আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সত্যিকারের মানুষ হই



ানুষকে যখন সম্পদ হিসেবে তুলনা করা হয় তখন সাধারণত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ও উন্নয়নে মানুষের ভূমিকা এবং অবদানকে বোঝায়। কারণ মানুষকে তখন অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পদ বা দায় হিসেবে দেখা হয়। মানুষ যখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইতিবাচক অবদান রাখে তখন তা ‘সম্পদ’ আখ্যায়িত হয়। আর তা যখন অর্থনৈতিক ভূমিকা পালনে অক্ষম হয় এবং অন্যের অর্থনৈতিক ফসল ভোগ করে তখন তা ‘দায়’ হয়ে যায়। আধুনিক ও রুচিশীল অর্থনীতির একটি অন্যতম আন্দোলন হল মানুষকে ‘দায়’ থেকে সম্পদে পরিণত করা।

দায় থেকে মানুষের মুক্তি হলেই মানুষ সম্পদে পরিণত হবে। পবিত্র কোরআনে এ বিষয়টি খুব চমৎকারভাবে বিবৃত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন- ‘যখন নামাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো। আর আল্লাহর অনুগ্রহ তথা রিজিক সন্ধান করো। ’ (সূরা জুমআ-আয়াতঃ ১০) কাজের কোন বিকল্প নেই।

অকর্মন্য মস্তিস্ক শয়তানের হাঁড়ি। কাজ মানুষের জীবনে এনে দেয় সুখ-শান্তি- ও সমৃদ্ধি। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা·)ও নিজ হাতে কাজ করতেন। ব্যবসার উদ্দেশ্যে সফর পর্যন্ত করেছেন। তাছাড়া মহানবী (সা·) বলেছেন, ‘নিজের হাতের উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম অন্য কোন পবিত্র খাদ্য আর নেই।

’ (বোখারি শরীফ) আমরা অবশ্য ভালোভাবেই জানি মানবসম্পদ হল, উৎপাদন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি বিশেষ উপাদান। অর্থনীতিতে সাধারণত উৎপাদনের চারটি উপাদানের কথা বলা হয়। (১) ভূমি (২) শ্রম (৩) মূলধন (৪) উদ্যোগ। উৎপাদনের চারটি মূল বিষয়ের মধ্যে দুটোই মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তা হল, শ্রম ও উদ্যোগ।

মানুষ শ্রমিক হিসেবে যে দৈহিক সেবা দেয় তা হল শ্রম। আর উদ্যোগ হল, উৎপাদনের বাকি তিনটি উপাদানকে একত্রিত ও সমন্বিত করে কোন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ গ্রহণ করা। উৎপাদন, বাজারজাত, সর্বোপরি লাভ-ক্ষতির ঝুঁকি বহন করা। এভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানবসম্পদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের এ বিশাল শ্রেণীকে কাজে লাগানোর জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খুবই জরুরি।

শিক্ষার মাধ্যমে যেমন ব্যক্তির উন্নতি হয়, তেমনি ব্যক্তির উন্নতির ক্ষেত্রে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ ও কর্মস্পৃহা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেয়। ইসলামে মানবসম্পদ উন্নয়নকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্ম ও ইবাদত মনে করা হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের মহানবীর চারটি আদর্শের প্রতি নজর দিতে হবে। (১) শিক্ষা (২) নৈতিক চরিত্র (৩) স্বাস্থ্য (৪) কর্মপ্রেরণা ও কাজের মর্যাদা। ১· শিক্ষাঃ শিক্ষা ছাড়া মানুষের উন্নতি, অগ্রগতির আশা করা যায় না।

মহানবী (সা·) শিক্ষার প্রতি খুবই গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরজ। (সুনানে ইবনে মাজাহ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা·) থেকে বর্ণিত রাসূলে আরাবি (সা·) বলেন, আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি। (তিরমিজি শরিফ) বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত রাসূল (সা·)-এর আগমনটাই যদি মানব জাতির শিক্ষা-উন্নয়ন সম্পর্কিত হয় তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি লেখাপড়ার প্রতি, জানার প্রতি কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম মানুষকে শিক্ষার মাধ্যমে বাস্তব সম্পদে পরিণত করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে।

মদিনার মানুষের মধ্যে দীনি দাওয়াতের সঙ্গে সঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে শিক্ষকরূপে প্রেরণ করেছেন প্রিয় নবী (সা·)। প্রশ্ন হতে পারে, কোন শিক্ষা ফরজ। ইসলামী যে জ্ঞান দৈনন্দিন জীবনে লাগে ততটুকু শিক্ষা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। তার চেয়ে অতিরিক্ত পড়াশোনা করা ফরজে কেফায়া। তবে পৃথিবীর পেশাগত যোগ্যতার বেলায় যে ব্যক্তি যে পেশায় কাজে চুক্তিবদ্ধ তা তার জন্য শিক্ষা করা ফরজ।

