আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফিরে এস সঞ্জয়

ভাঙ্গা দেওয়ালে আগাছার চাষ অথবা প্রথমত মানুষ দ্বিতীয়ত মানুষ তৃতীয়ত মানুষ মূলত যাই বলা হোক না কেন পুরান ইতিহাস আর আজ একই মুঠো খুলে দেখা গেল ফুস..। অনেক পুরনো একটা ডায়েরি। পাতাগুলো হলুদ হয়ে যাওয়া ততধিক বিবর্ন মলাটের ডায়েরিটা হাতে নিয়ে ঘাটতে থাকি আতিপাতি। কি এক অদ্ভুত কৌতুহল আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে। প্রথম এন্ট্রি দেখা যাচ্ছে, ৪ঠা জুলাই ১৯৯৭; লাইন টানা পাতার ডান দিকে খুদে অক্ষরে লেখা, তখন সবে সন্ধে হয়েছে।

আমরা সমবেত প্রতীজ্ঞা করলাম, যত প্রেম আছে দিয়ে যাব বিংশ শতাব্দীর পায়ে। মনের গভীরে কাঁটা হয়ে থাকে, সঞ্জয় বলেছিল, আসবে। দুটো লাইন ছেড়ে বাঁ দিকের মার্জিন ঘেঁষে বড় বড় হরফে লেখা, ওরা বলে খোঁচর। কেউ বলে খোজিয়াল। টিকটিকি।

দাঁত নখ চোয়ারে চোয়াল গলা বুক পেট বেয়ে ঝরে পড়ে যত্তসব অশ্লীল গালিগালাজ। খিস্তি করা যাকে বলে, খেঁকি কুত্তার মতন। আবার ছোট অক্ষরে, দমকা বাতাস এসে মনে করিয়ে দেবে না, সঞ্জয় আসবে বলেছিল? এইটুকু পড়া হতেই আমার ভ্রু জোড়া কুঁচকে ওঠে। কার কথা লিখেছি? কে এই সঞ্জয়? ইত্যাদি প্রশ্ন এসে ভিড় জমায় আমার মধ্যবিত্ত মস্তিষ্কে। তবু কি এক অদ্ভুত কৌতুহল আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে।

অনেক খানি ফাঁক দিয়ে আবার লেখা হয়েছে। এক জন দরিদ্র পঙ্গু যুবককে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। বেঁচে ওঠার শিক্ষা দিয়েছিল। এবং বেঁচে থাকার প্রেরনা। সে কোনও ঈশ্বরের অবতার নয়।

পলিটিক্যাল হিরো নয়। সে এক জন সাধারন মানুষ। সর্ব্বোতভাবে সাধারন এক জন মানুষ। অবতার বা হিরো হওয়ার বাসনা তাঁর ছিল না নিশ্চয়ই, নাহলে... তিন ফুটকির লিডার মার্ক তারপর লম্বা একটা দাগ, কেন দেওয়া হয়েছে কে জানে, দাগের শেষ মাথায় ছোট্ট করে লেখা, নাঃ। এই টুকু পড়ে আমার পিলে চমকে গেল, নাঃ, মানে কী।

আমি কিন্তু এখনও অবধি মানুষটাকে চিনতে পারিনি। মনেই করতে পারছি না। নাঃ আমি মনে রাখি নি। ৫ই জুলাই ১৯৯৭; সঞ্জয় স্বপ্ন দেখিয়েছিল শুধু নিজে নয়, সবাই মিলে সকলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কী করে বাঁচার মত বাঁচতে হয়। ভাবলে অবাক হই কেমন করে পারল, একা? হ্যাঁ।

একাইত। পৃথিবীর বৃহত্তম নদী দ্বীপ, মাজুলির ভাঙ্গন আটকে দিয়েছিল! না। একা বললে সম্পূর্ন মিথ্যে বলা হবে। পনেরো হাজার নিরক্ষর হত-দরিদ্র দুর্ভিক্ষ পিড়ীত মাজুলিবাসী ওর সঙ্গে, বন্যা কবলিত দ্বীপ-বাসীর মুখে হাসি ফোটাতে সামিল হয়েছিল, স্বেচ্ছা শ্রম দিয়ে। এইটুকু পড়ে আমি আবার থেমে যাই।

আমার রুটিন-চালিত অন্তর যেন হাঁফিয়ে ওঠে। কী সাংঘাতিক, এমনটা হয়? রূপকথা মনে হচ্ছে না? না কি উপন্যাসের প্লট? কিন্তু কে এই সঞ্জয়? কিছুতেই মনে করতে পারছি না যে। এই নামে কী সত্যিই কেউ ছিল? না কি আমারই কষ্টকল্পনা? নাঃ। আমি মনে রাখি নি। বছর পনেরো তো হলই।

