আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফিরে দেখা ইতিহাস : যে কারনে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ব্যর্থ হলাম : পর্ব-১

যেতে চাও যাবে, আকাশও দিগন্তে বাঁধা, কোথায় পালাবে!

মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের ইতিহাসের একটি অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধ যাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন ৩০ লক্ষ নারী পুরুষ যাদের সিংহভাগই ছিলেন নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ । এর বাইরে হাজার হাজার নারী ধর্ষিত হয়েছেন, যৌনদাসী হিসাবে নির্যাতিত হয়েছেন । এই নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি এমনকি শিশুরাও । ১৯৪৯ সালে গৃহীত জেনেভা কনভেনশন কর্তৃক এই ধরণের ঘৃণ্য কর্মকান্ডের প্রতিটিই যুদ্ধাপরাধের অন্তর্ভূক্ত (১) । ২০০২ সালের জুলাইতে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত যুদ্ধাপরাধের যে আওতা নির্ধারণ করে তার মাধ্যমেও এই অপরাধগুলি যুদ্ধাপরাধের অন্তর্ভূক্ত ।

তবে পাকিস্তানী বাহিনীর যুদ্ধাপরাধের সময় কাল ১৯৭১ হবার কারণে তা ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনের আওতায় আলোচনা করাই বেশী যুক্তিসংগত হবে । বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ নয় যেখানে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়নি তবে সম্ভবত: একমাত্র দেশ যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্বেও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রত্যাহার করেছে । আমি এখানে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের কথা বলছি । এইসব পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের এ দেশীয় দোসর যেসব যুদ্ধাপরাধী আছে তারা সময়ের পালাবদলে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেছে, এখন সময় সুযোগমত তাদের করা যুদ্ধাপরাধকেও অস্বীকার করছে । পরবর্তীতে এইসব কুলাংগারদের কথাও আসবে, এদের যুদ্ধাপরাধের বিচারে আমাদের ব্যর্থতার কথাও আসবে ।

তবে এই সিরিজে আমি মুলত: পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী যারা আটক ছিল, যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ ছিল, বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নেবার পরও কোন পরিস্থিতিতে, কি কারনে একটি নব্য-স্বাধীন দেশ তার জন্মযুদ্ধের সময় যারা মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটন করলো তাদের বিরুদ্ধে আনা সকল চার্জ "as an act of clemency" বা "দয়াশীলতা ও ক্ষমার মহত্ব" দেখিয়ে প্রত্যাহার করলো সেটি তুলে আনার চেষ্টা করবো । (২) ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভারত-বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের পরে প্রায় ৯০,৫০০ জনকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক হয় । এই যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ছিল প্রায় ৮০,০০০ উর্দিধারী সদস্য যার মধ্যে ছিল আর্মি (৫৫,৬৯২), নেভী ও এয়ার ফোর্স (১,৮০০), প‌্যারামিলিটারি (১৬,৩৫৪) বা পুলিশ সদস্য (৫,২৯৬)এবং বাদবাকী ১০,৫০০ ছিল সিভিলিয়ান (মুলত: বিহারী) যারা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছে । (৩) এই যুদ্ধবন্দীদের সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও অধিকার সংরক্ষণ করে আটক রাখার মত অবকাঠামো না থাকায় সিদ্ধান্ত হয় ভারত এই ৯০,৫০০ যুদ্ধবন্দীকে আটক রাখবে এবং এদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ ভরণপোষনের দায়িত্ব পালন করবে । এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের ভারতের নিকট হস্তান্তর করা হয় ।

এই যুদ্ধবন্দীদের জন্য তখনকার হিসাবে প্রতিমাসে ভারতের খরচ ছিল ১,০০০,০০০ মার্কিন ডলার । (৪) এই যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে থেকে প্রাথমিকভাবে প্রায় ১৫০০ জনকে চিন্হিত করা হলেও চূড়ান্তভাবে সর্বমোট ১৯৫ জনকে সুনির্দিষ্টভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় । এবং এদের যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার । (৫) বাদবাকী যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে আলোচনা শুরু হয় । বাংলাদেশ তখন স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সহায়তা প্রয়োজন ছিলো ।

পাকিস্তান তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে নাই এবং পাকিস্তানের মিত্র রাষ্ট্র চীনের প্রদত্ত ভেটোর কারনে বাংলাদেশ তখনো জাতিসংঘের সদস্যপদও লাভ করে নাই । ১৯৭২ সালের আগষ্ট মাসে চীন বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দেয়ার ব্যাপারে আনা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভেটো দেয় । এটি ছিল চীনের জাতিসংঘে প্রদত্ত প্রথম ভেটো । (৬) এই অবস্থায় ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ যখন আনুষ্ঠানিক ভাবে ১৫০০ জন যুদ্ধাপরাধী থেকে ১৯৫ জনকে সুনির্দিষ্ট যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের উদ্যোগ নিল এবং জুলাই মাসে সংসদে "International Crimes Act 1973 " পাশ করলো তখন পাকিস্তান এই বিচারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললো । (৭) পাকিস্তানের মতে এটি জেনেভা কনভেনশনের লংঘন কেননা বাংলাদেশ তখনো জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র নয় ।

জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল ৫, ৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের এই বিচার প্রক্রিয়ার উদ্যোগের কোন সমস্যা ছিলোনা । বাংলাদেশ পাকিস্তানের দাবী প্রত্যাখ্যান করে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের এই বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা পর্যবেক্ষণ করার আমন্ত্রণ জানায় । পাকিস্তান এই পরিস্থিতিতে পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে আটকে পড়া ৪০০,০০০ বাঙালীকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে । (৭) (চলবে) তথ্যসূত্র : ১। http://www.unhchr.ch/html/menu3/b/91.htm ২।

Time, Monday April 22, 1974 ৩। en.wikipedia.org/wiki/Indo-Pakistani_War_of_1971 ৪। Time, Monday September 17, 1973 ৫ । Bangladesh in 1972: Nation Building in a New State Rounaq Jahan Asian Survey, Vol. 13, No. 2 (Feb., 1973), pp. 199-210 ৬ China, the Soviet Union, and the Subcontinental Balance Sheldon W. Simon Asian Survey, Vol. 13, No. 7 (Jul., 1973), pp. 647-658 ৭। The weakness in the International Protection of Minority Rights, Javaid Rahman, Kluwer Law International, Page 96-97


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.