আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চেহারা প্রতিস্থাপন !!!

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয় হৃদপিণ্ড, যকৃৎ ইত্যাদি অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কথা অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রতিনিয়তই সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি লাভ করছে করছে। এমনই একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলো চেহারা প্রতিস্থাপন। চেহারা প্রতিস্থাপন চিকিৎসা তাদের জন্য যাদের পুড়ে যাওয়া, আঘাতজনিত কারণে বা জন্মগতভাবে চেহারা বিকৃত হয়েছে। এটা একধরণের পূনর্গঠনমূলক শৈল্যচিকিৎসা যার মাধ্যমে বিকৃত চেহারাকে প্রত্যাশিত আকার দেওয়া সম্ভব হয়।

২০০৫ সালে শৈল্যচিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে নতুন এক দিগন্তের সূচনা করেন ফরাসী অধ্যাপক বার্নার্ড দিভশেল এবং জ্যাঁ মাইকেল দুবার্নার্ড। তাদের নেতৃত্বে একদল ফরাসী শৈল্যচিকিৎসক পৃথিবীর প্রথম সফল আংশিক চেহারা প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়। সেই সাথে চেহারা প্রতিস্থাপন চিকিৎসার প্রথম গ্রহীতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন ইসাবেল দিনোয়াঁ নামক একজন মহিলা। পোষা কুকুরের আক্রমনে তার চেহারা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শৈল্যচিকিৎসকরা তার মুখমণ্ডলের পেশী, শিরা, ধমনী, স্নায়ু ও ত্বক প্রতিস্থাপন করেন।

ভাগ্যিস এ সময়ে একজন দাতার কাছ থেকে প্রতিস্থাপনযোগ্য এ সব দেহকলা (টিস্যু) ও অঙ্গ পাওয়া গিয়েছিল। এমনকি দাতার ঠোঁট, থুতনি ও নাক-ও প্রতিস্থাপনের কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই দাতা তখন ক্লিনিক্যালী অকেজো মস্তিষ্কের মৃত্যুপথযাত্রী রোগী যাকে নিয়ে কোন আশাই আর অবশিষ্ট ছিল না। দাতার পরিবার সহানুভূতিশীল হয়ে ইসাবেল-কে কাজে লাগতে পারে এমন যে কোন দেহকলা (টিস্যু) ও অঙ্গ সরবরাহ করতে রাজী হয়। সৌভাগ্যক্রমে এই দাতার রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু টাইপ সুন্দরভাবে ইসাবেল-এর সাথে ম্যাচ করলেও সহজভাবে খেতে, পান করতে এবং হাসতে তাকে আঠারো মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

স্বাভাবিক চেহারায় ইসাবেল দিনোয়াঁ শৈল্যচিকিৎসার মাধ্যমে চেহারা প্রতিস্থাপনের পরে ইসাবেল দিনোয়াঁ পৃথিবীর প্রথম সফল পূর্ণাঙ্গ চেহারা প্রতিস্থাপিত হয় ২০০৮ সালে। এবারেও ফরাসী শৈল্যচিকিৎসকরা কৃতিত্বের দাবীদার। পূর্ণাঙ্গ চেহারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল ফ্রান্সের হেনরী-মন্ডর হাসপাতালে। গ্রহীতা প্যাসকেল কোলার নামক এই ব্যক্তি যিনি নিউরোফাইব্রোম্যাটোসিস নামের এক অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই রোগের ফলে যত্রতত্র টিউমার হয়ে মারাত্মকভাবে তার চেহারা বিকৃত হয়েছিল।

এই অস্ত্রোপচারের ফলে তিনি ফিরে পেলেন নতুন এক চেহারা। কিন্তু এর জন্য তাকেও খুঁজতে হয়েছিল একজন দাতা যার সাথে তার রক্ত ও টিস্যুর সবচেয়ে বেশী মিল। নিউরোফাইব্রোম্যাটোসিস রোগে আক্রান্ত প্যাসকেল কোলার শৈল্যচিকিৎসার মাধ্যমে চেহারা প্রতিস্থাপনের পরে প্যাসকেল কোলার এই ধরণের অস্ত্রোপচারের অনেক দৃষ্টান্ত থাকলেও ইদানিং এই বিষয়ের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। প্রথমতঃ এই অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে রোগীর জীবন-মরণের কোন প্রশ্ন জড়িত নয় বরং এর সাথে ব্যক্তিগত সৌন্দর্য্য ও মানসম্পন্ন জীবনযাপন জড়িত। মারাত্মকভাবে বিকৃত চেহারা যেমন কোন মানুষের জন্য কাংখিত নয় তেমনি তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না।

