আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সরকারের একজিট প্ল্যান কী ?

বসে আছি পথ চেয়ে....

দেশে কি হতে যাচ্ছে? আগামী নির্বাচন কি আদৌ হচ্ছে? দুনেত্রীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি? শেষ পর্যন্ত কোন দিকে যাচ্ছে সরকার? এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে, দেশময়। সব প্রশ্ন ছাপিয়ে সম্প্রতি একটি প্রশ্ন সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কি হবে অন্তর্বর্তী এ সরকারের একজিট প্ল্যান। ইতিমধ্যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া সরকার তার নানা কাজের বৈধতা কিভাবে নিশ্চিত করে নির্বাচনের পর রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে তা কেবল জনমনে নয়, খোদ সরকারের ভেতরও এ বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে বেশ জোরেশোরে। বেশ কিছুদিন ধরেই এ ইস্যুটি নিয়ে সরকারের মধ্যে চিন্তা-উদ্বেগ এবং একটি গ্রহণযোগ্য পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা থাকলেও সম্প্রতি নানা কারণে এ নিয়ে আলোচনা জোরদার হয়ে উঠেছে।

একজিট প্ল্যান নিয়ে নানা ফর্মুলা বাজারে চালু আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে যা আলোচিত হচ্ছে তা হচ্ছে জাতীয় সরকার গঠন। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি জাতীয় সরকার গঠন করে দিয়ে বিদায় নেবে। আর ওই জাতীয় সরকারের কাজ হবে শুধু একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে পুরোপুরি সহায়তা করা এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সকল কাজের বৈধতা দেয়া। রাজনীতিবিদদের নিয়েই ওই জাতীয় সরকার গঠন করা হতে পারে।

একে কিভাবে বাস্তব রূপ দেয়া যায় তা নিয়ে আরও চিন্তা-ভাবনা চলছে। যদিও আইন উপদেষ্টা এফএম হাসান আরিফ সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সরকার গঠনের কোন সুযোগ নেই। প্রধান নির্বাচন কশিশনও প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, নো টার্নিং ব্যাক। তিনি আবারো জোর দিয়ে বলেছেন, মরি আর বাঁচি ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হবে। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যে একজিট প্ল্যানটি নিয়ে আলোচনা হয় তা হচ্ছে- আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাক্ষী রেখেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার একটি সমঝোতায় গিয়ে নির্বাচন দেবে।

আর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের সমঝোতার ভিত্তি হবে ক্ষমতায় যাওয়ার পর তারা বর্তমান সরকারের সব কাজে বৈধতা দেবে। ক্ষমতায় গিয়ে পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক সরকার যাতে এ ক্ষেত্রে কোন পিছুটান দিতে না পারে সে জন্যই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাক্ষী রেখে তাদের সঙ্গে সমঝোতা হবে। এ ক্ষেত্রে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে আলোচনা-সমঝোতার কথা ভাবা হচ্ছে। কারণ একটি দলের সঙ্গে সমঝোতায় গেলে অন্য দল ক্ষমতায় গেলে বর্তমান সরকারের সব কাজের বৈধতা না-ও দিতে পারে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, এই প্রেক্ষাপটেই দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে সম্প্রতি ঢাকায় পশ্চিমা কূটনীতিকরা তৎপর হয়ে উঠেছেন যাদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য তৎপরতায় এ সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়েছে।

তারা বিভিন্নভাবে কথা বলেছেন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে। পশ্চিমা কূটনীতিকরাও আবার একটি জাতীয় সরকার গঠন করার চেয়ে সমঝোতার মাধ্যমে আগামী নির্বাচন দেয়াকে শ্রেয় ভাবছেন। এ ক্ষেত্রে একটি মহলের পক্ষ থেকে সমঝোতার জন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে চুক্তি করার কথাও নাকি ভাবা হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে ঢাকায় মার্কিন চার্জ দ্য এফেয়ার্স গীতা পাসি ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছেন। সম্প্রতি ঢাকা সফর করেছেন মার্কিন উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডন ক্যাম্পসহ আরো বেশকজন পশ্চিমা দেশের কূটনীতিক।

তারা বর্তমান সরকারের একজিট প্ল্যান নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি এবং কয়েকটি ইস্যুতে ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সরকারের জনপ্রিয়তা যখন দ্রুত নিম্নগামী তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতিতে সরকারের নৈতিক পরাজয় এবং শেখ হাসিনার একটি মামলায় হাইকোর্টের রায়ে জরুরি বিধিমালায় দায়ের করা বেশির ভাগ মামলার ভবিষ্যৎ স্পষ্টত অনিশ্চিত হয়ে পড়লে সরকারের একজিট প্ল্যান নিয়ে এ দুটি ফর্মুলা ধরে জোর চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আজম জে চৌধুরীর দায়ের করা চাঁদাবাজির মামলা হাইকোর্ট বাতিল করে দেয়া এবং জরুরি বিধিমালায় আগে সংঘটিত অপরাধের বিচার সংবিধান পরিপন্থি বলে দেয়া পর্যবেণের পর কার্যত বর্তমান সরকারের অনেক পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। এখন অনেকেই মনে করছেন, দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে অনড় এবং একমত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভেতরও অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। দুটি দলই এখন মনে করছে, দ্রুত নির্বাচন দেয়া ছাড়া সরকারের সামনে কার্যত কোনো বিকল্প থাকবে না।

