আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সহজিয়া দর্শন ৫: নিম তিতা, নিসিন্দা তিতা, তিতা সইত্য কথা (আলী আহসান মুজাহিদকে ঘৃনা)

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

১. আইডিয়াল স্কুলের বায়োলজীর শিক্ষক ছিলেন শফিক স্যার; অসম্ভব নীতিবান, ভীষন রকমের মুডি আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন লোক। ছাত্ররা যমের মতো ভয় করত তাঁকে, স্যার শুধু পড়া ধরার জন্য নাম ধরে ডাকলেই অনেকের পড়া হজম হয়ে যেত, মুখ দিয়ে আর কিছু বেরুতনা। অথচ এমন একজন শিক্ষককেই সম্ভবত আইডিয়াল স্কুলের ছাত্ররা সবচেয়ে বেশী মনে রাখবে, সবাই না হলেও অন্তত আমি যে তাই করব সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কারণ, স্যার আমাকে শিখিয়েছিলেন সত্য বলার সৌন্দর্য। আহামরি কিছুনা, খুব সাধারণ ঘটনা।

আবার এটাও ঠিকনা যে স্যারের কাছ থেকে সত্যবলার সৌন্দর্যটা বোঝার পর আমি আর মিথ্যে বলিনি। তবে তাও, সেই স্মৃতিটুকু রোমন্থন করা আজ খুব জরুরী বলে মনে হলো। দশম শ্রেনীর ঘটনা। শফিক স্যার তখন আমাদের বায়োলজী পড়াতেন, প্রতিদিন ক্লাসে এসে ছবি আঁকাতেন, আর এটা ওটা পড়া ধরতেন। তখন নৈর্ব্যক্তিকের যুগ ছিল, ৫০০ প্রশ্নের ব্যাংক ছিলনা, আমাদেরকে বইয়ের একেকটা চ্যাপটারের যেন টপ-টু-বটম মুখস্থ রাখতে হতো।

এমনি একদিন, স্যার উদ্ভিদের শ্বসনের সমীকরণ নিয়ে কি যেন একটা প্রশ্ন ধরলেন, আমার মাথায় বাজ পড়ল! কারণ, (ক), (খ), (গ), (ঘ) সবগুলোই খুব কাছাকাছি সংখ্যা শোনাল, আমি নিশ্চিত না কোনটা ঠিক। এখন পড়া না পারলে ডায়েরীতে শূন্য ঢুকবে, ডায়েরীর নাম্বার রেজাল্টের সাথে যোগ হয়, শূন্য ঢুকলে এভারেজ অনেক কমে যায় -- এসব হ্যানত্যান আর কি। আমি ভীষন উদ্বিগ্ন। এমন সময় পেছন থেকে এক বন্ধু বলে দিল 'খ'। আমি সাথেসাথে বলে ফেললাম, 'খ'।

কিন্তু কিভাবে যেন স্যার আঁচ করতে পারলেন কেউ হয়ত বলে দিয়েছে, আবার একইভাবে তিনি পুরো নিশ্চিতওনা। স্যার আমার পেছনের বেঞ্চের কাছে এসে সেখানে বসা তিনজনের ওপর কড়া নজর রেখে বললেন, 'তোরা কেউ কি উত্তরটা বলে দিয়েছিস?' প্রশ্ন করতে করতে স্যার তিনজনের চেহারা চেক করলেন, সম্ভবতঃ ধরতে পারলেননা। এরপর স্যার আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'তুই ই বল। পেছন থেকে কেউ কি বলে দিয়েছে?' আমার কি মনে হলো কে জানে! বললাম, 'জ্বী স্যার। তবে কে বলে দিয়েছে সেটা বলবনা।

' বলেই আমি মনে মনে চুড়ান্ত রকমের একটা ধোলাই খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু দেখলাম স্যার আমার ডায়রী নিয়ে একটা '৫' বসিয়ে দিলেন, নিচে ছোট ছোট অক্ষরে লিখলেন 'সত্য বলার জন্য'। আমার কাছে মনে হলো সত্য প্রচন্ড সুন্দর। শফিক স্যার মারা গেছেন আজ সম্ভবতঃ আট/নয় বৎসর। স্যারের ভাগ্য ভাল স্যারকে এজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মিথ্যেটা শুনে যেতে হয়নি।

২. এই ঘটনাটা নিয়ে একটা গল্প লিখে পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম, সম্ভবতঃ লেখার মান খারাপ ছিল, তাই ছাপা হয়নি। কারণ গল্পের কাহিনীটা মোটেও খারাপ ছিলনা। পরে সময় পেলে গল্পটা লিখব ব্লগে, শিরোনাম 'ওয়াগ্গাছড়ার গল্প'। এক যুগ আগে ওয়াগ্গাছড়ার এক পাহাড় বেয়ে উঠছিলাম আমরা তিনবন্ধু, এক সুন্দর আলো ঝলমলে সকালে। আমি বেশ মোটাসোটা ছিলাম তখনই, অর্ধেকটা পাহাড় উঠতেই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম।