মানুষ প্রকৃতিগতভাবে যে চেহারাই পাক না কেন তা নিয়ে হয়তো সন্তুষ্ট থাকে বা থাকতে পারে কিন্তু দুর্ঘটনা বা রোগজনিত চেহারা বিকৃতি যে নিদারুণ মনঃকষ্টের কারণ তা বলাই বাহুল্য। কেবল অস্ত্রোপচারই পারে চেহারা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এই মনঃকষ্ট লাঘব করতে। দ্বিতীয়তঃ প্রতিস্থাপনযোগ্য এ সব দেহকলা (টিস্যু) ও অঙ্গ কেবল জীবিত দাতার কাছ থেকেই পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ দান করতে হলে একজন দাতাকে মৃত্যুর আগে দেহকলা (টিস্যু) ও অঙ্গ দেওয়ার ক্লেশ সহ্য করতে হবে। জীবনের শেষ প্রান্তে আসা কোন প্রান্তিক রোগীর স্বজনেরা চাইবে না তার আরো কষ্ট হোক।

তবে এই বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে শুরু করেছে। মরণাপন্ন রোগীদের অনেকেই মানবিক কারণে চেহারা প্রতিস্থাপনের জন্য দেহকলা (টিস্যু) ও অঙ্গ দান করতে এগিয়ে এসেছেন। এই বিষয়টা অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধাহত মার্কিন সেনাদের জন্য। বিকৃত চেহারার চিকিৎসার জন্য তারা দেহকলা (টিস্যু) ও অঙ্গ দাতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে স্টেম সেল গবেষণাও বেশ আশা জাগানিয়া।

বিজ্ঞানীরা আশা করছেন খুব শিঘ্রই স্টেম সেল থেকে প্রয়োজনমতো অঙ্গ উৎপাদন করা সম্ভব হবে যা হবে নিরাপদ ও বর্জনের ঝুঁকি-বিহীন। অবশ্য নিজ দেহের ত্বক, দেহকলা ও অন্যান্য উপযোগী অঙ্গ নিজ দেহেই প্রতিস্থাপিত হলে বর্জনের কোন সম্ভাবনা থাকে না। তবে এই ধরণের অস্ত্রোপচার অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়-সাপেক্ষ (৮ – ১৫ ঘন্টার অস্ত্রোপচার) আর এর জন্য প্রয়োজন সুদক্ষ শৈল্যচিকিৎসকদের একটি সফল টিমওয়ার্ক। অবশ্য চিকিৎসা-গ্রহীতাদের সারা জীবন মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয় ইম্যুনোসাপ্রেসিভ ওষুধের জন্য যাতে গ্রহীতার দেহ প্রতিস্থাপিত চেহারাটাকে বর্জন না করে। দীর্ঘমেয়াদে ইম্যুনোসাপ্রেসিভ ওষুধ গ্রহণের ফলে দেহে সংক্রমণ, কিডনী বিকল হওয়া ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

এ ছাড়া এই চিকিৎসা-গ্রহীতাদেরকে “নতুন চেহারা” মানিয়ে নেওয়ার জন্য বিশদভাবে কাউন্সেলিং করতে হয়। কারণ এত দিনের চেনা চেহারা ছেড়ে নতুন চেহারায় নিজেকে দেখার মধ্যে একটা আবেগপূর্ণ দিক জড়িত থাকে – নিজের সাথে ও অন্যের সাথে মানিয়ে নিতে সময় লাগে। সে দিন হয়তো আর বেশি দূরে নয় যে দিন কসমেটিক সার্জারী ও চেহারা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মানুষ নিত্য নতুন চেহারা ধারণ করবে (পোষাক বদলের মতোই!!) শখের বশে, প্রিয়জনকে চমক দেবার আশায় অথবা এমন কিছু কারণে যা আমরা এখনো জানি না। ভবিষ্যতে এমনও তো হতে পারে একদিন অচেনা একজন করমর্দনের জন্য আপনার সামনে হাত বাড়িয়ে বলবে “কী! আমাকে চিনতে পারলে না! আমি তো তোমারই - - - -”। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।