আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্বাসনে সাংবাদিক, নির্যাতিত সাংবাদিকতা



নির্বাসনে সাংবাদিক, নির্যাতিত সাংবাদিকতা ফকির ইলিয়াস ----------------------------------- বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকরা যেভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন তা আশঙ্কাজনক। সাংবাদিকদেরকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উদ্যোগ নেই। এই মন্তব্য করেছেন মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কা থেকে প্রকাশিত ‘লে জার্নাল হেবডোমেডের’-এর প্রকাশক মি. আবুবকর জামাল। তিনি এখন নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। এই আন্তর্জাতিক বুলেটিনে ম্যাথিও হেনসেনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মরক্কোর এই প্রকাশক মরক্কোর শাসক কিং হাসানেরও তীব্র সমালোচনা করেছেন।

যে দেশগুলোতে সাংবাদিকতা মুখ থুবড়ে পড়ছে তার একটি সাম্প্রতিক তালিকাও প্রকাশ করেছে সিপিজে। বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং শাসকদের নির্যাতনে সাংবাদিকদের স্বদেশ ত্যাগের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এরা প্রাণ বাঁচাতে, তাদের পরিবার-পরিজন রক্ষার্থে বিভিন্ন দেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিচ্ছেন। গ্রহণ করছেন নির্বাসিত জীবন। ২০০১ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যìত মোট ২৪৩ জন সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন বলে তথ্য প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস’ (সিপিজে)।

এলিজাবেথ উইচেল ও ক্যারেন ফিলিপস লিখিত একটি সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে এসব সাংবাদিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক হত্যা, জেল-জুলুম, সামাজিক হয়রানি এবং রাজনৈতিক নির্যাতনের শিকার। ফলে তাদের নির্বাসিত জীবন গ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না। জরিপে দেখা গেছে, নির্বাসিত নতুন জীবনে এসব সাংবাদিকদের প্রায় শতভাগই তাদের নিজ সাংবাদিকতা পেশা ধরে রাখতে পারেননি। সিপিজের সমীক্ষায় দেখা গেছে ৯৪ জন সাংবাদিক চরম হুমকির মুখে তাদের স্বদেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। এর মধ্যে কলম্বিয়া, হাইতি, আফগানিস্তান এবং রয়ান্ডা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ।

মেটি ৩৬টি দেশের ২৪৩ জন সাংবাদিক নির্বাসিত হলেও এর অর্ধেক হচ্ছেন জিম্বাবুয়ে, ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া, কলম্বিয়া এবং উজবেকিস্তান থেকে। সমীক্ষায় আরো দেখা গেছে, ২৪৩ জনের মধ্যে ৩৪ জন নির্বাসন থেকে স্বদেশে ফিরে গেছেন। ২০৯ জন এখনো নির্বাসনে রয়েছেন। নির্বাসনে থাকা সাংবাদিকদের মধ্যে আছেন জিম্বাবুয়ে থেকে ৪৮ জন, ইথিওপিয়া থেকে ৩৪ জন, ইরিত্রিয়া থেকে ১৯ জন, কলম্বিয়া থেকে ১৭ জন, উজবেকিস্তান থেকে ১৬ জন, হাইতি থেকে ১৪ জন, আফগানিস্তান এবং লাইবেরিয়া থেকে ১০ জন, রুয়ান্ডা থেকে ৯ জন, গাম্বিয়া থেকে ৬ জন এবং ইরান থেকে ৫ জন। এসব সাংবাদিকদের ৭২ জন যুক্তরাষ্ট্রে, ২৪ জন ব্রিটেনে, ২১ জন কেনিয়ায়, ২০ জন কানাডায়, এবং ১৪ জন সাউদার্থ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন।

বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা থেকেও বেশ কিছু সাংবাদিক ইউরোপ আমেরিকায় ‘এক্সাইল লাইফ’ বেছে নিয়েছেন বলে বিভিন্ন সমর্থিত সূত্র নিশ্চিত করলেও সিপিজের সমীক্ষায় এর কোনো উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে সিপিজে কোনো ফুটনোটও প্রদান করেনি। তবে সাম্প্রতিককালে বিশেষ করে বিগত জোট শাসনামলে বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন আন্তর্জাতিক উদ্বেগের কারণ হয়েছে। কয়েকজন প্রতিতযথা সাংবাদিক হত্যার বিচার প্রক্রিয়া ঝুলে আছে। এদিকে ‘ডেঞ্জারাস অ্যাসাইনমেন্টস’ নামক বার্ষিক বুলেটিন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে সিপিজে।

