আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাঙ্গামাটির রঙে চোখ জুড়ানো? (সাত)

কখনো চাই নাই দূরে থাকি...তবু দূরগুলো বারে বারে আসে...

চাকমা যোদ্ধাগো দুইটা দল পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি সময়ে বর্তমান পার্বত্য এলাকায় আসে...দুর্গম অরণ্যে তৎকালীন সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্থান অনুযায়ী একদল যোদ্ধা প্রায় স্বর্গের আহ্লাদ অর্জন করে। তারা এই স্থানে স্থায়ী আবাস গাড়নের স্বপ্ন দেখে...সেই প্রথম এই অঞ্চলে চাকমা নিবাস শুরু হয়, যদিও মতান্তরে চাকমারা প্রথম আসে ত্রয়োদশ শতকের কোন এক সময়ে। তবে চাকমারা যখনই আসুক বৃহত্তর রাঙ্গামাটি ভূমিতে কিন্তু তারাই প্রথম জনগোষ্ঠী না...কুকী কিম্বা মুরংরা তারো আগে এই ভূমিতে আদিবাসী হিসাবে ছিলো...চাকমারা তাগো ভ্রমণপ্রিয়তা আর যুদ্ধজয়ের আকাঙ্খার জোরে এই এলাকার দখলীস্বত্ত্ব নিয়া নেয়... কুকী কিম্বা মুরংরা ছিলো সনাতন ধর্মাবলম্বী...চাকমারা তখন তাগো বৌদ্ধ ধর্মের পরিচয়ে এলাকার সংস্কৃতিগত ভূমিটারেও নিয়ন্ত্রন করতে শুরু করে। পুরাতনের সাথে নতুনের সমন্বয় সাধনের যেই চিরকালীন স্বভাব আছে সংস্কৃতির, তার প্রতিফলন তাগো জীবনাচরনেও অবশ্য প্রতিভাত হয়। এলাকায় অলিখিত দখলদারী থাকলেও তার স্বীকৃতি মেলে উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে...যখন বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এই অঞ্চলের বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ ভান্ডারের দিকে মনোযোগী হয়।

১৯০০ সালের দিকে প্রণীত হয় পার্বত্য অঞ্চলের প্রথম সাংবিধানিক নীতিমালা...যেইখানে অঞ্চলের পূর্ণ আধিপত্য মঙ্গোলয়েড চেহারা মি-জো'গো অধীনেই থাকে। প্রশাসক নিযুক্ত হয়...রাজার অধীনে নির্বাহী আর আইন বিভাগও স্বতন্ত্র কাঠামোতে বিন্যস্ত হয়। আজো পাহাড়িরা সেই বৃটিশ প্রথামতোই চলতে বেশী আগ্রহী, তাগো গ্রামপ্রধানের নাম তাই হেডম্যান... এইসময় পর্যন্ত এলাকায় অন্যকোন জাতি সত্ত্বার অবস্থিতি জানা যায় না। তয় বিংশ শতকের শুরুর দিকেই তৎকালীন চাঙমা রাজা কয়েকজন সমতলের বাঙালীরে ভাড়া কইরা নিয়া যান তাগো ভূমিতে...যাগো নিযুক্তি ছিলো সমতলের চাষ পদ্ধতি শিক্ষণের উদ্দেশ্যে। পাহাড়ি জুম্ম'এর সাথে সমতলের এই কৃষিজ শিক্ষার সম্মিলন ছিলো যার মূল প্রেরণা বা তাগীদ।

এই বাঙালীরা ছিলো পাহাড়ি রাজার চাকুরে...তাগো চাটগাইয়া অরিজিন হিসাবেই বিবেচনা করা হইতো। গতশতকের ৫০ এর দশকে প্রথম পার্বত্য এলাকার সম্পদে নজর পড়ে তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীর। কর্ণফুলী নদীর প্রবাহরে নিয়ন্ত্রন কইরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের চিন্তা শুরু করে আইয়ুব শাহী...মজা কইরা কওন যায় এইটা ছিলো জওহরলাল নেহরুর উন্নয়ন পরিকল্পণার অহেতুক অনুসরন। বাষট্টি সালে যখন কাপ্তাই বাধ তৈরী শেষ হয় তার ফলশ্রুতিতে গৃহহারা হয় প্রায় ৪০ হাজার পাহাড়ি জনগোষ্ঠী...এদের একটা বিরাট অংশ মিজোরামে আর ছোট্ট একটা অংশ ত্রিপুরায় মাইগ্রেট করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আধার কাপ্তাই লেক সেই থেইকা আমাগো মনোরঞ্জনের তরে নিবেদিত।