হয়ত আমারই গল্পের হিরো। হতে পারে, আমি ওকে হিরো বানাবার মতলবে ছিলাম। কেন না, আজ অবধি কোনও নেতার মুখে এমন কোনও মানুষের কথা শুনিনি। টিভি কিংবা খবরের কাগজেও এমন কারুর নাম কই, মনে পড়ছে নাত। তক্ষুনি মনে হল তবে কী তারাও ভয় পেয়েছিল? ভয় পেয়েছিল একক ব্যাক্তি আর সম্মিলিত জনতার এই বৃহত্তম কর্মকান্ডকে।

ভয় পেয়েছে, দু চার জন সঞ্জয় ভণ্ডামির মুখোশগুলো টেনে ছিঁড়ে দিতে পারে, পাল পাল এম.এল.এ, এম.পি. আর আমলাদের। কারণ, সঞ্জয় দেশজ পদ্ধতিতে গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় দ্বীপের সবচেয়ে বড় সমস্যা ভাঙ্গন রোধের যে কাজ শুরু করেছিল তাতে, ঠিকাদাররা আর তাদের থেকে পাওয়া মোটা টাকার জোগান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আলফা জঙ্গিরা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ফিরে এস সঞ্জয়... একটা লাইন ছেড়ে খুব ছোট ছোট করে, সোঁদা গন্ধ গায়ে মেখে, এই রৌদ্রকরোজ্জল প্রান্তর আর বিপন্ন জনতার হৃদয়ের মাঝে... গত কাল তুলে নিয়ে গেছে সঞ্জয়কে। আজ, প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পার, অসম রাইফেল তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। ঢুঁ মারছে একের পর এক আলফা ঘাঁটি।

কিন্তু কোথায় সঞ্জয়? থেকে থেকে কে যেন চিৎকার করে উঠতে চায়। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বার বার পেছন ফিরে তাকাই... ন্যাংটো শিশুদের কান্না, হামাগুড়ি মল মূত্র মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলে ক্ষীণ ক্ষীণে মায়েদের ছেড়াখোড়া নোংরা পোশাকের আড়ালে নিস্প্রভ দুটি স্তন যেমন বাঁচার আশ্বাসকে বহুগুন বাড়িয়ে আকাশের দিকে একটা মই তুলে ধরে, তেমনই, মাটির গন্ধ ঘাম ধূল ময়লা গায়ে মেখে সঞ্জয়, কান পাতলে শোনা যাবে ভাঙ্গনের শব্দ। স্পষ্ট। চোখ বন্ধ করে দেখা যায় এমন। হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ছে।

চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আর সব সময় একটা ভয়। কিসের একটা ভয় যেন তাড়া করে বেড়ায়। ৬ই জুলাই, ১৯৯৭; কতগুলো লুচ্চা, খুনী আর তোলাবাজদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার দিলে তার পরিনাম কী হবে সেটা বুঝতে বেশি বিদ্যা বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। গোটা রাজ্যবাসীকে ভাবতে হবে, এই স্বাধীনতা তাদের কাম্য কি না।

শিরদাঁড়া বেয়ে হিম স্রোত। আমি লিখেছি? এই উক্তি আমার? না আন্য কারুর? ইচ্ছে হচ্ছে একবার গিয়ে দাঁড়াই আয়নার সামনে। বরং সামনে এসে দাঁড়ায় আমার অতীত। কী স্পর্ধা! আলফারা যেটা বুঝতে ভুল করেছে, একজন সঞ্জয় নেহাৎই তুচ্ছ। এমন হাজার হাজার সঞ্জয়ের জন্ম দিয়েছে ভারতবর্ষ।

আগামিতেও দেবে। দিয়েই যাবে। নিরন্তর। নিরবচ্ছিন্ন... কত গোলা-গুলি খরচা করবে ওরা? গোটা দ্বীপবাসী যেখানে ওর পাশে। শুধু মাজুলি নয়, গোটা দেশ তো বটেই এমন কি সারা বিশ্ব আজ জেনে গেছে আলফা ভেকধারীদের আসল পরিচয়, কী তাদের উদ্দেশ্য।

অভিসন্ধিই বা কী। কী চাইছে ওরা? স্বাধীনতা? সার্ব্বভৌম রাষ্ট্র? এখনও বুঝে উঠতে পারি নি ব্যাপারটা। পারছি না। তবু কি এক অদ্ভুত কৌতুহল আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে। আন্দোলনের নামে তাদের আসল উদ্দেশ্যটা আজ বিশ্বের কাছে কাঁচের মতন স্বচ্ছ।