অন্যথায় চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে যথাযথভাবে কর্মসম্পাদন সম্ভব নয়। ২· নৈতিক চরিত্রঃ মানবসম্পদ উন্নয়নে নিষ্ঠা, সততা ও দায়িত্ববোধের মতো চারিত্রিক গুণাবলী অতীব জরুরি। কারণ সততার অভাব থাকলে ব্যক্তির পক্ষ থেকে যথাযথ কাজ নেয়া অসম্ভব। সততার অভাবে, দায়িত্বহীনতার কারণে হয়তো ব্যক্তি চুরি করবে বা কাজে ফাঁকি দেবে বা কোন সম্পদ নষ্ট করে বসে থাকবে। তাই দৈহিক কর্মক্ষমতা, পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি নৈতিক গুণাবলী একা- প্রয়োজন।

নৈতিকতার শিক্ষা প্রদানের জন্যই মহানবী (সা·) ইরশাদ করেন- ‘হে মানুষেরা! আল্লাহকে ভয় করো, আর জীবিকা অন্বেষণে উত্তম পন্থা অবলম্বন করো। কেননা কোন প্রাণীই তার জন্য বরাদ্দ জীবিকা শেষ না করে কখনোই মৃত্যুবরণ করবে না। যদিও তা পেতে বিলম্ব হয়। অতএব আল্লাহকে ভয় করো। আর জীবিকা অন্বেষণে উত্তম পন্থা অবলম্বন করো।

হালাল গ্রহণ করো। হারাম বর্জন করো। ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ) মহানবী (সা·) নৈতিক চরিত্রের কত চমৎকার নীতিবাক্য উচ্চারণ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি তোমার নিকট কোন আমানত রেখেছে, তুমি তা আদায় করো। আর তোমার সঙ্গে যে ব্যক্তি খেয়ানত করেছে, তার সঙ্গেও তুমি খেয়ানত করো না। ’ (তিরমিজি) মালিক-শ্রমিকের মধ্যে যদি আমানতের শিক্ষা বা-বায়ন করা যায়, তাহলে সমাজ হবে সম্পূর্ণ খেয়ানতমুক্ত।

দুর্নীতিহীন। ৩· স্বাস্থ্যঃ স্বাস্থ্যহীন দুর্বল ব্যক্তি নিজেই অন্যের মুখাপেক্ষী। উন্নয়ন কাজে তার তেমন আশা করা যায় না। কাজের আগে অবশ্যই একজন মানুষকে সুন্দর স্বাস্থ্য গঠনের প্রতি যত্নবান হতে হবে। মহানবীর আদর্শে উপার্জন, ভোগ ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য তাগিদ রয়েছে।

অবহেলার কারণে একজন সুস্থ ব্যক্তিও অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। সুস্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হতে আল্লাহর নবী ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই তোমার ওপর তোমার শরীরের হক রয়েছে’ (বোখারি শরিফ)। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য নষ্টকারী সব বস্’কেও তিনি অবৈধ ঘোষণা করেছেন। নিশ্চয় নেশাজাতীয় সব পানীয় বস্’ মুমিনদের জন্য হারাম (কানযুল উম্মাল)। এক প্রশ্নের উত্তরে মহানবী বলেন, মদ মূলত কোন ওষুধই নয়।

বরং তা হচ্ছে ব্যাধি। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে মুমিনের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হতে দেখা গেছে আমাদের প্রিয় নবীকে। তিনি দারিদ্রø দূরীকরণে যাকাতভিত্তিক বাধ্যতামূলক সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করেছেন। যাতে হতদরিদ্র মানুষেরা পুষ্টির অভাবে জীবন না হারায়। কারণ সমাজ একজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কর্মক্ষম মানুষের আশা করে।

৪· কর্মপ্রেরণা ও কাজের মর্যাদাঃ কাজের প্রতি দার্শনিক মনোবৃত্তি মানুষকে কর্মমুখী হতে সহায়তা করে। যে দর্শনে কাজের প্রতি উৎসাহ ও মর্যাদা দেয়া হয়, সেখানে কর্মমুখী মানুষের মিছিল চোখে পড়ে। পেশাগত দক্ষতা, দৈহিক কর্মক্ষমতা, সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা যদি একটি কাজের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো যায়, তাহলে মানবসম্পদ উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি হবে। মহানবী (সা·) এ কর্মের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। বৈরাগ্য ও ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করেছেন।

তিনি বলেন, ‘দাতার হাত গ্রহীতার হাত হতে উত্তম’ (বোখারি), অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন, ‘মানুষের নিজ হাতের উপার্জন অপেক্ষা পবিত্রতম উপার্জন আর নেই’ (মুসনাদে আহমাদ)। নবীজীর এ আদর্শে প্রসন্ন হয়ে কবি শেখ হাবিবুর রহমান তার ‘নবীর শিক্ষা’ কবিতায় লেখেছেন- ‘নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা মেহনত করো সবে। ’ বাস্তব ক্ষেত্রে মানব জাতিকে কাজে লাগানোর জন্য আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আদম-হাওয়াকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে একটি সুন্দর বাগান সাজিয়েছেন। এ বাগানে কেউ অকর্মন্য মানুষকে দেখতে পারে না।

দেখতে পারে না অলস মানুষের পদচারণা। একজন অলস অন্য একজন অলসের সংস্রব কামনা করে না। সুতরাং সুন্দর পৃথিবী সাজাতে আজও আমাদের ফিরে যেতে হবে রাসূলে আরাবির আদর্শের দিকে। সংগৃহীত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।