তেমনই বলে। তাহলে দশক শেষ না হতেই কেন এই সংকলন ? উত্তর : এই কারণেই।

আরেকটি নিখুঁত সংকলনের কাজকে কিছুদূর এগিয়ে আনা হলো। এরপর শূন্যের সংকলন হতে পারে দুধরনের। এ দশকে যারা লিখলেন, তাদেরকে নিয়ে একটি বড়ো এন্থলজি। অথবা যারা টিকলেন, তাদের নিয়ে সুনির্বাচিত, ন্যায়নিষ্ঠানির্মম সংগ্রহ। এ দুয়ের মধ্যস্থতা করবে আমাদের এই গ্রন্থটি।

নব্বইয়ের দশকের অভিজ্ঞতা স্মরণে রেখে যে কোনো সংকলক কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করবেন আশা করি। এ দশকে যারা ২০০৭ সালে লেখালেখিতে স্বেচ্ছাসমর্পিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন, তাদের উচিত হবে আত্মগোপন করে পরবর্তী দশকে নিজের আসন খুঁজে নেয়া। এ উপদেশ নয়, গেরিলা-পরামর্শমাত্র। গ্রন্থটির নাম দেয়া হয়েছে 'শূন্যের কবিতা'। প্রথম দশকের কবিতাও বলা যেতো।

যেমন তিরিশের দশক না বলে, বলা যায় চতুর্থ দশক। অন্তত গাণিতিক হিশেব তাই বলে। কিন্তু ভেবে দেখলাম, শূন্যের বাজার-চলতি পরিচয়টা বেশি। আবার ভারতীয় জ্ঞানতাপসদের প্রত্মযুগের ইশারাও এতে মিলবে। 'যৈবতী কন্যার মন' নাটকে শোনা 'এই আমারে দেখ, আমার কিছু নাই, আমি শূন্যে ভাসমানজ্জগঠিত হই তখনই মিলাই' কথাটাও দেখি বিঁধে রয়েছে কানে।

সত্যিই তো, শূন্য হতেই জগতের আকার পাওয়া, শূন্যেই নিরাকৃতি লাভ। জন্মের আগের কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের নেই, নেই মৃত্যুর পরের কোনো অভিজ্ঞান। শুধু বস্তু নয়, ভাবের বেলাতেও তাই। যাই হোক, একটা নামকরণের পিছনে এত বাগাড়ম্বর করে যে ভাবমূর্তি খাড়া করাবার চেষ্টা, তা আশলেই হাস্যকর। তারপরও কথাগুলো বললাম, মনে এলো বলে।

কারণ রঘুপতি জয়সিংহকে বলেছিলো, 'এরা চোখে চাহে দেখিবারে, চোখে যাহা দেখিবার নয়। মিথ্যা দিয়ে সত্যেরে বোঝাতে হয় তাই। ' আমাদের সময়ের কবিতার লণ কীজ্জএ নিয়ে মৌখিক আলাপ মোটামুটি আমরা অনেকেই সেরে নিয়েছি ইতোমধ্যে। একেবারে পাল্টাপাল্টি কথাবার্তাও শোনা গিয়েছে। কেউ বলেছেন ছন্দ, মিল -- এসব ফিরিয়ে আনা।

কেউ বলেছেন ওসব ঝেঁটিয়ে বিদায় করা। কেউ আবার আখ্যান নির্মাণের কথা বলেন। কেউ আখ্যানহীনতার কথা। কারো ঝোঁক নিতান্তই ঐতিহ্য, মিথ আর দর্শনের দিকে। কারো চপলতা শুধু চিত্রকল্পে।

আমাকে যদি বলা হতো, আপনি রায় দিন তবে। সেক্ষেত্রে সত্যিই ভড়কে যেতাম, সটকে পড়তাম। কিন্তু এ মুহূর্তে ও-সবের উপায় কি আর থাকলো ! তাই বিনীতভাবেই বলছি, আমার বিবেচনায়, শূন্যের কবিতার ঝোঁক আশলে ছন্দহীনতার দিকে। কথাটাকে একটু ব্যাখ্যা করেই বলি। বহুকাল আমরা কবিতাকে উপযোগিতার বাহন না ভাবলেও নানা ছলে শেষ পর্যন্ত ও-কাজটি করিয়ে নিয়েছি তাকে দিয়ে।

আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের শ্রেয়োবোধ ও সৌন্দর্যবোধের সীমাতেই তার আস্ফালনটুকু হোক। লোকশিক্ষা নয়, তবে লোকশিক্ষার সমান্তরাল ; দর্শন নয়, তবে দর্শনের দূতিয়াল ; কল্যাণ নয় তবে কল্যাণের কর্মকারজ্জএ জাতীয় কিছু। খুব খেয়াল রাখা হতো কল্পনা যেন সচেতনতাকে অতিক্রম না করে। এ কালে কবিতা, কবির বক্তব্য পেশ করবার শেষ সুযোগটিও খারিজ করে দিতে চায়। সচেতন মন অপো অবচেতনের দিকে তার কৌতূহল।

তাই কবিতা মূলত সংবেদনের উপর চাপ ফেলেই দায়িত্ব তুলে নেয়। তার ফলে হয়তো বেরিয়ে পড়ে কবির আঁতের খবর। ওতেই ধরা পড়ে সমাজমানস। কবি কখনোবা নিজেই দাঁড়িয়ে যান নিজের বিরুদ্ধে। আধুনিকতার contradiction ও inconsistancy-কে আরো দূরপ্রসারিত করে দিগন্তের বাতাস যেন বলে ওঠে : কবিতা হোক স্বয়ম্ভূ, কবির বিট্রেয়ার।

স্বীকার্য যে, এই প্রবণতা পূর্ববর্তী বাংলা কবিতায় দুর্নির্যী নয়। বিদেশি কবিতায় তো নয়ই। ২ আমাদের কালে দেখাকে ভাবনা আর অনুসরণ করতে পারছে না বোধ হয়। 'চিন্তার জাল আমি গুটিয়ে নিয়েছি / দৃষ্টির জালখানি রৌদ্রে শুকায়। ' বিষয় ও অনুষঙ্গের স্তূপে আমরা নিজেরাই হয়ে পড়েছি নিষ্ক্রিয় প্রসঙ্গ।

উত্তাল ঢেউয়ের থাবায় পড়ে যে দশা হয়, এমনকি দ সাঁতারুর। খবরের কাগজে চোখ বুলাতেই : আজ পয়লা আষাঢ়। হরিরামপুরে গৃহবধূ গণধর্ষণের শিকার। ইরাকে বোমাবর্ষণ। দুই উইকেটে জিতলো বাংলাদেশ।

কিংবা ধরা যাক ট্রেনে চলেছি আমরা। জানালার ছোটো দৃশ্যপটে ভেসে উঠছে, মুহূর্তে মিলিয়ে যাচ্ছে নানা বস্তু, সকলই গতিশীল। দেখি, গরুচরা মাঠ, কলাপাতায় বসে থাকা শালিক, বদনা হাতে হেঁটে যাওয়া বুড়ো, স্কুলপালিয়ে আখখেতের ধারে উটকো এক লোকের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকা নীল কামিজ। ট্রেনের ভেতর থেকে অপুদুর্গাকেও দেখা যেতে পারে। তাদের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ও বিস্ময় যদিও নেই আর।

এ তো গ্যালো প্যানোরামা। কবি মাসুদ খান যাকে বলেন, সার্কারামা, সে তো আরও ভয়ঙ্কর। তখন চারপাশে দ্রুত বদলে, ছুটে যেতে থাকে দৃশ্যসব। অনন্ত গতির সুষমায় জেগে উঠে দেখি, কেবলই দৃশ্যের জন্ম যেন। টেলিভিশনের কথাই ধরা যাক।

স্যাটেলাইট চ্যানেলের মারফত এই খেলাটা বেশ জমে। এখানে ফ্যাশান টিভি ও ইসলামিক টিভি একসাথে হাজির। একই সঙ্গে পর্ণোগ্রাফি ও প্রার্থনা। এম টিভির চিৎকার ও শীৎকারের সঙ্গে পালা দিচ্ছেন বেলুর মঠে স্বামী বিবেকানন্দ। একদিকে জুরাসিক পার্ক, আনাকোন্ডা।

অন্যদিকে গহিন অরণ্যের সবুজ পাতায় পিঁপড়ের চলাচল। এসেছে হ্যারি পটার, উড়ে যাচ্ছে স্পাইডারম্যান। কোথাও শোকের মাতম, মৃতের জন্যে কান্না, হৈ চৈ। কোথাও শান্ত গৃহশয্যা ; ভোরের রোদ এসে পড়েছে সংগমকান্ত নগ্নিকার স্তনের উপর ; একটি প্রজাপতি তার উপর বসবে কি বসবে নাজ্জএই দ্বিধা। প্রতিটি ইমেজই একেকটি গল্প।

