আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্বাসনে যাওয়ার আগে।

যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

মা রান্নাঘরে ছিলেন। চুলোর উপরে টগবগ করে কি যেন ফুটছে। আগুনের আঁচে মায়ের ফর্সা মুখটি লালচে লাগছিল। "মা, তোমাকে বলতে এলাম।

আমি যাচ্ছি। " মা আমার দিকে ফিরে তাকান। "এই অবেলায় কোথায় যাচ্ছিস আবার? সারাদিন টোটো করে না ঘুরলেই কি নয়?" "আমি নির্বাসনে যাচ্ছি মা। আর দেখা হবে না তোমার সাথে। ক্ষুদিরামের গানটি মনে আছে মা? একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি।

ব্যাপারটা অনেকটা সেই রকম। শুধু আমি আর ফিরে আসবো না। ওয়ান ওয়ে টিকিট। " মা হাসেন। "কোথায় যাচ্ছিস বললি?" আমি হালকা রাগ দেখাই।

"তুমি আমার কথা মন দিয়ে শুনছো না। আমি নির্বাসনে যাচ্ছি। " মা এবার আরো হাসেন। হাসতে হাসতে প্রায় গড়িয়ে পড়েন। আমি এবার সত্যি সত্যি রেগে উঠি।

আমার কথা কেউই সিরিয়াসলি নেয় না। একসময় মায়ের হাসি থামে। আঁচল দিয়ে তিনি মুখ মোছেন। তারপর বলেন, "তোর কথা শুনলে এতো হাসি পায়। " আমি গম্ভীর হয়ে বলি,"আমি কি কোন মজার কথা বলেছি যে এতো হাসতে হবে?" মা বলেন, "মজার কথাই তো।

তুই নির্বাসনে যাবি কিভাবে? আমরা সবাইই তো নির্বাসিত। যা-ভাল করে হাতমুখ ধুয়ে আয়, ভাত খাবি। আমার রান্না শেষ। " বজ্রাহত মানুষের মতো আমি রান্নাঘরের চৌকাঠে বসে থাকি। মা কি কথা বলে গেলেন? সুনীল গাংগুলির একটি প্রিয় কবিতার লাইন অনেক আওড়েছি এক সময়।

"যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অংগুরী ছোঁয়াবো, আমি বিষপান করে মরে যাবো। " তখন নির্বাসন শব্দটির অর্থ ছিল দূরদূরান্তর পেরিয়ে কোন এক অজানা স্থানে চলে যাওয়া। যেখানে পরিচিত কোন কিছু নেই। এখন বুঝি, নির্বাসন মানে অচেনা কোথাও চলে যাওয়া না, এর অর্থ পরিচিত, প্রিয়, ভালবাসার জিনিসগুলোকে হারিয়ে ফেলা। এখন বুঝি প্রকৃতই আমরা এক এক জন নির্বাসিত মানুষ।

প্রতিদিনই আমরা একটু একটু করে আমাদের প্রিয়জনদের কাছ থেকে, প্রিয় জিনিসের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমাদের বাড়ীর সামনে একটি বিশাল হাসনুহানার ঝোপ আছে। সেই ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি। শীতকালে স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলে বাড়ী ফিরতে দেরী হোত। তখন পা টিপেটিপে লুকিয়ে ঘরে ঢুকতাম।

হাসনুহানার গন্ধে সারা মন অবশ হয়ে যেত, মনে হোত কোন এক স্বপ্নের জগত লুকিয়ে আছে ঝোপটির ওপাশে। হাসনুহানার ঝোপটি এখনও সেইখানেই আছে। এখনও তেমনি ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। কিনতু আমি তার পাশ দিয়ে চলে যাবার সময় আর তেমনভাবে অবশ হইনা। এখন মনে হয় ঝোপটি অনেক খানি জায়গা নষ্ট করছে।

বিদায় তোমাকে, হে হাসনুহানা! আমি তোমার কাছ থেকে চলে গেলাম। একই ভাবে বিদায় জানিয়েছি ঈদের দিনে ভোররাতে উঠে দিদিমার সাথে পোলাওয়ে দেবার জন্য মটরশুঁটির খোসা ছাড়ানোকে। বিদায় জানিয়েছি চকচকে একটি আধুলী পাবার আনন্দে নির্ঘুম সারা রাতকে, বিদায় জানিয়েছি নিজের নামে আসা প্রথম চিঠিটি বারবার পড়ার আনন্দকে, বিদায় জানিয়েছি পড়ন্ত বেলার রোদে দেখা লাল চটি পরা একজোড়া ফর্সা পায়ের পাতাকে। বিদায়, বিদায় তোমাদের সবাইকে। তোমাদের কাউকেই আমি আর কাছে পাইনা।

নির্বাসনে চলে গিয়েছি আমি। এখন বুকের মধ্যে একধরণের ভয় নড়াচড়া করে। আজকে কোন জিনিসটি হারিয়ে ফেলবো? তাই আশপাশের সব কিছুকে আরেকবার ভাল করে দেখে নেই। পাশে শুয়ে থাকা মানুষটির ঠোঁটের উপরের সৌন্দর্য্যময় তিলচিহ্নটিকে গোপনে ছুঁয়ে দেখি। আর যদি দেখা না হয় কোনদিন? আর যদি এমন ভাবে না দেখি? শিশুটির গায়ের সুবাসটি কি আমি কালকেও আবার পাবো এমনি করে? জানিনা।

তাই আজই কোলে তুলে নেই তাকে। শিশুটি হাসে কোনকিছু না বুঝেই। তাকে বুকের মধ্যে নিয়ে বসে থাকি। শিশুটি বোঝেনা জাহাজঘাটে অপেক্ষা করছে জাহাজ। যে কোনদিন বেজে উঠবে ঘন্টা।

চিরতরে হারিয়ে যাবে তার হাসিটি। সুনীল গাংগুলি, আপনি কি বলতে পারবেন কতখানি বিষ পান করলে আমরা আমাদের দুঃখ ভুলতে পারবো?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।