আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অন্তবিহীন প্রতীক্ষা~*

আমার আকাশে তুমি জেগো,বৈশাখী এক মেঘের ভেলায়.. চাতক পাখির মতো তাইতো আমি, গান গেয়ে যাই সারা বেলা...

যবে থেকে মনের ঘরে ভাবের আনাগোনা আমার জীবন জুড়ে বসত করে এক রুদ্ধশ্বাস প্রতিক্ষা । জীবন খাতার প্রতি পাতায় আঁচড় কাটে ব্যথানীল আলপনায় । প্রতিটি ক্ষণ ঘিরে মর্মরিত বিষাদের ঢেউ । কিন্তু কার প্রতিক্ষা কিংবা কিসের? জানা নেই । তবে কি সে অবাঙ্‌মনসগোচর? হয়তবা ।

তবু সে যে বড়ো অনির্বচনীয় । সে প্রতিক্ষার কোনো আগুপিছু নেই , নেই কোনো দিনক্ষণ । তবু মননের তীব্রতায় কি জানি কি ঘটে যায়...উত্কন্ঠিত পথ চলি প্রতিটি মুহূর্ত । এই বুঝি সে ধরা দিলো কিংবা দিলোনা। নিদেনপক্ষে বোধের সীমায় বাঁধা পড়ল ।

কিন্তু না, ধরা সে দেয় না । বুঝি সে বাঁধনছাড়া । যেখানে সীমা আর অসীমের দ্বন্দ্ব তারই সঙ্গে বুঝি পিছুটান । তাই সীমার বন্ধনে তার বড়ো অনীহা । তবু আমি বসে থাকি বুকের মধ্যে প্রতিক্ষার আগুন জ্বেলে ।

তবে কি এই ‘তুমি’-র কোনো রূপই নেই? নাকি সে অরূপে বাজে? অথচ চরাচরের প্রতিটি কণায় কিসের যেন স্পন্দন ধ্বনিত হয় । আমার শিরায় শিরায় বেজে যায় তার সুরহারা এক অগ্নিবীণা। কার আশায় আশায় আমার দিবস রজনী বয়ে যায় অকারণ । ‘কার’ দ্বন্দ্বে উদ্বেল হয়ে ওঠে হৃদয় । তবু দিশাহীন পথে আজও আমার অন্তবিহীন প্রতিক্ষা ।

প্রতিক্ষার এই তুমিটাকে যখনই কোনো রঙে ছন্দে বা মাত্রায় বাঁধতে যাই, ঠেক খেয়ে যাই বারেবার । সে যেন অনির্ণেয় এক সত্তা । কি বা তার পরিচয় । জানা নেই । তবু সে প্রাণের মধ্যে উপলব্ধ হয় এক অপরূপ মূর্তিতে ।

যার কোনো সংজ্ঞা নেই তাকে উপলব্ধি করার মধ্যে একটা ‘না’ এর হাতছানি থাকে । কিন্তু তাকে ঘিরে মনের মধ্যে যে প্রবল আবেগ অনুভূত হয় সেটুকু তো মিথ্যে নয় । হোক সে অনিরূপিত, তবু মিথ্যে নয় তার উপস্থিতির তীব্র আকাঙ্ক্ষা । নিভৃত ঠোঁটের কিনার ধরে অনির্দেশ্য চুম্বনের এই অঝোর ধারা, এই অবেলায় ডাক দিয়ে যায় পরাণ ভরে । এই প্রতিক্ষারই প্রখর দাপটে গড়ে ওঠে কিছু মুহূর্ত ।

সেই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো জমা পড়ে যায় ভাবের ঘরের চিলেকোঠায় । কৈশোর স্বপ্নে বিভোর মুহূর্তগুলো ভীরু পায়ে এসে দাঁড়ায় দুরন্ত যৌবনের হাটখোলা দরজায় । হয়ত সে বোবা গভীরতায় একরাশ দাবি নিয়ে অতিক্রান্ত । কিছু দাবি ভিত্তিহীন, অচেতন অভিমানে গড়া । তবু আধেক শরীর আধখানা মন নিয়ে জীবনের দ্বারে তার নিঃশেষ সমর্পণ ।