‘কভারিং দ্য গে­াবাল প্রেস ফিন্সডম স্ট্রাগ’ বিষয়ে গ্রীষ্মকালীন ২০০৭ এই সংখ্যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংবাদ সেন্সর এবং সাংবাদিক নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ইরাকে ২০০৬ সালে ৩২ জন কর্মরত সাংবাদিক মৃত্যুবরণ করেছেন। ২০০৩ থেকে ২০০৬ পর্যìত ইরাকে মোট ১১৫ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। গোটা বিশ্বে ২০০৬ সালে মোট ৫৫ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। ২০০৬ সালে যেসব উল্লেখযোগ্য সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে­ এর মধ্যে রয়েছেন রাশিয়ান সাংবাদিক মিস আনা পলিটকোভোস্কি, সুদানের আল ওয়ফাক সম্পাদক মোহাম্মদ তাহা।

মিসরীয় ইন্টারনেট লেখক আব্দুল করিম সোলাইমানকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন মিসরীয় প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক। যা ছিল আলোচিত ঘটনা। ‘ইরাকি সাংবাদিকদের কাছে আমাদের ঋণ’ শিরোনামে জর্জ পেকার একটি মর্মস্পর্শী নিবন্ধ লিখেছেন এই বুলেটিনে। মোহাম্মদ আল বান (মৃত্যু ১৩ নভেম্বর ২০০৬), আসওয়ান আহমেদ লুৎফুল্লাহ (মৃত্যু ১২ ডিসেম্বর ২০০৬), নাকশিন হাম্মা রাশিদ (মৃত্যু ২৯ অক্টোবর ২০০৬), আহমেদ হাদি নাজি (মৃত্যু ৫ জানুয়ারি ২০০৭), খামেইল খালাফ (মৃত্যু ৫ এপ্রিল ২০০৭), ওসমান আল মাশাদানি (মৃত্যু ৬ এপ্রিল ২০০৬) এদের হত্যাকাণ্ডকে বড়ো নির্মমভাবে বর্ণনা করেছেন লেখক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকরা যেভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন তা আশঙ্কাজনক।

সাংবাদিকদেরকে রক্ষায় আìতর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উদ্যোগ নেই। এই মìতব্য করেছেন মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কা থেকে প্রকাশিত ‘লে জার্নাল হেবডোমেডের’-এর প্রকাশক মি. আবুবকর জামাল। তিনি এখন নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। এই আìতর্জাতিক বুলেটিনে ম্যাথিও হেনসেনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মরক্কোর এই প্রকাশক, মরক্কোর শাসক কিং হাসানেরও তীব্র সমালোচনা করেছেন। যে দেশগুলোতে সাংবাদিকতা মুখ থুবড়ে পড়ছে তার একটি সাম্প্রতিক তালিকাও প্রকাশ করেছে সিপিজে।

৩ মে ২০০৭ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফিন্সডম ডে উপলক্ষে প্রকাশিত এই তালিকায় বলা হয়েছে­ গেলো পাঁচ বছর এর জরিপে দশটি দেশ নানাভাবে সংবাদপত্র, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদেরকে ঘায়েল করার মতো জঘন্য কাজ করেছে। এই তালিকার প্রথম দেশটি হচ্ছে ইথিওপিয়া। যার নেতৃত্বে রয়েছেন মেলেস জেনাউয়ি। তিনি ১৮ জন সাংবাদিককে কারাদণ্ড দিয়েছেন। প্রায় ১০০ সাংবাদিককে জোরপূর্বক বিদেশে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে।

বিদেশী বেশ কজন সাংবাদিককে তার দেশ থেকে বিতাড়িত করেছেন। কয়েকটি সংবাদপত্র, সংবাদ ওয়েব বন্ধ করে দিয়েছেন গেলো বছরে। সুনাম ক্ষুন্ন হওয়া তালিকার দ্বিতীয় দেশটি হচ্ছে গাম্বিয়া। রাষ্ট্রপ্রধানের নাম ইয়াহিয়া জামেহ। সম্পাদক ডেয়ডা হায়দারাকে খুন করা হয় ২০০৪ সালে।

২০০৬ পর্যন্ত ১১ জন সাংবাদিককে জেলে পাঠানো হয়েছে। ‘দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট’ নামের প্রভাবশালী সংবাদপত্রটি বন্ধ করা হয়েছে সরকারি নিপীড়নের মাধ্যমে। তৃতীয় দেশটি হচ্ছে রাশিয়া। রাষ্ট্রপ্রধান ভ­াদিমির পুতিন। তিনটি টিভি চ্যানেলই এখন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণাধীন।

১১ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে গেলো পাঁচ বছরে। কোনো ন্যায়বিচার হয়নি। তিনজন সাংবাদিক কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। চতুর্থ দেশটি হচ্ছে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো। রাষ্ট্রপ্রধান জোশেফ কাবিলা।