পাহাড়ের মাঝমাঝি অবস্থিত পুলিশের একটা ছাউনি টাইপের জায়গায় আশ্রয় নিলাম বিশ্রামের জন্য। সেখানে এক বৃদ্ধের সাথে দেখা, যিনি পুলিশ বাহিনীতে লম্বাসময় ধরে চাকুরীরত। তখন সংসার ছেড়ে স্বেচ্ছায় রাঙামাটিতে বদলি নিয়ে ওয়াগ্গাছড়ার ঐ পাহাড়ে পড়েছিলেন, সংসারের সব কষ্ট যন্ত্রণা থেকে পালিয়ে বেড়াতে। তার বড় ছেলেটা ছাত্ররাজনীতি করে তখন লুটপাটের দায়ে জেলে ছিল, ছোট ছেলেটা মাদকাসক্ত। বড় মেয়ে একসন্তান নিয়ে বাবার বাড়ীতে তখন এক বৎসর, স্বামী মারধোর করে, মেয়ে ফিরে যেতে চায়না।

আর বাকী দুসন্তানের খবরও লোকটা রাখতে চায়না যেন, সে শুধু পালিয়ে থাকতে চায়। ওয়াগ্গাছড়ার পাহাড়ের মাঝামাঝি তৈরী করা বাঁশের কঞ্চির তৈরী ছাউনিতে বসে চা-মোল্লা খেতে খেতে বুড়ো আমাকে তার পারিবারিক হতাশার কথা বললেন। আমি ক্লান্ত শরীরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রইলাম, ভাবছিলাম কেন লোকটা এসব কথা আমাকে বলছেন। খানিকবাদে লোকটা আমার দিকে ঝুঁকে এসে চাপা স্বরে বলতে লাগলেন, 'সবই আল্লাতালার বিচার, বুঝলেন চাচা, বিচার বড় শক্ত। সারাজীবন কি করছি জানেন? ৭১ সালে নিজদেশের সাথে বেঈমানী করছি, তারপর সারাজীবন ঘুষঘাষ খাইয়া আসছি।

আইজকা আল্লায় সব ফল দিতাছে। ' আমার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া বেড়েই চলল। তাকে শুধু বললাম, 'আপনার এসব কুকর্মের কথা কি আপনার ছেলে-মেয়েরা জানেন?' বুড়ো বললেন, 'সবাই জানে। আমিও স্বীকার যাই, হুদাহুদি লুকাইয়া লাভ আছেনি?' ৩. ওয়াগ্গাছড়ার সেই বুড়োর নাম ভুলে গেছি। তবে তিনি হয়ত শান্তিতেই আছেন।

কারণ তাঁর ছেলেমেয়েরা জানেন যে তাদের বাবা অপরাধ করেছেন, সেই অপরাধের জন্য তিনি অনুতপ্ত। সারাজীবনের ব্যর্থতা, সন্তানদের যাবতীয় কষ্ট, সবকিছুকে তিনি নিজের অপকর্মের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তাকে আলী আহসান মুজাহিদদের মতো রাতে দুঃস্বপ্নের মতো ভাবতে হয়না, 'এই বুঝি আমার অপকর্ম ধরা পড়ে যাবে। ' তাঁকে আলী আহসান মুজাহিদদের মতো সন্তানের দৃষ্টি দেখে ভয় পেতে হয়না এই ভেবে যে, 'ছেলেটা কি আসলেই জেনে গেল আমি কি কুকাজ করেছি?' তাঁকে আলী আহসান মুজাহিদদের মতো নামাজে দাঁড়িয়ে ভাবতে হয়না যে পেছনে বসে পান খেতে খেতে তার স্ত্রী ভাবছেন 'হারাজাদা, কত মেয়েমানুষের ইজ্জত খাইছস, এখন আবার নামাজ দেখাস, না?' আমি ভাবি, আলী আহসান মুজাহিদগংরা কি সত্যগুলো স্বীকার না করার কারণে একটা মুহূর্ত শান্তিতে থাকতে পারে? তাদের কি সারাক্ষণ মনে হয়না তাদের সন্তানেরা আসলে জানে তাদের বাবারা একেকটা খুনী, ধর্ষক, যুদ্ধাপরাধী এবং একই সাথে ভয়াবহ রকমের মিথ্যুক। আচ্ছা? আলী আহসান মুজাহিদদের সন্তানদের দিন কাটে কিভাবে? তাদের কি লজ্জা লাগেনা এই ভেবে যে তাদের বাবারা একেকটা খুনী, ধর্ষক, যুদ্ধাপরাধী এবং একই সাথে ভয়াবহ রকমের মিথ্যুক! এই প্রজন্মের কাছে এই প্রশ্নটা রেখেই শেষ করছি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.