রাতের নিঝুম কিছু ক্ষণ ভারী হয়ে ওঠে ছেলেবেলার ফেলে আসা নিঃশ্বাসে । কখন বা চোখে-ঘোর-লাগা বেলার মৃদু সুগন্ধে ভরে ওঠে মুহূর্তের পাত্রখানি । কখন বা যৌবনের ঋদ্ধতা ঘিরে শুরু হয় যন্ত্রণার আলাপ । কৃষ্ণনীল জলরঙে মিশে হয়ে ওঠে অসংবদ্ধ প্রলাপ । এই টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলোর কাহিনী গেঁথে যখন ইতিহাস রচি তখনও সে বুকের মধ্যে একরাশ মৌনতা নিয়ে রয়ে যায় গভীর স্তব্ধতায় ।

আমি শুধু বয়ে যাই ছলছল বেগে বুকের মধ্যে জলপ্রপাত নিয়ে । আমি দেখেছি, এই মুহূর্তগুলোর জলছবি আঁকতে বসলে প্যালেটের রঙ হার মেনে যায় । তুলির সুক্ষ্মতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে পড়ে । রঙ থাকুক আর নাই থাকুক, রেখার বক্রতায় মন ভরুক আর নাই ভরুক কি বা যায় আসে । ছবির মধ্যে ছবি, ঘরের মধ্যে ঘর...আমি দুচোখ মেলে ডুবি...সেই গহনে ডুব দিয়ে কোন্‌ অরূপরতন আশা করি?রঙ আর রেখা ছেড়ে শব্দের মোহিনী মায়ায় বাঁধতে যাই আমার পরম পাওয়া মুহূর্তগুলো ।

শব্দ জুড়ে জুড়ে একটা করে বাক্য গড়ে ওঠে । আমি ভাবি এই তো বেশ । ঠিক তখনই গহীন মনের দরজা খুলে বেরিয়ে আসো তুমি । আমি আশায় আশায় থাকি । মনের আকাশে আলো জ্বেলে দেওয়া সেই হাসি বাজবে তোমার ঠোঁটে ।

কিন্তু না, তোমার ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকে একটা কষ্ট মাখানো বক্রতা । ব্যথার দীপশিখা জ্বেলে দেখি, কৃষ্ণকলির কালো হরিণ চোখে সর্বনাশের ছায়া । তোমার বক্র ঠোঁটের কিনার ধরে বৃষ্টিরেখা ঝমঝমায় । আমি ভিজে যাই শুধু ভিজে যাই অকারণ । ভিজতে ভিজতে হঠাত্ আবিষ্কার করি মেঘ জমেছে হৃদয় জুড়ে ।

চোখের কোণ উপছে ওঠে জলে । কেমন স্বাদ সে জলের? আকাশ জোড়া প্রেমের নাকি বিশ্ব জোড়া অপ্রেমের? ধরতে পারি না যেন। শুধু দেখি বোঝা-না-বোঝায় মেশা অলক্ষ্য অভিমান টুকরো টুকরো করে আমারই স্নেহে আমারই প্রেমে গড়ে ওঠা মুহূর্তগুলোর মুক্তোমালা । সাগরের কিনারে বসে ছেঁড়া মালার থেকে গড়িয়ে পড়া মুক্তোগুলো একটা একটা করে ছুঁড়ে দিই নীলরঙা জলে । নিঝুম জলের অতলে চুপি চুপি বসে থাকে সারি সারি ঝিনুক ।

প্রতিটা মুক্তো সার বেঁধে আত্মগোপন করে ঝিনুকের ভেতর । আর আমার হাতে লেগে থাকে প্রতিটা মুক্তো থেকে ঝরে পড়া এক এক ফোঁটা নীরব অশ্রু। হাত ভিজে ওঠে তার লবনাক্ত স্বাদে । অতগুলো মুক্তোর ভার, তবু সাগর নির্বিকার । চলমান বালির বাঁধ ভেঙে ভেঙে পড়ে, তবু তরঙ্গ বুকে নিয়ে নিরন্তর নিরবধি তার চলন ।

শুধু আমার বুকের কন্দরে দানা বাঁধে নাম-না-জানা এক কষ্ট । ভারি হয়ে ওঠে শ্বাস । আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার চোখের কোলে ঝরে পড়ে তোমার একফোঁটা তপ্ত অশ্রু । স্বপ্নিল বুকচোঁয়া জলে আমি ছুঁয়ে ফেলি তোমার স্পর্শবিহীন ঘ্রাণ । সে ঘ্রাণের উত্স কোথায়? হয়তবা ভালোবাসায় ।

তারপর শুধু জেগে থাকে আরো একটি মুহূর্তের জন্য অন্তবিহীন প্রতিক্ষা। .... --রুনা বন্দ্যোপাধ্যায়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।