কাপ্তাই লেইক (?) যারে আজো বিজয় বাবু কর্ণফুলী নামেই অভিহিত কইরা আসতেছেন তার সৃষ্টির নিমিত্তে যেইসব পাহাড়িরা ক্ষতিগ্রস্থ হইছিলো প্রায় বিনা নোটিশেই...তারা সরকার থেইকা কিছু ক্ষতিপূরণও পাইছিলো বইলা জানা যায়...বিজয় বাবু তার জীবন যেখানে যেমন বই থেইকা আমাগো পাঠ কইরা শুনাইলেন সেই বিবরণী। ৯ একর জমির মালিক এক চাকমা পরিবার দশ বছর সরকারী কার্যালয়ে ধর্ণা দিয়া ১০৪৯ টাকা উদ্ধার করতে পারছিলো বাংলাদেশের কর্মকর্তাগো থেইকা...এই তথ্য শুইনা আমারো মনে পড়লো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত আব্রাহাম চাকমার মা ১৯৯৬ সালে পাইছিলেন তার ক্ষতিপূরণ...আব্রাহাম হাসতে হাসতেই শুনাইছিলো তার মা চৌত্রিশ বছর পর ক্ষতিপূরণের ১০ হাজার টাকা পাইয়া সেইটা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আন্দোলনে খরচ করনের জন্য দান করছিলেন। পাহাড়ি রাজারা অবশ্য বৃটিশ শাসকগো সময় থেইকাই বৃহৎ শাসকগো তল্পী বহনে ছিলো। যেই কারনেই হয়তো ১৯০০'এর পাহাড়ি অ্যাক্টে তাগো অধিকার সমুন্নত ছিলো! রাজার আদেশ শিরোধার্য্য এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী একসময়কার যোদ্ধা জাতি চাকমারা কিন্তু কাপ্তাই বাধের নির্মিতির লগে লগেই খেপে নাই...বিজয় বাবুর মতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারণা আর চর্চ্চায়ই তারা বেশি মনোনিবেশ করছিলো সেই সময়টায়। আর আছে প্রবল রাজাভক্তি... রাজা ত্রিদিব রায়ের একটা প্রকাশনা দেখাইলেন বিজয় কেতন চাকমা।

তিনি এখন পাকিস্তানে বৌদ্ধ ধর্মগুরু হিসাবে দিন কাটান। তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক আইয়ুব খানের সাথে তার সখ্যতা ছিলো সেইটা আন্দাজ করতে খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না। কিন্তু পাহাড়ি জনপদেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম তার আঁচ কি ছড়ায় নাই? বিজয় কেতন চাকমা নিজে যুদ্ধে গেছেন পার্বত্য রাজনৈতিক নেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে...পাহাড়ের দুঃখ কাপ্তাই বাধ নিয়া জনরোষের অস্তিত্ব প্রথম টের পাওয়া যায় স্বাধীনতা যুদ্ধে পাহাড়িগো অংশগ্রহণের মধ্য দিয়াই। রাজাভক্ত-ধর্মভক্ত এই জনপদেও যেই কারনে বিদ্রোহের নজীর উল্লেখ্য... যুদ্ধ শেষ হইলো...স্বতন্ত্র ভূখন্ডভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হইলো...নির্বাহী প্রশাসনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়া শাসক প্রতিনিধি নির্বাচিত হইলো...কিন্তু পাহাড়িগো অস্তিত্ব নিয়া যেই সংগ্রাম...পাহাড়িগো জাতিসত্ত্বার যেই সাংস্কৃতিক অহমবোধ তার কি হইলো? মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা শেখ মুজিবের কাছে খুব ছোট একটা দাবী তুললেন...সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত রাষ্ট্রে যাতে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা হিসাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি মিলে পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীগো...শেখ মুজিব কইলেন,"তোরা বাঙ্গালী হইয়া যা!" বিজয়বাবুর সাথে আলাপচারিতার মধ্য দিয়া পুরা সংলাপের ধারাবাহিকতা যখন এই বাক্যে আইসা পৌছাইলো, তখন তার চোখ ছল ছল ছিলো...আমি স্পষ্ট দেখছি...আর যৌক্তিকতার অশ্রু সকল সময় সংক্রামক...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.