সন্ত্রাসের মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়ানোর সাবেক ফর্মুলা মাজুলিতে ব্যার্থই প্রমানিত হয়েছে। নাহলে মাজুলির যুবক কিশোররা মনে রেখেছে সঞ্জয়কে? এটা আবারও প্রমান করে সন্ত্রাসের সাহায্যে জনতাকে সাময়িক আতঙ্কিত করা গেলেও তা কখনওই স্থায়ি ছাপ ফেলতে পারে না। স্বাভাবিক নিয়মেই ভয় কেটে যায়। জেগে ওঠে শেকড়। সম্মিলিত ইচ্ছা শক্তির কাছে বারে বারে পরাজিত হতে বাধ্য সন্ত্রাস।

তা সে যতই নৃশংস হোক না কেন। ২৯শে জুলাই ১৯৯৭; মাঝে এত গুলো তারিখ বাদ গেল কেন জানি না। ৪ঠা জুলাই তুলে নিয়ে গেল সঞ্জয়কে। গত কাল সিবিআই রিপোর্ট জমা দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ওই দিনই আলফারা ওকে খুন করে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ডাহা মিথ্যে কথা বলতে বাধ্য হয়, আন্দোলনের ধ্বজাধারী, স্বাধীনতাকামী লুচ্চারা। সঞ্জয় ঘোষ, AVERD-NE, এই নামের আড়ালে আসলে RAW’র এজেন্ট, ওদের ওপর নজরদারি করতে এসেছিল। এই ছিল ওদের যুক্তি। সঞ্জয় বলেছিল আসবে... মাত্র পনের বছর, কত জল বয়ে গেল ব্রহ্মপুত্র বেয়ে? কিন্তু আমার যে কিছুই মনে পড়ছে না? সঞ্জয় ঘোষের সঙ্গে আমার সম্পর্কইবা কী? কেন ওকে এত প্রাধান্য দিলাম। নাঃ।

কিচ্ছু না। মনে করতে পারছি না। ১০ই আগস্ট ১৯৯৭; আলফা জঙ্গিদের হাতে খুন হওয়া সঞ্জয় ঘোষের কথা জানতে চাইতেই পোলিওতে পঙ্গু নবীন ভুঁইঞার কথা আর থামে না। সেই মানুষটা নেই মাজুলিতে। নবীনদের মত বাঁশের শিল্পীরা আবার ফড়ে আর মহাজনদের খপ্পরে।

৪ঠা জুলাই ১৯৯৮; লম্বা বিরতি, মাঝে প্রায় একটা বছর। কেন কে জানে। পাতার মাঝখানে বড় বড় করে লেখা, মাজুলিতে AVERD-NE আর নেই। তবু রয়ে গেল যারা তারা পারে নি ভুলতে সঞ্জয়কে। তারই প্রেরনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল যারা তাদের একটা অন্য সংগঠন REDS – Rural Economy Development Society...আমরা যে নামে যে কাজই করি না কেন, বৃহত্তম দ্বীপ-বাসী জানে আসলে একাজ সঞ্জয়েরই।

পরের দিন অর্থাৎ ৫ই জুলাই ১৯৯৮; ওর সংগঠনের মূল কাজ ছিল, মাজুলির গড়িব মানুষদের সংগবদ্ধ করে তাদের মধ্যে থেকেই ছোট ছোট দল গড়ে অর্থ উপার্জনের রাস্তা বার করা এবং সেগুলোকে বাস্তবায়িত করা। ৬ই জুলাই ১৯৯৮; সঞ্জয়ের মৃত্যুতে লাভবান হয়েছে কারা? ছোট বড় মাঝারি ঠিকাদার আলফা সুদখোর মহাজন মিডিল ম্যান বা দালাল পুঁজিপতি ব্যবসায়ী স্থানীয় নেতা পরের পাতায়, মাজুলিবাসী চিনে নিয়েছে ওদের শ্ত্রুদের। অপনিও চিনে নিন... তারপর লম্বা দাগ। চিনে রাখুন আর জেনে নিন এরাই হচ্ছে সেই...................................................... তারপর ফাঁকা। পাতার পর পাতা শূন্য।

খা খা করছে যেন। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। একটু শব্দও হল। ডায়েরিটা বন্ধ করতেই অস্ফুটে বলে ফেললাম, নাঃ। আমি মনে রাখি নি।

আমরা কেউ মনে রাখি নি সঞ্জয়কে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.