গেলো দু বছরে দুজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। ৯ জনের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। সাংবাদিকদেরকে ক্রিমিনাল এ্যাক্টে গ্রেপ্তারের প্রবণতা বেড়েছে অধিক হারে। পঞ্চম দেশটি হচ্ছে কিউবা। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান রাউল কাস্ট্রো।

২০০৩ সালের ক্র্যাক ডাউনে ২৯ জন সাংবাদিককে জেলে ঢুকানো হয়। ২০০৫ সালের অপজিশন মিটিং কভারিং করার দায়ে পাঁচজন বিদেশী সাংবাদিক ঐ দেশ থেকে তাড়িত হন। ২০০৬ সালে ফিদেল কাস্ট্রো রোগাক্রান্ত হলে ১০ জন সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহ করার সময়ে নিগৃহীত হন। ষষ্ঠ দেশটি হচ্ছে পাকিস্তান। রাষ্ট্রপ্রধান পারভেজ মুশাররফ।

গেলো পাঁচ বছরে ৮ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। দেশের গোয়েন্দা সংস্খাগুলো সাংবাদিকদেরকে স্বাধীন মতপ্রকাশের চেতনাকে রুদ্ধ করার প্রয়াসী হচ্ছে বিভিন্নভাবে। এই তালিকার সপ্তম দেশটি হচ্ছে মিসর। রাষ্ট্রপ্রধান হোসনি মোবারক। সম্পাদক রেদা হেলালকে নিখোঁজ ঘোষণা করা হয় ২০০৩ সালে।

সরকারি গোয়েন্দা এজেন্টরা ইন্টারনেট, সংবাদ মাধ্যম এবং ফিন্স ল্যান্স সাংবাদিকদেরকে নির্যাতন করছে বিভিন্নভাবে। অষ্টম দেশটি হচ্ছে আজারবাইজান। রাষ্ট্রপ্রধান হচ্ছেন ইলহাম আলীয়েভ। সম্পাদক এলমার হোসেইনভ খুন হন ২০০৫ সালে। ১৪ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্রাইমের সাজানো মামলা দায়ের করা হয়।

দুজন সিনিয়র সাংবাদিককে কিডন্যাপ করা হয় ২০০৬ সালে। বেশ কজন সাংবাদিককে হত্যার হুমকি দিয়েই যাচ্ছে কে বা কারা। নবম দেশটি হচ্ছে মরক্কো। রাষ্ট্রপ্রধান হচ্ছেন, কিং মোহাম্মদ (ষষ্ঠ)। দেশটি এখন আরব বিশ্বের ‘সাংবাদিকদের কারাগার’ বলে খ্যাতি পেয়েছে।

তিনজন সিনিয়র সাংবাদিককে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। স্প্যানিশ ভাষাভাষী ‘আল পেইস’ পত্রিকাটি ব্যান্ড করা হয়েছে। সম্পাদক আলী লামরাবেটকে তার সম্পাদনার দায়িত্ব থেকে ১০ বছরের জন্য সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। দশম দেশটি হচ্ছে থাইল্যান্ড। বর্তমান শাসক হচ্ছেন সুরাইয়ুড চুলানন্ট।

এই সামরিক জাìতা একমাত্র প্রাইভেট টিভি চ্যানেলটির নিজস্ব খবর প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারি সংস্খা কর্তৃক সরবরাহকৃত সংবাদ প্রচারে বাধ্য করা হচ্ছে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা মুখ থুবড়ে পড়েছে মারাতকভাবে। এই দশটি দেশ ছাড়াও ভেনেজুয়েলা, তুরস্ক, মেক্সিকো, পেরু, ইরানকেও সাংবাদিকদের শত্রুরাষ্ট্র বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সিপিজের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মি. জয়েল সাইমন বলেছেন, এই অগ্রসরমান গণতান্ত্রিক বিশ্বে সাংবাদিকরা কথা বলতে পারবেন না, সরকারের খবর লিখতে পারবেন না­ তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

বিশ্বব্যাপী এই অধিকার সোচ্চার করে তোলার লক্ষ্যেই সিপিজে কাজ করে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, সিপিজে প্রতি বছর নিউইয়র্কে ‘প্রেস ফিন্সডম অ্যাওয়ার্ড’ দিয়ে থাকে। এ বছর ২০ নভেম্বর ২০০৭ মঙ্গলবার এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হবে ওয়ার্ল্ড এস্টোরিয়া নামক আন্তর্জাতিক হোটেলের গ্র্যান্ড রুমে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে চলবেই আমাদের কলম­ এই প্রত্যয় নিয়ে এবারো হাজার হাজার সাংবাদিক সমবেত হবেন নিউইয়র্কে। তারা আবারও সমবেত কন্ঠে আওয়াজ তুলবেন, স্বাধীন মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকার দেশে দেশে প্রতিষ্টিত হোক।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।