আলাদাভাবে গল্প বলার কী দরকার তবে ! সিদ্ধান্তের দায় কার, শুধু এই দেখাগুলো তুলে ধরা ছাড়া। বয়ে বেড়াবার ঠেকাইবা কী ! তাই ফেলে রেখে যাওয়া। জীবনের দাবি এর বেশি কিছু করতে দিতে চায় না আজ। এসবের কম্পোজিশনই কবিতা। কিংবা কোলাজও বলা যেতে পারে।

কেউ কেউ বলেন ব্রিকোলাইজেশন। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, কবিতার কোনো ইউনিফায়েড রূপই খুঁজে পাওয়া মুশকিল এখন। কবিতা হয়ে পড়েছে অনেক বেশি ফ্র্যাগমেন্টেড। পাঠক তাই অবিষ্কার করবেন চূর্ণ আখ্যান, চূর্ণ মিথ, চূর্ণ দর্শন, চূর্ণ চিত্রজ্জসর্বপ্লাবী এক লীলাচূর্ণ। পাঠক নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন, ছন্দহীনতা বলতে সার্বিকভাবে হীনতা ও দীনতার উদ্ভাসকেও আমি বোঝাতে চাইছি।

'আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা' --এই চিত্তনির্ঘোষের আড়ালে যে অন্ধ উন্মাদ লুকিয়ে থাকে, 'আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন' বলে যে চলে যায় গভীর নির্জন পথে, আমি তারও কথা বলছি। তবে পরিতাপের বিষয়, যে দতা ও পারঙ্গমতা দিয়ে প্রথা ও প্রতীতিকে খারিজ করতে হয়, তার ন্যূনতম শর্তপূরণ সবার ক্ষেত্রে হয়েছে, তা বলা যাচ্ছে না। একজন কবির নিজস্ব ছন্দোজ্ঞান, ভাষাবোধ ও শব্দকোষ পুষ্টি লাভ না করতেই তাদের নিয়ে কসরত করার আকাক্সা জেগেছে। এ যেন সাইকেল চালাতে না শিখেই সার্কাসের মঞ্চে সাইকেল নিয়ে হাজির হওয়া। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে গদারের ছবির কথা।

পশ্চিমের চলচ্চিত্র পর্যালোচনা করতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় এক জায়গায় বলছেন, 'বিদেশের অনেক পরিচালকই আজকাল গোদারের মত আধুনিক জীবনের সমস্যা নিয়ে ছবি তুলছে, কিন্তু দুঃখের বিষয়, এরা প্রায় সকলেই গোদারের অন্ধ অনুকরণ করছে। এদের না আছে গোদারের পাণ্ডিত্য, না আছে তার wit, না আছে চলচ্চিত্রের কনভেশন সম্পর্কে ধারণা। শেষোক্ত গুণটি প্রয়োজন এই কারণেই যে, শিল্পে যদি কোনো নিয়ম ভাঙতে হয়, তাহলে সে নিয়ম সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা, এবং পুরনোর জায়গায় নতুন কী নিয়ম প্রয়োগ করতে হবে সে সম্বন্ধেও একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। ' যদি ছন্দ-কবিতা নাই লিখবো, তো ছন্দ শেখার দরকার কীজ্জএমন একটা প্রশ্ন বিভিন্ন আড্ডায় উত্থাপিত হয়। বাংলা ব্যাকরণের মর্মে প্রবেশ করতে হলে কেন সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ জানতে হবেজ্জপ্রশ্নটা অনেকটা সে-রকমের।

পান্তরে, এটা কী সম্ভব, আমরা বাংলা ভাষায় লিখবো, অথচ বাংলা কথ্যভঙ্গি রপ্ত করবো না। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পার্থক্য তো এখানেই এবং এই কারণেই। এও মনে রাখতে হবে, কথ্যরীতিকেও ভেঙে ফেলতে হয় একসময়। সেই নির্মাণ হয়তো তখনই উইলিয়াম কেরির গবেষণারও অনধিগম্য হয়ে পড়ে। এবং সেটিই সাহিত্যের ভাষা, লোকমুখের ভাষা নয়।