এ ক্ষেত্রে দুনেত্রীকে নির্বাচনের বাইরে রাখাও আর সম্ভব হবে না। জাতীয় নির্বাচন হলে এ দুদলের একটিই আবার ক্ষমতাসীন হবে। দেশের হাল ধরবেন দুজনের একজন। অনেকেই মনে করছেন, যত চেষ্টাই করা হোক না কেন এখন আর সম্ভব হবে না রাজনৈতিক দলে সরকারের কাঙ্ক্ষিত সংস্কারও। দুটি দলের সংস্কারপন্থিরা অন্য কোনো ধরনের চেষ্টা করলে দলের ভেতরে পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে যাবেন।

বিএনপিতে ইতিমধ্যেই ঐক্যপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। সংস্কারপন্থিরা দলের মূল স্রোতে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন। ছোটখাটো কিছু বাধা থাকলেও শেষপর্যন্ত এ ঐক্যপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। আওয়ামী লীগের মধ্যে ঐক্য থাকলেও যে একটি সংস্কারকেন্দ্রিক বিভক্তরেখা ছিল হাইকোর্ট কর্তৃক শেখ হাসিনা মামলা বাতিলের পর কার্যত তা-ও ম্রিয়মাণ হতে চলেছে। ওদিকে দুই নেত্রীর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলের মনোভাবও পাল্টাতে শুরু করেছে।

আগে তারা দুনেত্রীকে মাইনাস করার বিষয়টিকে সহজ বলে মনে করলেও এখন বুঝতে পারছেন ফল হচ্ছে তার উল্টো। তাদের জনপ্রিয়তা আরও বাড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রথমে বর্তমান সরকারকে সমর্থন দিলেও এখন তারা বুঝতে পারছে দুনেত্রীকে নির্বাচনে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মনোভাবও পাল্টাচ্ছে বলে জানা গেছে। ভারত তার অবস্থান থেকে শুরু থেকেই বর্তমান সরকারকে সমর্থন দিলেও বিনিয়োগসহ নানা ইস্যুতে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায় নাখোশ।

ক্ষমতাসীনরা সিভিল সমাজের সমর্থনও হারিয়ে ফেলেছে। এখন অনেকে এখন প্রকাশ্যে সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করছেন। সম্প্রতি এক গোলটেবিল আলোচনায় সাংবাদিক ও সাবেক সচিব আসাফউদদৌলা অনেক কড়া কথা বলেছেন। তিনি তার দীর্ঘ বক্তৃতায় বলেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পরাধীন। আজকের দাবি হওয়া উচিত গণতন্ত্রের মুক্তি।

স্বাধীন রাজনীতি নির্দেশ দেয়, নেয় না। পরিচালিত করে, পরিচালিত হয় না। বাংলাদেশে গণতন্ত্র রয়ে গেছে এক দূরদ্বীপবাসী মায়ামৃগ। গণতন্ত্রকে সংশোধিত হতে হবে, তার নিজের ও সময়ের প্রয়োজনে, অন্যের আস্বাদিত অভিজ্ঞতা থেকে নয়। অন্যের নির্দেশে নয়।

আসফউদ্দৌলা সামরিক বাহিনীরও সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে হলে রাজনৈতিক অগ্রযাত্রায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ দূর করতে হবে। এ দেশে গণতন্ত্রের পথরোধের কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করেছে সেনাবাহিনী। কখনও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায়, কখনও উপল সৃষ্টি করে তারা ক্ষমতা দখল করেছে। এখন তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের রূপরেখা বিনির্মাণে ব্যস্ত।

রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের স্থাপত্য নকশা নির্মাণ করছেন সশস্ত্র বাহিনী। নির্বাচনের চারিত্রিক সংস্কারে নির্ঘুম রয়েছে এক অনির্বাচিত সরকার। আসাফউদদৌলার শ্লেষাত্মক মন্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কি হবে তা উত্তর রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী বা কোনো অসামরিক প্রতিষ্ঠান দিতে পারবে না। এর গ্রহণযোগ্য কোনো পূর্বাভাস দিতে পারবেন না এ দেশের সাধারণ মানুষ। তারাই কেবল দিতে পারবেন, যারা আজ সরকারের কর্মচারী হয়ে গণতন্ত্রের রূপরেখা আঁকছেন (মানবজমিন, ১০ ফেব্রুয়ারি)! দেশের রাজনীতিতে বিদেশী কূটনীতিক ও অন্যান্য মহলের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেও সিভিল সমাজের পক্ষ থেকে তীব্র সমালোচনা করা হচ্ছে।

তারা অভিযোগ করছেন, দেশে জরুরি অবস্থার চেয়ে গুরুতর হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা। দেশ গণতন্ত্রে ফিরলে অর্থনীতির এ বিপর্যয় মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। বস্তুত দেশের অর্থনীতির ওপরই নির্ভর করছে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। অভিজ্ঞমহলের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচনের আয়োজন এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে মতা হস্তান্তরই হতে পারে সংকটের সবচেয়ে যৌক্তিক সমাধান। নির্বাচিত পার্লামেন্টই এ সরকারের একজিট পয়েন্ট কী হবে তা ঠিক করবে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.