আবহমান কাল ধরে একটি ভাষায় যে-কটি ছন্দ চর্চিত হয়ে এসেছে, বুঝতে হবে, ঐ ভাষার প্রাণের স্পন্দন ও বিকাশ তাতেই নিহিত। বাংলা শব্দ অধিকাংশ কত সিলেবলের বা কয় আরিক, তা আবিষ্কার, শুধু ঐ ভাষার বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে না, একই সঙ্গে ঐ ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের অভিঘাতও নির্ণয় করে। কবি হচ্ছেন একজন ঘোড়সওয়ার, ভাষারোহী। ভাষাকে বাগে আনা ও তাকে নিজের নির্দেশ মতো পরিচালনা করাই তার প্রাথমিক সিদ্ধি। গন্তব্য তো পরের বিবেচনা।

অনেক দুঃখ ও দহন, কুশ ও কণ্টক পেরিয়ে যেতে হবে হাসি মুখে। তাকে হয়তো পার হতে হবে গিরিপথ, মরু ও কান্তার, এমনকি কুরুত্রে। ধ্বংসস্তুপের উপর বসে বাজাতে হবে হাড়ের মন্দিরা, করোটির করতাল। কে না জানে, যুদ্ধত্রেটা স্বভাবতই বিশৃঙ্খল। কিন্তু সামরিক কুচকাওয়াজ সুশৃঙ্খল।

তেমনি ছন্দ-পরিক্রমা পুরোটাই গাণিতিক আর কবিতা রচনা রীতিমতো গণিতঘাতী, এমনকি বিজ্ঞানবিরোধী এক প্রজ্ঞার অভিযান। ৩ কিন্তু যে ধরনের রাজনীতি কবিতার ভেতরে নৈরাজ্যিক শৃঙ্খলাকে উস্কে দেয়, অর্থহীনতার বক্তব্যকে অভিবাদন জানায়, তার পাল্টা রাজনীতিও বিদ্যমান। বোধের তুরীয় উল্লাসের নামে কথিত উন্মার্গগামিতাকে পাশ কাটিয়ে, প্রতœগন্ধী শব্দ, প্রথানুগ ছন্দের ব্যাপারে শুচিবাই মুক্ত হয়ে তার ব্যতিচারের মাধ্যমেই কেউ কেউ হাজির করেন নিজস্ব বয়ান। রচনা করেন সেতুবন্ধ, সা¤প্রতিকতার সঙ্গে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের। অকারণ অবারণ চলা যেমন নদীর ধর্ম নয়, তেমনি তাদেরও রয়েছে এক মহাজাগতিক সমুদ্রসন্ধান।

তারা এ জার্নিটুকুর সমস্ত বিচ্ছিন্নতাকে জীবনের ঐক্যসূত্রে বাঁধতে চান। বাজিয়ে তুলতে চান অর্কেস্ট্রা। ফলে একই দশকের কবিতার মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও বিমুখতা স্পষ্ট। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের এ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও বটে। গ্রন্থভুক্ত কবিতার মধ্যে সে পরিচয় মনোযোগী পাঠকের নজর এড়াবে না, আমি নিশ্চিত।

কবিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাই কবিদের নিজস্ব রুচিকে গুরুত্ব দিয়েছি। তাদেরই পছন্দের কবিতাগুচ্ছ থেকে গুটিকয় আমি, নির্বাচন করেছি মাত্র। ফলে এর ভালোমন্দ বিচারের দায় উভয় পরে। তবু বলা জরুরি যে, এ সংকলন কোনো মান যাচাই-এর প্রামাণ্য গ্রন্থ নয়। সে সুযোগ এখানে খুবই সংকীর্ণ।

এ গ্রন্থ কেবল খোদহাজিরি। তারপরও এই গ্রন্থপাঠের মধ্য দিয়ে এই দশকের কবিতার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা লাভ করতে পারবেন অগ্রজ কবি ও গবেষকেরা। আর পাঠকেরা পারবেন রস আস্বাদন করতে, সেটুকু রশদ আমরা জোগাতে পেরেছি--এ দাবি হয়তো আত্মশ্লাঘার শামিল, অশোভন তবু নয়। এ গ্রন্থে নেই কোনো মুদ্রণপ্রমাদজ্জএমনটা বলার খুব ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু ভুল বানানে কবিতা ছাপানোর পক্ষেই কোনো কোনো কবি জোর দাবি পেশ করেছেন।

তা না হলে না-কি পুরো কবিতাই মাঠে মারা যাবে। আমিও তাদের খায়েশ অপূর্ণ রাখি নি তাই। যথাসাধ্য মান্য করতে চেষ্টা করেছি বলেই বানানে কোনো নির্দিষ্ট রীতি অনুসৃত হয় নি। সেটি কী করেইবা সম্ভব, বাংলা একাডেমীর বানানরীতিই যেখানে গোঁজামিলপ্রিয়। আর তাই 'নৈঃশব্দ' বজায় রেখেই 'বেরাল' ঢুকে পড়লো এই সংকলনে।

তা দেখে ভয়ে আঁতকে উঠলেও ভেতরে ভেতরে কৌতুক বোধ করেছি, তাদের এই কট্টরতা ও ছেলেমানুষির আড়ালে বানান বিষয়ে কারো কারো শোচনীয় অজ্ঞতায়। এছাড়া একটি ভুল এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেছি। সেটি 'উ' এবং 'ও'-এর পার্থক্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে। সমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে 'ও' আর অসমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে 'উ' ব্যবহার করাই অভিপ্রেত। যেমন : 'সূর্য উঠে আলো ছড়ায়।

পাখিরা গান গান গেয়ে ওঠে। ' কিন্তু যে সময়ে সাধুভাষা ভেঙেচুরে চলিত শব্দের রূপ নির্মাণ করা হচ্ছিলো, সে সময়ে লেখকেরা ভেবেছিলেন 'ও'-কে 'উ' লিখলেই ক্রিয়াপদ চলিত হয়ে যায়। আদতে সাধু বা চলিতের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়টি গভীরভাবে আমলে না নেয়ার ফলে এমনকি রবীন্দ্রনাথের মধুর বচনও কসুরমুক্ত হতে পারে নি। আরেকটি অভিযোগের কথা না বললেই নয়।

অধিকাংশ কবিই, আমাদের অগ্রজ, লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবিসাহিত্যিকদের মতোই, সমাসবদ্ধ পদ অকারণে অসংলগ্নরূপে লিখে থাকেন। বাংলাভাষায় অসংলগ্ন সমাস আছে ঠিকই, কিন্তু সকল সমাস তো অসংলগ্ন সমাস নয়। আমার এসব অনুযোগ ও আপেকে যদি কেউ আজ 'মাস্টারি' বলে গাল দেন, তাতে অখুশি হবো না, দুঃখ পাবো গালিদাতা এইসব ত্রুটিকে কোনোদিনই ত্রুটি হিশেবে চিনতে না পারলে। আমাদের অনেক অপটুতাকেই আমরা আন্তরিকতা ও আবেগ দিয়ে ঢেকে দিতে চাই। কিন্তু তাতে শেষ রা হয় কি ? আমার জানা নেই, কী পরিণতি অপো করছে 'শূন্যের কবিতা'র ভাগ্যে।

বিস্মৃতির অতলে ডুবে যেতে যেতে অন্তত কয়েকটি বুদ্বুদ তুলে যেতে পারবে তো ! শতাব্দীর প্রথম কবিতাসংকলন এটি। কালের দংশনেই শুরু হোক ভাসানযাত্রা। ভাসিয়ে দিলাম তাই এরে সংশয়ের বেদনা-মান্দাসে... এই সুবিশাল গ্রন্থটি সম্পাদনার কাজে কবিবন্ধুরা প্রায় সকলেই সহযোগিতা করেছেন। কেউ বুদ্ধিতে, কেউ শ্রমে, কেউবা কবিতাসংগ্রহে। আমার অনেক পীড়ন তারা সহ্য করেছেন।

আর সারা দেশ থেকে তরুণ কবিরা যেভাবে সাড়া দিয়েছেন, তাতে কৃতজ্ঞতা জানানোর চেয়ে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বেরই লোভ জেগেছে মনে। কিন্তু যার সহায়তা না পেলে এ ধরনের সংকলনে হাত দেবার দুঃসাহস আমার হতো না, তিনি বাঙলায়ন প্রকাশনা সংস্থার স্বত্বাধিকারী আর্যু ভাই। তাকে ছাড়া, এ সময়ে তরুণদের সবচেয়ে সুহৃদ আর কাউকে আমার জানা নেই। তার আরও কিছু কাজের নমুনায় অতিসত্বর এ তথ্যটি সকলেই জেনে যাবেন। তথাপি, কৃতজ্ঞতা জানানোর পোশাকি ভাষায় কাউকে ম্লান না করাই বোধ হয় শ্রেয়।

সোহেল হাসান গালিব ১ জানুয়ারি '০৮ উপান্ত, উত্তরা

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।